হাটহাজারীতে সুন্নি-কওমি সংঘর্ষে ১৮০ জন আহত আশঙ্কাজনক ২০ জন

এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি

Printed Edition

হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি

চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে সুন্নি-কওমি সংঘর্ষে ১৮০ জন আহত হয়েছে, আশঙ্কাজনক ২০ জনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল চমেকে ভর্তি করা হয়েছে। আহত বেশির ভাগ কওমিপন্থী মাদরাসার ছাত্র বলে জানা গেছে। শনিবার (সেপ্টেম্বর) জুলুসে যাওয়ার সময় হাটহাজারী মাদরাসার সামনে আরিয়ান ইব্রাহীম (২০) নামের এক যুবক মধ্যমা আঙুল দেখিয়ে অশালীন অঙ্গভঙ্গি করে ফেসবুকে পোস্ট দেয়া ও সন্ধ্যায় সে আরিয়ান ইব্রাহীমকে পুলিশ গ্রেফতার করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সুন্নিপন্থী ও কওমিদের সাথে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন গুরুতর আহত আবু তাহের (১৬) ও হাসান মারুফ (১৭) দু’জনের পরিচয় জানা গেছে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রাত ১০টায় স্থানীয় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি এবং গভীর রাতে সেনা মোতায়েনের পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।

জানা গেছে, শনিবার ঈদে মিলাদুন্নবীর জুলুসে যাওয়ার সময় দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার সামনে এসে মাদরাসাকে লক্ষ্য করে এক যুবক আঙুল উঁচিয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করার জের ধরে চাপা উত্তেজনা চলছিল দিনভর। আরিয়ান ইব্রাহীম নামের এ যুবক ফেসবুক আইডিতে নিজেকে ফটিকছড়ি পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি পরিচয় দেয়। বিকেলে ফটিকছড়ি উপজেলা ছাত্রদল আরিয়ান ছাত্রদলের কেউ নয় বলে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়।

কওমি ছাত্রসমাজ তাকে গ্রেফতারের দাবি তুলে হাটহাজারী ও ফটিকছড়ির মাদরাসাগুলোতে আন্দোলনের শুরু করে। এ দাবির প্রেক্ষিতে শনিবার (৬ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা ৭টার দিকে জসনে জুলুস থেকে ফেরার পথে ফটিকছড়ি পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের শফিকিয়া দরবার শরিফ এলাকা থেকে আরিয়ানকে আটক করা হয়। আরিয়ান ইব্রাহীম ওই এলাকার মৃত মো: মুছার ছেলে বলে জানা গেছে।

কওমি মাদরাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের দাবি আরিয়ান ইব্রাহীমকে গ্রেফতারের কারণে উত্তেজিত হয়ে সন্ধ্যায় জুলুস থেকে যাওয়ার সময় সুন্নিপন্থীরা ট্রাক বাস থেকে নেমে হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ডে করেকজন কওমি মাদরাসার ছাত্রকে মরধর করে আহত করে। আবার সুন্নিপন্থীদের দাবি জুলুস থেকে ফেরত সুন্নিপন্থীদের বিভিন্ন বাসে কওমি মতাদর্শের লোকজন হামলা করার পর সুন্নিপন্থীরাও সংঘবদ্ধ হয়ে পাল্টা হামলা চালায়। সংঘর্ষের ঘটনায় উভয়পক্ষের অন্তত ১৮০ জন আহত হয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় দেড়শতাধিক আহতকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং গুরুতর আহত ২০ জনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসা দেয়ার জন্য পাঠানো হয়েছে বলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ফেসবুকে পোস্ট দেয়া আরিয়ানকে গ্রেফতারের এ খবর ছড়িয়ে পড়লে হাটহাজারী বাসস্টেশনসহ চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়কের এগারমাইল, হাটহাজারী বাজার, মিরেরহাট, মুন্সী মসজিদ, চারিয়া, মুহুরীরহাট বটতল, নাজিরহাটের ঝংকার মোড়ের বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় পথে ঘাটে কওমিপন্থীদের ওপর সুন্নিপন্থীরা বিচ্ছিন্নভাবে হামলা শুরু করে।

সন্ধ্যা ৭টার পর থেকে যা সঙ্ঘবদ্ধ হামলা পাল্টা হামলায় রূপ নেয়। রাতে গ্রামের সুন্নিপন্থী পরিচয়ে লোকজন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। এ সময় তারা বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়।

এ দিকে হাটহাজারী পৌর এলাকার বাসস্টেশন থেকে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়ক অবরোধ করে রাখে দারুল উলুম মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। এর ফলে রাত ১১টা পর্যন্ত ওই মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাটহাজারী সার্কেল) কাজী তারেক আজিজ জানান, ঘটনার মূল হোতা আরিয়ানকে পুলিশ আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নিয়েছে। পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।

এ দিকে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে জনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন এ নির্দেশনা জারি করেন।

১৪৪ ধারার আওতায় পৌরসভার মিরেরহাট থেকে এগারো মাইল সাবস্টেশন পর্যন্ত এবং উপজেলা গেট থেকে কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশ ও সংলগ্ন এলাকায় সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ, মিছিল, গণজমায়েত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে। একইসাথে বিস্ফোরক দ্রব্য, আগ্নেয়াস্ত্র বা দেশীয় অস্ত্র বহন এবং পাঁচজনের বেশি মানুষের একত্রিত হওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

আদেশ কার্যকর রাখতে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জানানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

হাটহাজারী মাদরাসায় হামলার ঘটনায় চট্টগ্রাম মহানগরী জামায়াতের নিন্দা

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে মসজিদ ও কওমি মাদরাসার মর্যাদা ক্ষুণœ করে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে শতাধিক ছাত্রকে আহত করার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য ও চট্টগ্রাম মহানগরী জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম এবং মহানগরী সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মুহাম্মদ নুরুল আমিন।

বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, গত ৬ সেপ্টেম্বর শনিবার রাত ৮টার দিকে ঈদে মিলাদুন্নবী সা: উপলক্ষে আয়োজিত জসনে জুলুসের একটি র‌্যালি হাটহাজারী মাদরাসার সামনে পৌঁছালে এক যুবক মসজিদ ও মাদরাসার দিকে অশোভন অঙ্গভঙ্গি করে এবং তা ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ ছাত্ররা প্রতিবাদ জানালে সন্ত্রাসীরা তাদের ওপর নৃশংস হামলা চালায়, এতে শতাধিক ছাত্র গুরুতর আহত হয়।

নেতৃবৃন্দ বলেন, দেশের প্রাচীনতম ও বৃহত্তম দ্বীনি প্রতিষ্ঠান হাটহাজারী মাদরাসায় এ ধরনের বর্বরোচিত হামলা সুস্পষ্টভাবে একটি ষড়যন্ত্রের অংশ। মসজিদ ও মাদরাসা মুসলমানদের ঈমান-আকিদার সাথে সম্পৃক্ত পবিত্র স্থান; এগুলোকে অবমাননা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, ইসলাম শান্তি, সংযম ও সহনশীলতার শিক্ষা দেয়। অথচ এ ধরনের হামলা সমাজে বিভাজন ও সহিংসতা উসকে দেয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহনশীলতার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান সম্ভব।

নেতৃবৃন্দ আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন এবং এই ঘটনায় জড়িত সন্ত্রাসীদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের জন্য প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানান। একই সাথে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দায়িত্বশীল আচরণ বজায় রাখা এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান।

সন্ত্রাসী হামলার তীব্র প্রতিবাদ খেলাফত মজলিসের : গত শনিবার রাতে ঈদে মিলাদুন্নবী সা: উপলক্ষে আয়োজিত র‌্যালি পরবর্তীতে ঐতিহ্যবাহী হাটহাজারী বড় মাদরাসায় সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ ও মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের।

এক বিবৃতিতে নেতৃদ্বয় বলেন, সুন্নি নামধারী কিছু সন্ত্রাসী কর্তৃক দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার ছাত্রদের ওপর হামলার ঘটনায় দেড় শতাধিক মাদরাসা ছাত্র আহত হয়। এর মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর। সুন্নি মতাদর্শীদের আয়োজিত জসনে জুলুসে অংশগ্রহণকারী এক যুবক কর্তৃক ফেসবুকে দেয়া একটি ছবিসহ উসকানিমূলক পোস্টের জের ধরে যে ভয়াবহ হামলা ও রক্তাক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রশাসন তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আমরা ওই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।

প্রশাসন উসকানিদাতাকে গ্রেফতার করলেও আমরা সন্ত্রাসী সবাইকে অবিলম্বে গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।