হারানো মূলধনের ৬ হাজার কোটি টাকা ফিরে পেল ডিএসই

এল আর গ্লোবালের ৬ মিউচুয়াল ফান্ডের লেনদেন স্থগিত

Printed Edition

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক

সাম্প্রতিক সময়ে টানা দরপতনের ফলে পুঁজিবাজারগুলো যে পরিমাণ মূলধন হারায় গত সপ্তাহে (১৯ অক্টোবর-২৩ অক্টোবর) তার একটি অংশ ফিরে পেয়েছে। প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এ সময় ৬ হাজার কোটি টাকা মূলধন ফিরে পায়। এর আগের সপ্তাহে পুঁজিবাজারটি ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি মূলধন হারিয়েছিল। ৬ লাখ ৯৯ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা নিয়ে সপ্তাহ শুরু করা পুঁজিবাজারটির মূলধন বৃহস্পতিবার পৌঁছে যায় ৭ লাখ ৫ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকায়। পাঁচ কর্মদিবসের তিনটিতে সূচকের উন্নতি ঘটলে এ মূলধন ফিরে পায় ডিএসই।

গত সপ্তাহের বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায় শুরুতে বড় ধরনের হোঁচট খেলেও পরদিনই তা সামলে নেয়। পরের দিনগুলোতে বিক্রয়চাপ কিছুটা হ্রাস পেলে মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় জায়গা করে নেয় লেনদেন হওয়া বেশির ভাগ কোম্পানি অন্যান্য সিকিউরিটিজ। এ তালিকায় ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বীমা এ তিনটি বড় মূলধনী খাত জায়গা করে নিলে বাজার মূলধনে এ উন্নতি ঘটে। পাশাপাশি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের মতো কিছু বড় মূলধনের কোম্পানির লভ্যাংশ ঘোষণাপরবর্তী মূল্যবৃদ্ধিও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।

বিদায়ী সপ্তাহে ডিএসইর প্রধান সূচকটির উন্নতি ঘটে ৩০ দশমিক ৪৭ পয়েন্ট। রোববার ৫ হাজার ১১৯ দশমিক ৪২ পয়েন্ট থেকে সপ্তাহ শুরু করা সূচকটি সপ্তাহ শেষে পৌঁছে যায় ৫ হাজার ১৪৯ দশমিক ৮৯ পয়েন্টে। একই সময় ডিএসইর অন্য দু’টি সূচকের উন্নতি ঘটে যথাক্রমে ৩০ দশমিক ১৮ ও ২ দশমিক ২৬ পয়েন্ট।

সূচকের উন্নতি ঘটলেও এ সপ্তাহে ডিএসইর লেনদেনের অবনতি ঘটে। মোট লেনদেন ছিল ২ হাজার ১৩৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা, যা আগের সপ্তাহ অপেক্ষা ১৮ দশমিক ০৯ শতাংশ কম। আগের সপ্তাহে বাজারটির লেনদেন ছিল ২ হাজার ৬১১ কোটি ১১ লাখ টাকা। বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন সূচকের টানা অবনতি কাটিয়ে সপ্তাহের শেষ দিকে সূচকের উন্নতি ঘটলেও এ সময় বিনিয়োগকারীদের সতর্ক আচরণই লেনদেন হ্রাস পাওয়ার কারণ।

এ দিকে বিনিয়োগের নামে মিউচুয়াল ফান্ডের অর্থ অপব্যবহারের মাধ্যমে আত্মসাতের ঘটনায় বড় ধরনের শাস্তির মুখে পড়েছে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। ফান্ড ম্যানেজার হিসেবে ছয়টি ফান্ড থেকে এল আর গ্লোবালকে অপসারণের পর ছয়টি মিউচুয়াল ফান্ডের লেনদেন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। লেনদেন স্থগিত করা ফান্ডগুলো হলো ডিবিএইচ ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, গ্রিন ডেল্টা মিউচুয়াল ফান্ড, এআইবিএল ফার্স্ট ইসলামিক মিউচুয়াল ফান্ড, এমবিএল ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ মিউচুয়াল ফান্ড ওয়ান এবং এনসিসিবিএল মিউচুয়াল ফান্ড-১। এই ফান্ডগুলোর ট্রাস্টি বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি (বিজিআইসি)।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) জারি করা নোটিশে বলা হয়েছে, বিজিআইসি ফান্ডগুলোর ব্যাংক ও ব্রোকারেজ অ্যাকাউন্ট থেকে সব ধরনের ডেবিট লেনদেন, অনলাইন ট্রান্সফার ও ট্রেডিং কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। ট্রাস্টি জানিয়েছে, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, কারণ তাদের অর্থ ‘গুরুতর ঝুঁকিতে’ পড়েছে।

জানা যায়, বিএসইসির তদন্তে উঠে এসেছে, এলআর গ্লোবাল ছয়টি ফান্ডের মোট ৬৯ কোটি টাকার বেশি অর্থ অপব্যবহার করেছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে ওটিসি মার্কেটে তালিকাভুক্ত বন্ধ ও লোকসানে থাকা পদ্মা প্রিন্টার্সের ৫১ শতাংশ শেয়ার অস্বাভাবিক উচ্চ দামে কিনে প্রায় ২৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। পরবর্তীতে ফান্ডগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে নতুন পর্ষদ গঠনের মাধ্যমে কোম্পানিটির নাম পরিবর্তন করে কোয়েস্ট বিডিসি লিমিটেড রাখা হয়। এরপর দ্বিতীয় ধাপে নতুন শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধি করে ওই একই কোম্পানিতে আরো ৪৫ কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘটনা শনাক্ত হয়। বিএসইসি বলেছে, এসব বিনিয়োগ ‘স্পষ্টভাবে উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ এবং বিনিয়োগকারীদের মূলধন নষ্টের সমান।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ইতোমধ্যে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। এলআর গ্লোবালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রিয়াজ ইসলামকে আজীবনের জন্য পুঁজিবাজার সম্পর্কিত সব কার্যক্রম থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি কোম্পানিটিকে সুদসহ প্রায় ৯০ কোটি টাকা ৩০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ছয়টি ফান্ডে ফেরত দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টাকা ফেরত না দিলে রিয়াজ ইসলামকে ৯৮ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হবে। এ ছাড়া কোম্পানির পরিচালক জর্জ এম স্টক এবং রেজাউর রহমান সোহাগসহ মোট ছয় জনকে ৬ কোটি টাকার পাশাপাশি ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান বিজিআইসিকে ৩ কোটি টাকা জরিমাননা করা হয়।।

গত সপ্তাহে ডিএসইর লেনদেনের শীর্ষে ছিল ওসুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানি ওরিয়ন ইনফিউশন। এ সময় প্রতিদিন গড়ে কোম্পানিটির ২১ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে, যা ছিল ডিএসইর মোট লেনদেনের ৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ। প্রতিদিন গড়ে ১৯ কোটি ৪ লাখ টাকা লেনদেন করে এ তালিকার দ্বিতীয় কোম্পানি ছিল প্রকৌশল খাতের ডমিনেজ স্টিল বিল্ডিং সিস্টেমস। ডিএসইর মোট লেনদেনের ৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ দখলে রাখে কোম্পানিটি। এ সময় ডিএসইর শীর্ষ ১০ কোম্পানির অন্যগুলো ছিল যথাক্রমে সামিট অ্যালাইয়েন্স পোর্ট, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ, প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স, রবি আজিয়াটা, সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও সোনালি পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস।