হামাসের কাছ থেকে লাশ গ্রহণের মধ্যেই গাজায় ইসরাইলি হামলা

Printed Edition

নয়া দিগন্ত ডেস্ক

মার্কিন মধ্যস্থতায় ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতির মধ্যে ইসরাইলি সেনাবাহিনী গতকাল শনিবার পঞ্চম দিনের মতো গাজা উপত্যকায় আক্রমণ চালিয়েছে। এতে কমপক্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছে। আগের দিন শুক্রবার টানা চতুর্থ দিনের মতো গাজায় বিমান হামলা চারায়, যাতে অন্তত তিনজন নিহত হয়েছেন। এই হামলা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতির ওপর আরো চাপ সৃষ্টি করেছে।

আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি (আইসিআরসি) জানিয়েছে, তারা হামাসের কাছ থেকে তিনটি অজ্ঞাত লাশ গ্রহণ করে ইসরাইলের কাছে হস্তান্তর করেছে। আরব গণমাধ্যম, যেমন আল-আরাবি আল-জাদিদ জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতির মধ্যেও ইসরাইলি বাহিনী গাজাজুড়ে রাতভর একাধিক হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণের খান ইউনুসের পূর্বাঞ্চলে বিমান হামলা এবং গাজা শহরের পূর্বাংশে আবাসিক এলাকায় বিস্ফোরণের ঘটনা রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় হামাস এখন পর্যন্ত ২৮ জন নিহত বন্দীর মধ্যে ১৭ জনের লাশ ফেরত দিয়েছে। শুক্রবার হস্তান্তরিত তিনটি লাশ এর বাইরে। চলমান যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর হামাস তাদের কাছে থাকা ২০ জন জীবিত বন্দীকে মুক্তি দিয়েছে এবং নিহতদের লাশ ফেরত দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তবে গতকাল ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, রেড ক্রসের মাধ্যমে গাজা থেকে পাওয়া তিনটি লাশ ওই বন্দীদের মধ্যে পড়ে না, যারা গাজায় আটক ছিলেন। ফরেনসিক পরীক্ষায় নিশ্চিত হয়েছে, এই তিনটি লাশ যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় ফেরত পাওয়ার অপেক্ষায় থাকা ১১ জন নিহত বন্দীর তালিকায় নেই।

ইসরাইলি হামলা আবার শুরুর আশঙ্কা গাজাবাসীর

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে চলতি মাসে যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে, তা সামান্য স্বস্তি দিলেও, ইসরাইলের ধারাবাহিক লঙ্ঘনের কারণে ফিলিস্তিনিরা প্রতিনিয়ত নতুন হামলার আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। আলজাজিরার গাজা শহর প্রতিনিধি হানি মাহমুদ বলেন, “যুদ্ধবিরতি নীতিগতভাবে থাকলেও, বিস্ফোরণের শব্দ, পূর্ব দিক থেকে গুলির আওয়াজ, ড্রোনের গর্জন সব মিলিয়ে পুরো গাজা উপত্যকার আকাশে যুদ্ধবিরতির ভঙ্গুরতা প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেয়।”

তিনি বলেন, “মানুষ সবসময় বলে, তারা অনিশ্চয়তায় ভুগছে, যুদ্ধবিরতি টিকে থাকবে কি না, ভয় ও মানসিক আঘাত কমবে কি না এই নিয়েই তারা উদ্বিগ্ন।” ১০ অক্টোবর কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম ধাপে ইসরাইলি বন্দীদের মুক্তির বিনিময়ে প্রায় ২,০০০ ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। পরিকল্পনায় গাজা পুনর্গঠন এবং হামাসবিহীন নতুন প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের কথাও বলা হয়েছে।

‘আন্তর্জাতিক গ্যারান্টিগুলো কোথায়?’

গাজায় ইসরাইলের যে আগ্রাসনে অন্তত ৬৮ হাজার ৫২৭ জন নিহত এবং ১ লাখ ৭০ হাজার ৩৯৫ জন আহত হয়েছেন, তার মানসিক প্রভাব ফিলিস্তিনিদের ওপর গভীর। গাজার বাসিন্দা মাজেন শাহিন বলেন, “আমরা আমাদের জীবন পুনর্গঠনের একটি বাস্তব সুযোগের অপেক্ষায় আছি। যুদ্ধের পর প্রথম এক-দুই সপ্তাহে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলাম, কিন্তু তারপর যুদ্ধবিরতি ভেঙে গেল।” গাজা শহরের বাসিন্দা হাসান লুব্বাদ বলেন, “যুদ্ধবিরতির পর এবং নতুন বোমাবর্ষণের ঢেউয়ের পর, যারা একটু নিরাপত্তা, শান্তি ও স্বস্তি অনুভব করতে শুরু করেছিল তারা আবার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে, বিশেষ করে নারী ও শিশুরা।” শাহিন বলেন, “আমরা যে বার্তা দিতে চাই তা হলো যেসব আন্তর্জাতিক গ্যারান্টি দেয়া হয়েছিল, সেগুলো কোথায়? যেসব মধ্যস্থতাকারী দেশ যুদ্ধবিরতি চুক্তি করেছিল এবং এর ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা কোথায়?” তিনি জানান, বুধবারের হামলায় তার এক বন্ধু আহত হয়েছেন, তবে এখন তার অবস্থা স্থিতিশীল। গাজা শহরের বাসিন্দা সুহা আওয়াদ বলেন, “আমরা চাই যুদ্ধের সম্পূর্ণ অবসান, একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতি। আমরা শুধু নিরাপদে বাঁচতে চাই। আমরা চাই যুদ্ধবিরতির প্রতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতি শুধু এক-দুই সপ্তাহের জন্য নয়, যাতে আবার আগ্রাসন শুরু হয়।”

‘না যুদ্ধ’, ‘না শান্তির’ মরণফাঁদের ঝুঁকিতে গাজা : কাতার

গাজা এমন এক মরণফাঁদে পড়ার ঝুঁকিতে আছে, যেখানে যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকলেও রক্তপাত থামছে না। কাতারের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মাজেদ আল আনসারি এই সতর্কবার্তা দিয়ে বলেন, গাজায় দ্রুত আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন ও প্রশাসন গঠন জরুরি, যাতে ইসরাইলি সেনা পুরোপুরি সরিয়ে নেয়া সম্ভব হয়।

তিনি বলেন, “আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে যেতে চাই না যেখানে না যুদ্ধ, না শান্তি এই দুইয়ের মাঝে ঝুলে থাকতে হয়।” গত মঙ্গলবার গাজায় ইসরাইলি বিমান হামলায় অন্তত ১০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়, যাদের মধ্যে ৬৬ জন নারী ও শিশু। ইসরাইল দাবি করেছে, রাফায় এক সেনা নিহত হওয়ার প্রতিশোধে তারা এই হামলা চালিয়েছে। চলমান যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে গাজায় সহিংসতা কমাতে আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েন এবং হামাসকে নিরস্ত্রীকরণের পাশাপাশি ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছে। আনসারি ‘দ্য গার্ডিয়ান’-কে বলেন, “আন্তর্জাতিক বাহিনী ও নতুন ফিলিস্তিনি প্রশাসন দ্রুত গঠিত না হলে যুদ্ধবিরতি স্থায়ী শান্তিতে রূপ নেবে না।”

২০ দফা পরিকল্পনায় আন্তর্জাতিক বাহিনীর কাঠামো স্পষ্ট নয়। কাতার ও তার মিত্ররা জাতিসঙ্ঘের সমর্থনে বাহিনী গঠনের পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্রও বিষয়টি বিবেচনা করছে। আনসারি বলেন, “যদি জাতিসঙ্ঘের ম্যান্ডেট পাই, তাহলে আমরা পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে পারব।” তবে এই প্রক্রিয়া জটিল এবং সময়সাপেক্ষ অথচ গাজার হাতে সময় নেই। তিনি বলেন, “প্রথম ধাপ শেষ করার আগেই আমরা নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। নিহত বন্দীদের লাশ শনাক্ত এবং প্রতিদিন ফিলিস্তিনিদের মৃত্যু এখনো চলছে।”

আনসারি যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, “যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণই ভারসাম্য এনেছে।” ট্রাম্প এই চুক্তিকে “ইতিহাসে স্মরণীয়” বলেছেন। তবে ২০২৪ সালের এপ্রিলেই নেতানিয়াহু নিজ জোটের চাপে অনুরূপ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আনসারি জানান, কাতার আলোচনায় তিনটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল : যুদ্ধ থামানো, দখল রোধ এবং গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ না করা। তিনি বলেন, “চূড়ান্ত নথিতে আমরা এই তিনটি শর্তই নিশ্চিত করেছি।” তবে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রগঠন বা সার্বভৌমত্বের বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি নেই।

দুই বছর পর প্রাণ ফিরে পেল গাজার বিশ্ববিদ্যালয়

যুদ্ধবিরতির মধ্যেই গাজায় হামলা চললেও দুই বছর পর খুলেছে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর সঙ্ঘাত শুরুর পর বন্ধ হয়ে যায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যুদ্ধের আগে গাজায় ৫১টি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ২ লাখ ২৬ হাজার শিক্ষার্থী পড়তেন। সঙ্ঘাতে বহু শিক্ষক-শিক্ষার্থী প্রাণ হারান, শিক্ষা অবকাঠামো ধ্বংস হয়। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী শাহাদ বলেন, “এই দুই বছর ছিল ভয় ও যুদ্ধের সময়। এখন সরাসরি ক্লাসে ফিরতে পারছি, এটা অনেক ভালো লাগছে।” ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র মোহাম্মদ বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় টিকে আছে মানে আমরাও টিকে আছি। এটি নতুন জীবনের শুরু।”

গাজায় গণহত্যা ফের শুরুর অজুহাত খুঁজছেন নেতানিয়াহু

ইসরাইল যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে গাজায় গণহত্যা ফের শুরু করতে চায় বলে অভিযোগ করেছেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান। আঙ্কারায় এস্তোনিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারগুস সাখনার সাথে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এখনই ইসরাইলের ওপর চাপ বাড়ানো।”

ফিদান বলেন, “টেকসই শান্তির জন্য ইসরাইলকে যুদ্ধবিরতি মেনে চলতে হবে।” সাখনা বলেন, “গাজার মানবিক পরিস্থিতি ভয়াবহ। ইসরাইলের ওপর শক্ত চাপ প্রয়োগ জরুরি।” তিনি জানান, এস্তোনিয়া দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান সমর্থন করে এবং জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিন-সংক্রান্ত প্রস্তাবের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ফিদান বলেন, “শারম আল-শেখ ঘোষণায় স্বাক্ষর করে তুরস্ক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোগান, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বাক্ষর এটিকে ঐতিহাসিক ঘোষণা করেছে।”

তিনি জানান, রাফাহ সীমান্তে তুরস্কের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, এএফএডি ও রেড ক্রিসেন্ট কাজ করছে। ৯০০ টন সহায়তা নিয়ে জাহাজ ১৭ অক্টোবর আল-আরিশ বন্দরে পৌঁছেছে। ফিলিস্তিনি আহতদের চিকিৎসায় তুরস্কে আনার ব্যবস্থা হয়েছে। তিনি বলেন, “গাজার পুনর্গঠনে আমরা সর্বশক্তি নিয়োজিত রাখব। ধৈর্য ও ঐক্যের মাধ্যমে গাজা আবার ঘুরে দাঁড়াবে।”