জুলাইয়ের আগুনে

Printed Edition
জুলাইয়ের আগুনে
জুলাইয়ের আগুনে

মোহাম্মদ আবুল হোসেন

ঢাকার আকাশে তখনো সন্ধ্যা নামেনি। ধুলো-ধোঁয়ায় ভরপুর চারপাশ। মানুষ ঘরে ফেরার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। টি-স্টলগুলোতে কাপে কাপে ঠন ঠন শব্দ। অভিজাত এলাকায় রঙিন আলোর নিচে কপোত-কপোতী। চোখে চোখ রেখে তারা কথা বলছে। হয়তো প্রেমের গল্প, হয়তো যাপিত জীবনের গল্প, নয়তো কিভাবে তারা বিয়ে করবে সেই গল্প। এমনো হতে পারে তারা আরো কতগুলো বছর চুটিয়ে প্রেম করে নিতে চায় বিয়ের আগে। সামান্য বেতনের কোনো মানুষ হয়তো, দ্বিতীয় কাজের উদ্দেশে ছুটছে হন্তদন্ত হয়ে। গরমে ঘেমে তার শরীর একাকার। ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন রিকশাচালকরাও। জুলাই মাসটাও যেন ক্লান্ত। এরই মাঝে শহরের রাস্তাগুলোয় অস্থিরতা। চারপাশে এখানে ওখানে শাহবাগে, সায়েন্স ল্যাব, রামপুরা, গাজীপুর, গাবতলী, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ীতে ব্যারিকেড, মিছিল, স্লোগান- ‘গণতন্ত্র চাই, ভোটাধিকার চাই।’ এরই মাঝে হঠাৎ কোথাও কাঁদানে গ্যাসে অন্ধকার। কোথাও গুলিতে লুটিয়ে পড়েছে কোনো বাংলা মায়ের দামাল ছেলে। কতশত মানুষ নিঃশেষ হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় গুলির আওয়াজ। মানুষের দিগি¦দিক ছুটোছুটি। এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেও নাজিফার মনে কেবল একটিই চিন্তা- তানিম কোথায়?

তানিম, ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেম, ইতিহাস বিভাগের সবার চেনা রোমান্টিক বয়। তানিম ভালোবাসে বিপ্লবকে, আন্দোলনকে, ভালোবাসে ইতিহাসকে- আর সব কিছুর ওপরে ভালোবাসে নাজিফাকে। পাবলিক লাইব্রেরি, টিএসসি, আবার কখনো তারা দেখা করে শাহবাগের গ্রন্থকুঞ্জে। হাতে থাকে রবীন্দ্রনাথ কিংবা হুমায়ূনের বই। চোখে আগামীর স্বপ্ন।

‘নাজু, জানো? এই দেশে যতবার মানুষ রাস্তায় নেমেছে, ততবার নতুন কিছু জন্ম নিয়েছে’- তানিম বলে নাজিফাকে। নাজিফাকে অনেক আদর করে নাজু নামে ডাকে তানিম। সব পুরুষই এমনি করে তার ভালোবাসাকে এমনই ভালোবাসাময় নাম দিয়ে থাকে।

তানিমের চোখের দিকে তাকিয়ে নাজিফা বলে- আর প্রেম? সেটিও কি রাস্তায় জন্মায়, নাকি কোনো শীতল কফির কাপের পাশে?

তানিম হাসে, বলে- প্রেমও এক ধরনের আন্দোলন, জানো? নিজেকে ভেঙে আরেকজনের জন্য তৈরি হওয়া। প্রেম মানুষের জীবন পাল্টে দেয়। ভালোবাসাকে পাওয়ার জন্য একজন পুরুষ নিজেকে বিসর্জন দেয়। সে তার প্রেয়সীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এতেই পূর্ণতা পায় প্রেম।

তানিমের কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল নাজিফা। তার চোখের ওপর এক নতুন পৃথিবী আঁকা হয়ে যায়। সেই ছবিতে সে একটি আকাশ দেখে, একটি পাহাড় দেখে, সমুদ্র দেখে। তার মাঝে আবিষ্কার করে নাজু আর তানিম নামের একজোড়া মানব-মানবীকে। তারা স্বপ্ন দেখছে। তারা ছবি আঁকছে। জীবনের ছবি।

আকাশ দেখতে চাও? আচমকা জানতে চায় নাজিফা।

সংক্ষিপ্ত উত্তর- হুঁ।

পাহাড়?

হুঁ।

সমুদ্র?

সব। সব দেখতে চাই আমি। আর তখন তুমি আমার হাত ধরে থাকবে। প্রকৃতি থেকে রঙ নিয়ে তোমাকে সাজাব। তোমাকে নিয়ে গান গাইব। তুমি হবে আমার ভালোবাসার আয়না।

সত্যি?

সত্যি, নাজু। আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি।

২২ জুলাই। ভোর ৫টা। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় তখন ছাত্র-জনতা একসাথে এক অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তানিমের শরীরেও কেমন যেন এক উন্মাদনা শুরু হয়ে যায়। এই যে শহর জেগে আছে, এই যে মানুষ মরছে, এর মাঝে সে কি করে ঘরে বসে থাকে! তাকে এই আন্দোলনে যোগ দিতেই হবে। সেই রাতেই নাজিফাকে একটি গোলাপ দিয়েছিল তানিম। বলেছিল, তোমার জন্য আমার সব লড়াই। এ জন্যই কাল আমাকে যেতে হবে রাস্তায়। আমাকে আন্দোলন করতে হবে। আমার সারা জীবনের স্বপ্ন বিসিএস ক্যাডার হবো। সরকারি চাকরি করব। তারপর আমাদের বিয়ে হবে। তুমি হবে নতুন বউ। তোমার দুটো হাত মেহেদিতে রাঙানো থাকবে। লাজুক সেই বউ আর আজকের নাজুর মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকবে।

কেমন?

এই যেমন এখন চুটিয়ে প্রেম করছ, যখন যেখানে খুশি যাচ্ছ, মুক্ত বলাকার মতো জীবন।

তখনো তো থাকবে।

হ্যাঁ, থাকবে। তবে সে সময়ে একটি সংসারে দায় কাঁধে আসবে। তখন তুমি এমনিতেই আস্তে আস্তে বদলে যাবে।

না আমার ভালোবাসা বদলাবে না।

আমি তো সেটি বলিনি। আমি বলেছি বিয়ের পরে মেয়েদের সংসারের দায়িত্ব আসে কাঁধে। তখন সে একটু অন্যরকম হয়ে যায়।

আমি জানি তানিম।

হ্যাঁ, নাজু। আমি জানি আমার ভালোবাসা আমার মতোই।

ওই যে বললে আন্দোলন?

হ্যাঁ, আন্দোলনে আমাকে যেতেই হবে। কারণ, আমাদের সব অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। এখন আর ঘরে বসে থাকার সময় নেই। আমাকে সকালে যেতেই হবে আন্দোলনে।

নাজিফা কাঁদে, বলে- তুমি যদি ফিরে না আসো?

তবে আমার নামটা রেখো তোমার চোখে, তুমি যেদিকেই তাকাবে, সেদিকেই আমি থাকব। এই শহরের ধুলোবালি, মানুষের মমত্ববোধ, ভালোবাসার দিকে তাকালে দেখবে আমাকে। বলেই চোখ মোছে তানিম।

তানিম সোজা চলে আসে শাহবাগ মোড়ে ব্যারিকেডে দাঁড়ায়। ক্রমশ উত্তপ্ত হতে থাকে বিক্ষোভ। বিনা উসকানিতে তাদের দিকে বুলেট ছোড়ে পুলিশ। অমনি ছোটাছুটি, হুড়োহুড়ি। মুহূর্তেই তানিম চিৎকার করে বলে- আমার দেশের জন্য, আমার ভালোবাসার জন্য আমি দাঁড়িয়েছি। এ আমার অধিকার।

এদিন অসংখ্যা রাবার-বুলেট বিদ্ধ করে বহু ছাত্রের, তরুণের বুক। তাদেরকে কাঁধে করে, রিকশায় করে, সাংবাদিকের মোটরসাইকেলে করে নিয়ে সবাই ছুটছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। এ খবর পাওয়ার পর তানিমের ফোনে কল দেয় নাজিফা। ফোন রিং হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। কেউ ধরে না। পরিচিতজনদের ফোন করে সে। কেউ তানিমের খবর দিতে পারে না। উপায় না দেখে নাজিফা ঢাকা মেডিক্যালের গেটের সামনে ছুটে যায়। প্রতিটি অ্যাম্বুলেন্সে খোঁজে তানিমের মুখ। একটির পর একটি আহত দেহ, রক্তে ভেজা শার্ট, চোখে আতঙ্ক। কোথাও নেই তানিম।

শেষমেশ, বিকেল ৪টা। এক সাংবাদিকের তোলা ছবিতে দেখা গেল- তানিম পড়ে আছে মাটিতে, চোখ বন্ধ, মুখে অদ্ভুত শান্তি। তানিম মারা যায়নি। তবে পড়ে আছে কোমায়- মাথায় রাবার বুলেটের গভীর আঘাত।

নাজিফা ছুটে যায় হাসপাতালে। নার্স ফিসফিস করে বলে- জ্ঞান ফেরেনি। ডাক্তাররা বলেছেন, ওর জন্য প্রার্থনা করতে।

তিন দিন, তিন রাত নাজিফা প্রার্থনা করে। তানিমের প্রিয় কবিতা পড়ে, কানে কানে বলে- ফিরে এসো, দেখো তোমার আন্দোলন সফল হবে। কিন্তু তানিম ফের চোখ খোলে না।

আগস্ট চলে আসে। শুরুতেই তাদের আন্দোলন নিয়ে উপহাস করেন বড় বড় ব্যক্তি। তাদের হাতে ক্ষমতা আছে। তারা যা খুশি তা-ই বলেন। কিন্তু আস্তে আস্তে পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে তা বুঝতে পারেন না। তারা বন্দুকের গুলি, হেলিকপ্টার থেকে গুলির ওপর ভর করে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। ঘটে তার উল্টো। রাজপথ আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ঢাকাসহ পুরো দেশ যেন জ্বলতে থাকে। তার মাঝেই তানিম এক বিকেলে চিরবিদায় নেয়। পুরো আকাশ ভেঙে পড়ে নাজিফার। চিৎকার করে কাঁদে সে। সিদ্ধান্ত নেয় তানিমের স্বপ্নকে সে-ই বাস্তবে রূপ দেবে। এরই মধ্যে রংপুরের আবু সাঈদের হত্যার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে নেটদুনিয়ায়। জেগে ওঠে দেশ। জেগে ওঠে শিশু থেকে বৃদ্ধ। বাঁধভাঙা জোয়ারের পানিতে ভেসে যায় সব। আন্দোলন জেতে। মানুষ বুক ফুলিয়ে নিঃশ্বাস নেয়।

একদিন তানিমের ডায়েরিতে একটি লেখা পায় নাজিফা-

নাজু, যদি আমি না থাকি, তাহলে এই শহরের আলো তোমার চোখে রেখো। আমার বিপ্লব অসমাপ্ত হলেও, তোমার ভালোবাসা ছিল সম্পূর্ণ। তুমি মুক্ত থাকো, ভালোবাসো কাউকে যাকে নিয়ে তোমার নিজস্ব ইতিহাস লিখতে পারো।

শেষে একটি গোলাপের শুকনো পাপড়ি।

নাজিফা শেষবার তানিমের গালে হাত রেখে বলে- তুমি ছিলে আমার জুলাইয়ের আগুন। আমি থাকব তোমার শ্রাবণের বৃষ্টি হয়ে।

তারপর সে শুরু করে লেখালেখি। একদিন তার গল্প ছাপা হয়- ‘জুলাইয়ের আগুনে’। নামটা সে রেখেছিল নিজেদের ভালোবাসার নামে।

আন্দোলনের এক বছর পর- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার চত্বর। বিকেল বেলা, হালকা বাতাস।

নাজিফা এখন লেখক। ‘জুলাইয়ের আগুনে’ গল্পটি তাকে দিয়েছে পরিচিতি, দিয়েছে পাঠকের ভালোবাসা। কিন্তু তানিমের না ফেরার যন্ত্রণা তাকে নিঃশেষ করে ফেলেনি; বরং নতুন করে তৈরি করেছে।

প্রতিটি সাক্ষাৎকারে কেউ না কেউ জিজ্ঞেস করে- এই গল্পের তানিম কি বাস্তব চরিত্র?

সে হেসে বলে, তানিম এই শহরেরই সন্তান, আপনার-আমার প্রতিবেশী, প্রেমিক, এক যোদ্ধা।

নতুন মানুষ আসে নাজিফার জীবনে- রিফাত। গণমাধ্যমকর্মী। তবে রিফাত কখনো তানিমের জায়গা নিতে চায় না। সে শুধু পাশে থাকে। একদিন বলে, তোমার অতীত আমি মুছে দিতে পারব না, চাইও না। আমি চাই, তোমার নতুন গল্পে একটি পৃষ্ঠা আমি লিখতে।

নাজিফা ধীরে ধীরে বলে, তানিম ছিল আমার আগুন, তুমি হতে পারো আমার বৃষ্টি।