দিগন্ত সাহিত্য কবিতাবলী

Printed Edition
দিগন্ত সাহিত্য কবিতাবলী
দিগন্ত সাহিত্য কবিতাবলী

মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান

অস্পৃশ্যের ক্রন্দন

আন্ধারপুরে আর খোয়াব দেখি না

একটু চোখের পাতা বুজলেই

নেড়ি কুইত্তারা ঘেউ ঘেউ করে ওঠে

খানিক পরে মুয়াজ্জিনের আজান।

আজকাল বুকের মইধ্যে

কেমন জানি চিন চিন করে,

আমি প্রকৃতির সান্নিধ্য খুঁজি

সে আমাকে বেমালুম ভুলে গেছে।

বন-পাখিরা ধিক্কার জানায়

পিয়ালী বৃক্ষরা অনুশাসন

মানবে না

বৃক্ষরাজি অভিমান করেছে

বন-জঙ্গলের কাব্যে ঐক্যের সুর।

আবহমানকাল থেকে জেগে ওঠা

বাণীশান্তা অরণ্যবিলাস বিকিকিনি

খরায় ধুঁকছে,

তার খরিদেরা এখন পাঁচতারকা হোটেলে।

মানুষরূপী দানবেরা যৎসামান্য আসে

জাহাজ ভর্তি ছোবলীরা

শিকার নিয়ে আসে-

মগ্ন হয়ে থাকে চর্বিত- চর্বণে

পিয়ালী, ম্যানগ্রোভ ইকো রিসোর্ট

খিল খিল হাসে।

বন-জঙ্গল থেকে উঁচু দালানে

মুড়ি-মুটকির লেহান ব্যভিচার,

সভ্যতার ভাঁজে অসভ্যের বিস্ফোরণ

সেখানে আমি এক নীরব দর্শক!


মুহিত চৌধুরী

রুখে দাঁড়াবো

বৃষ্টি হোক, ঝড় হোক, গুলি হোক, আবার রুখে দাঁড়াবো

যেমন দাঁড়ায় ভাঙা সেতুর ধারে কোনো শেষ আলো,

বৃষ্টি নামে, কাঁপে ধানক্ষেত, কাদায় মিশে যায় প্রতিজ্ঞা,

তবু বুকের ভেতর এক নিঃশব্দ আগুন জ্বলে-

এই আগুন মাটির, এই আগুন আমার।

আমি জানি, গুলির শব্দ একদিন থেমে যাবে,

কিন্তু মানুষের মুখের ভিতর লুকিয়ে থাকা

স্বপ্নের ঘ্রাণ- তাকে কে মেরে ফেলতে পারে?

এই ধুলো, এই গন্ধ,

এই দগ্ধ শরীর- এরা সবাই ইতিহাসের সাক্ষী।

যখন রাত্রি নামে, তখনো শুনি

কেউ একজন মিছিলের শেষে বাঁশি বাজায়

বাঁশির ভেতর জেগে ওঠে রণধ্বনি,

তার পর আবার নেমে আসে বৃষ্টি,

রক্তের সঙ্গে মিশে যায় নদীর ধারা।

পথে কাঁটা আছে,

তবু সেই কাঁটাগুলোর ওপর দিয়েই

মানুষ শেখে গেছে হেঁটে চলার কৌশল

আকাশ ভাঙুক, জমিন কাঁপুক,

আমার পদচিহ্ন থাকবে-

যেমন থাকে প্রেমিকার চোখে বিদায়ের নোনা জল।

এক দিন ভাবতাম বারবার ভাবতাম

স্বৈরাচারের লোহার মুঠো খুলে যাবে,

তার নিচে পড়ে থাকবে আমাদের শ্বাস,

আর জন্ম নেবে অসংখ্য ভোরের মশাল।

তুমি কি ভুলে গেছো,

সেই দিনগুলো, যখন গুলির শব্দে

শিশুরাও ভুলে গিয়েছিলো কান্না,

রাস্তায় পড়ে থাকা রক্ত,

যে রক্তে জন্ম হয়েছিল ‘প্রভাত’ শব্দটি,

আজও আমি সেই অক্ষরে জেগে উঠি।

সেই রক্তে ভেজা জায়নামাজে দাঁড়িয়ে

আমি এখনো বলি,

‘বৃষ্টি হোক, ঝড় হোক গুলি হোক,- রুখে দাঁড়াবো।


ফজলুল হক সৈকত

এইখানে কবিতা থাকে

কয়েকটি কবিতা এইখানে আছে

সভাঘরে কোলাহলের ভেতর

মানুষের মৌলিক অবস্থানের পার্থক্য

তৈরি করে দিয়েছে এইসব কবিতার পঙ্ক্তি।

কিছু কবিতা রয়ে গেছে ঠিক এইখানটায়

টেবিলে সাজিয়ে-রাখা মাফিনের পাশে প্রিয়তমের বানানো লালচায়ের ফ্ল্যাক্সের মতন।

কয়েকটি কবিতা এখনো লেখা শেষ হয়নি

কেননা পঙ্ক্তির প্রতীক্ষায় থাকা শব্দগুলো এখনো ঘুরছে মাথার ভেতরে; ঘামেভেজা চুলের গন্ধ পেরিয়ে বেরিয়ে আসতে এখনো খানিকটা পথ বাকি।

কিছু কবিতা লেখা হবে না কোনো দিনই

অফিসে কাজের ফাঁকে কিংবা বিরতিতে কফি অথবা সেই লালচায়ের অন্তরালে ঘাপটি মেরে বসে থাকা কথাগুলো কবিতা হয়ে বের হবে না কখনো।

কিছু কবিতা এইখানে আছে লেকের ধারে

বাগানের নীরব রাস্তায়

মঞ্চে ওঠার ঠিক আগের সময়টায়

অথবা নাম জানতে চাওয়া অচেনা কোনো মানুষের বুকপকেটে; সুগন্ধিমাখা রঙিন রুমালে।

কিছু কবিতা এইখানে থাকে

এইখানে!


মুস্তফা হাবীব

ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম

কেউ রুখতে পারেনি নজরুলের অগ্রযাত্রা

দুঃশাসনের কুয়াশায় আটকাতে পারেনি,

ছন্দপতন ঘটাতে পারেনি জীবনের অনিরুদ্ধ প্রান্তরে,

একাই দিয়েছে পিষে পথের দুপাশে পুঁতে রাখা মাইন

কৃষ্ণগহ্বর অতিক্রম করে ছুঁয়েছে পূর্ণিমার আলো।

খুব সহজ ছিল না পথপরিক্রমা

আগন্তুক বারবার দরজায় কড়া নেড়েছে

বেলা অবেলায় সত্য সন্ধানে প্রত্যয়ী ছিল বলেই

পোশাকি চেতনাবাজ পীর পীরালির সঙ্গে করেনি সন্ধি।

অমা অন্ধকারে আবৃত আকাশ দেখে কাঁপেনি বুক

প্রতিকূল স্রোতেও দাঁড় বেয়ে চলেছে একা

আগুনমুখা নদীর ঢেউ তাকে পরাস্ত করতে পারেনি

আপন খেয়ালে সাঁতার দিয়েছে অকূল পাথারে।

নজরুলকে চিনেছি আমি

তাই অভয়ারণ্য চেয়ে দুুচোখে বিপ্লব বুনেছি

ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম রুখবই সম্মুখের দুরন্ত আঁধার

কারো সাধ্য নেই আমাকে হারাবার।


গোলাম রব্বানী টুপুল

সাঁঝের গোলাপ

আমি ঘুমোতে চেয়েছিলাম সাঁঝের গোলাপের মতো

তোমরা ঘুমোতে দিলে না বলেই, মাটির বিছান আজ হু হু করে কাঁদে, এলোমেলো বৈরি বাতাস নাচে বুঝি

বাঁশের পাতায়, শিমুলের ডালে। যে হুতুমপেঁচা ডাকে ভুতুড়ে কান্নায়, রাতের নিস্তব্ধতা সাঙ্গ করে যে কণ্ঠ ভোরের আলোয় মিলিয়ে যায় সে কি গান নাকি আর্তনাদ!

যে শালিকের ঝাঁক এখনো জটলা করে যমুনার পাড়ে

যে শেয়ালের দল হুটোপুটি খায় চেনা কৃষকের ক্ষেতে

অম্লান স্মৃতির মিনার, জমে আছে থরে থরে বিষণœতা।

অপার স্নিগ্ধতায় নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছি, বুঝিয়েছি

এই মানবশূন্য পৃথিবীতে মানুষ খোঁজাই বড় কঠিন।

মহাকালের পথে তোমার যে আগমন-সঙ্গীত বেজেছিল

মমতার উচ্ছ্বাসে, তা আজ ম্লান। বুঝি এমনি নিঃসঙ্গ বেদনা নিয়েই পৃথিবীকে দেখাতে হয় বিদায় চিহ্ন, মাটিই তার পরম প্রিয়কে কাছে টানে অনন্তের পথে।