বিশেষ সংবাদদাতা
রাজনৈতিক ইতিহাসে নজিরবিহীনভাবে ভারতে পালিয়ে যাওয়া পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের বিপুল সম্পদ এবং অর্থপাচারের তদন্ত চলছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে দুর্নীতি, কর ফাঁকি ও বিদেশে পাচার হওয়া অর্থের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার নামে বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা লকার ও অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে। ইতোমধ্যে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে দু’টি ব্যাংকে তিনটি লকারের সন্ধান পাওয়া গেছে। পাশাপাশি ব্যাংক দু’টিতে হাসিনার নামে থাকা চারটি অ্যাকাউন্টে ২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। এসব অর্থ জব্দ করা হয়েছে। অন্য ব্যাংকগুলোতেও একইভাবে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
এর আগে বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) যৌথ নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত দল বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানে অনুসন্ধান করে হাসিনা, বোন রেহানা ও তাদের ছেলেমেয়েদের নামে ১২৪টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৬৩৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। রাজউকের ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা মূল্যের ৬০ কাঠা প্লট পাওয়া গেছে। ৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকার ১০ শতাংশ জমিসহ ৮টি ফ্ল্যাট পাওয়া গেছে। এসব টাকা ও প্লট-ফ্ল্যাট ইতোমধ্যে অবরুদ্ধ বা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
অগ্রণী ও পূবালী ব্যাংকে লকার জব্দ : সাম্প্রতিক অভিযানে অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান শাখায় শেখ হাসিনার নামে থাকা দু’টি লকার (নম্বর ৭৫১ ও ৭৫৩) জব্দ করেছে সিআইসি। একই শাখায় তার নামে দু’টি অ্যাকাউন্টে ১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি সেভিংস অ্যাকাউন্টে ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা এবং অন্যটিতে ১৫ লাখ টাকার এফডিআর রয়েছে। এর আগে গত ১০ সেপ্টেম্বর পূবালী ব্যাংকের মতিঝিল করপোরেট শাখায় শেখ হাসিনার ১২৮ নম্বর লকার জব্দ করা হয়। সেখানে দু’টি অ্যাকাউন্ট পাওয়া যায়- একটিতে ১২ লাখ টাকার এফডিআর এবং অন্যটিতে ৪৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ পূবালী ব্যাংক থেকে মোট ৫৬ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। এই দু’টি অভিযানের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার চারটি ব্যাংক হিসাব থেকে প্রায় ২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া লকারগুলোর ভেতরে স্বর্ণালঙ্কার, নথি ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল থাকতে পারে বলে ধারণা করছে কর্তৃপক্ষ।
বিপুল সম্পদের সন্ধান : এনবিআর ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের তথ্যানুসারে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে দেশের ভেতরে ও বাইরে বিপুল সম্পদ রয়েছে। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে তাদের নামে ১২৪টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রায় ৬৩৫ কোটি টাকার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এর পাশাপাশি রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে রাজউকের প্লট, ফ্ল্যাট ও জমি জব্দ করা হয়েছে। বিশেষ করে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা মূল্যের ৬০ কাঠা প্লট এবং প্রায় ৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকার জমি ও ফ্ল্যাট বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের তদন্ত অনুযায়ী, শেখ হাসিনা পরিবারের সম্পদ শুধু দেশেই সীমাবদ্ধ নয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং এবং কেম্যান দ্বীপপুঞ্জে বিপুল অর্থ ও সম্পত্তির খোঁজ পাওয়া গেছে। মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রাশিয়া থেকে আসা অস্বাভাবিক পরিমাণ অর্থ জমা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ-সংক্রান্ত দু’টি গোয়েন্দা প্রতিবেদন ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা দেয়া হয়েছে।
পাচারকৃত অর্থ ফেরাতে বিশেষ আইন : অন্তর্বর্তী সরকার পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ১১ সদস্যের একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। এই টাস্কফোর্সের দায়িত্ব পাচারকৃত অর্থ চিহ্নিত করে বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনা। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে সাম্প্রতিক বৈঠকে বিশেষ আইন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা অধ্যাদেশ আকারে আগামী সপ্তাহে জারি হতে পারে। বিদেশে থাকা অর্থ ফেরাতে আন্তর্জাতিক ল ফার্মের সহযোগিতা নেয়া হবে। এজন্য প্রাথমিকভাবে ২০০ ল ফার্মের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে এবং এরমধ্য থেকে ৩০টির সাথে চুক্তি করার পরিকল্পনা রয়েছে।
অন্য প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধেও অভিযান : শুধু শেখ হাসিনা নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যান্য মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু হয়েছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাবেদের নাম ইতোমধ্যে আলোচনায় এসেছে। সরকারি যৌথ তদন্তে জানা গেছে, তার এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্টদের নামে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২২৮টি, যুক্তরাষ্ট্রে ৭টি এবং যুক্তরাজ্যে ৩৪৩টি সম্পত্তি রয়েছে। এসব সম্পদের বিপরীতে এনবিআর অন্তত ১১টি কর ফাঁকির মামলার তদন্ত করছে। এ ছাড়া ৩৯টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও ১০২ কোটি টাকার শেয়ার অবরুদ্ধ করা হয়েছে। বর্তমানে ৩৯টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রায় ৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা জমা আছে। এসব অর্থ জব্দ করা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্টদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
পাচারকৃত অর্থের অগ্রাধিকারমূলক মামলা : সরকার বর্তমানে ১১টি অগ্রাধিকারমূলক মামলার মাধ্যমে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা করছে। এসব মামলার আওতায় ১ হাজার ৩৭৪টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৬১৪ কোটি টাকা এবং ১৮৮টি বিও (বিনিয়োগ হিসাব)-তে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি শেয়ার অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৮৪ অভিযুক্ত ব্যক্তির বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করে এনবিআর জানিয়েছে, শেখ হাসিনার পরিবারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সন্তানের একটি মাত্র সেমিস্টারের টিউশন ফি হিসেবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বিদেশে পাঠানো হয়েছে। এটি অর্থপাচারের এক অভিনব কৌশল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের এই অভিযান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নতুন মোড় তৈরি করেছে। এতদিন যেসব দুর্নীতি, কর ফাঁকি ও অর্থপাচারের অভিযোগ রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে চাপা ছিল, সেগুলো এখন প্রকাশ্যে আসছে। শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের বিপুল সম্পদের খোঁজ পাওয়া যেমন দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরছে, তেমনি পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক আইনি জটিলতা, দীর্ঘসূত্রতা ও রাজনৈতিক চাপ এই প্রক্রিয়াকে কঠিন করে তুলতে পারে। তবুও বর্তমান সরকারের দৃঢ় অবস্থান ইঙ্গিত দিচ্ছে, এই অভিযান কেবল শুরু- এটি আরো বিস্তৃত হবে এবং দুর্নীতিবাজদের জবাবদিহির আওতায় আনতে বড় ভূমিকা রাখবে।



