বিশেষ আদেশে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন চায় জামায়াত

আমাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে নিশ্চিত থাকতে পারেন : প্রধান উপদেষ্টা

Printed Edition
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো: তাহেরের নেতৃত্বে জামায়াত নেতারা বৈঠকে অংশ নেন : নয়া দিগন্ত
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো: তাহেরের নেতৃত্বে জামায়াত নেতারা বৈঠকে অংশ নেন : নয়া দিগন্ত

বিশেষ সংবাদদাতা

আগামী সাধারণ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি ও সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কে আলোচনা করতে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ। গতকাল বুধবার রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় পৃথক সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে এনসিপি ও জামায়াত নেতৃবৃন্দ জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি, গণভোট ও জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের রোডম্যাপ নিয়েও আলোচনা করেন।

প্রধান উপদেষ্টা উভয় দলকে আশ্বস্ত করে বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করার স্বার্থে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর করতে তিনি জামায়াত ও এনসিপিসহ সকল ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা চান।

“আমাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে আমরা ইতোমধ্যে নানা পদক্ষেপ নিয়েছি; সামনে আরো অনেক উদ্যোগ আপনারা দেখতে পাবেন,” জামায়াত নেতাদের সাথে আলাপকালে বলেন প্রধান উপদেষ্টা।

বৈঠকে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে দলটির চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার সাথে বৈঠক করেন। এনসিপির প্রতিনিধিদলের অন্য সদস্যরা হলেন, দলের উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামন্তা শারমিন ও যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ। এরপর জামায়াতের নায়েবে আমির ডা: সৈয়দ আবদুল্লাহ তাহের দলটির চার সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। অন্য সদস্যরা হলেন, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম মা’ছুম ও রফিকুল ইসলাম খান।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এবং শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান সরকারের পক্ষ থেকে উভয় বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

নাহিদ ইসলাম প্রধান উপদেষ্টাকে জানান, ঐকমত্য কমিশনের সাথে সংশ্লিষ্ট আইন বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনার জন্য এনসিপির পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে কমিশনকে চিঠি দেয়া হয়েছে।

এনসিপির সাথে বৈঠকের অব্যবহিত পর প্রধান উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করেন জামায়াত নেতৃবৃন্দ। তারা জাতীয় নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদের ওপর গণভোটের দাবি জানান।

“জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট হওয়া প্রয়োজন, কারণ জুলাই সনদে এমন অনেক বিষয় রয়েছে যা জাতীয় নির্বাচনের সাথে সম্পৃক্ত,” বৈঠকে বলেন ডা: আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের।

তিনি আরো বলেন, “জাতীয় নির্বাচনের সাথে একই দিনে গণভোট অনুষ্ঠিত হলে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।”

নির্বাচনকালীন প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিতের স্বার্থে প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক গৃহীত যেকোনো সিদ্ধান্তের প্রতি জামায়াতের পূর্ণ আস্থা রয়েছে বলেও জানান দলটির নেতারা।

এনসিপি ও জামায়াত নেতাদের প্রধান উপদেষ্টা জানান, নির্বাচনের আগে প্রশাসনের যেকোনো রদবদল তিনি নিজেই সরাসরি তদারকি করবেন।

নির্বাচন কমিশনের সাথে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে তিনি নেতৃবৃন্দকে আশ্বস্ত করেন।

বৈঠকে নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরা নির্বাচনের আগে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের রোডম্যাপ ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা চাই। এ বিষয়ে সরকারকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।” এ সময় প্রধান উপদেষ্টা এনসিপিকে জুলাই সনদে স্বাক্ষরের আহ্বান জানিয়ে বলেন, “এই সনদ জাতির জন্য মহামূল্যবান সম্পদ; এখানে সবার অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ।”

সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কাজ করছে বলেও এনসিপিকে আশ্বস্ত করেন প্রধান উপদেষ্টা।

এখন প্রয়োজন জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সাবেক এমপি ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে বহু দলের পরিশ্রমে আমরা যে ঐকমত্যে পৌঁছেছি তাতে অনেকে সই করেছেন। এখন প্রয়োজন জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি।

গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের কাছে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় তিনি এ কথা বলেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন- জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মা’ছুম ও মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান।

ডা: তাহের বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে আদেশ কে দেবেন এটা নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। আমরা চাই এটা প্রধান উপদেষ্টা দেবেন। আইনগত ব্যত্যয় না ঘটলে প্রধান উপদেষ্টা বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি করে জুলাই সনদের আইনের ভিত্তি ঘোষণা দিতে পারেন।

তাহের আরো বলেন, গণভোটের ব্যাপারে বলেছি। বিএনপিও গণভোটে রাজি হয়েছে। তবে বিএনপি জটিলতা তৈরি করেছে। তারা চাচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট হোক; কিন্তু গণভোট হলো সংস্কারের সাথে জড়িত, এটাকে জাতীয় নির্বাচনের সাথে মেলানো যাবে না। তিনি বলেন, বিএনপি অজুহাত দেখাচ্ছে গণভোটের সময় নেই; কিন্তু গণভোটের যথেষ্ট সময় আছে। নভেম্বরেই সেটি করা যাবে। এই গণভোট হলেই জনগণের সিদ্ধান্ত নিয়ে জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন হবে, নয়তো আগের মতোই হবে।

আব্দুল্লাহ তাহের বলেন, আমরা উপদেষ্টাকে জানিয়েছি, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না হলে এই পরিশ্রম পণ্ডশ্রম হবে। ড. ইউনূস এ ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছেন। একটা আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন।

বৈঠকে কয়েকজন উপদেষ্টাকে নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। ডা: তাহের বলেন, যারা উপদেষ্টা তাদের ব্যাপারে বলেছি, সবার ব্যাপারে নয়। আমরা বলেছি, আপনার প্রতি আমাদের আস্থা আছে; কিন্তু আপনার পাশের কিছু লোক আপনাকে বিভ্রান্ত করে এবং ওরা কোনো একটা দলের পক্ষে কাজ করে বলে আমরা মনে করি। তাদের ব্যাপারে আপনাকে হুঁশিয়ার থাকা দরকার।

বৈঠকে কোনো উপদেষ্টার অপসারণের দাবি তুলেছেন কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আমরা প্রথম দিন দৃষ্টি আকর্ষণ করছি... আমরা প্রথম দিন গিয়েই অপসারণ চাইনি। আমরা বলছি, আমরা এখন দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমরা সময় দিচ্ছি। আপনাকেও শুনতে দিচ্ছি। যদি না হয় তাহলে আমরা যা যা করার, সেগুলোর ব্যাপারে আমরা চিন্তা করব।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো দাবি তোলা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে এখনো সুপ্রিম কোর্টে শুনানি হচ্ছে। আমরা সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অপেক্ষায় আছি। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে কোনো ব্যত্যয় না হলে অন্তর্বর্তী সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা পালন করবে বলেও আশাবাদ জানান তিনি।

জামায়াতে ইসলামীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা কী বলেছেন, এমন প্রশ্নে জামায়াতে ইসলামীর এ নেতা বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন যে, উনি এগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করছেন এবং যেটা করতে হবে, সেটি উনি করবেন, ইনশা আল্লাহ।

নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির জন্য প্রশাসনে প্রয়োজনীয় রদবদলের আহ্বান জানালে প্রধান উপদেষ্টা আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানান জামায়াতের নায়েবে আমির। তিনি বলেন, প্রশাসন, পুলিশের মধ্যে ৭০ শতাংশ লোক একটি নির্দিষ্ট দলের প্রতিনিধিত্ব করে। এদের দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।

এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টার সাথে বৈঠকে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া, নভেম্বর মাসের শেষ দিকে গণভোট এবং জুলাই সনদের বাস্তবায়নের জন্য ‘এক্সট্রা জুডিশিয়াল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ জারির বিষয়ে আলোচনা হয় বলেও সাংবাদিকদের জানান আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। বৈঠকে তিনি জামায়াতে ইসলামীর চার সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন।

আইআরআই প্রতিনিধিদলের সাথে বৈঠক : গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দের সাথে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিক্যান ইনস্টিটিউট (আইআরআই)-এর ৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল সাক্ষাৎ করে। সাক্ষাৎকারটি অত্যন্ত আন্তরিকতা ও হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। আইআরআই-এর প্রতিনিধিদলে ছিলেন সদস্য ক্রিস্টোফার ফাসনার এবং সেন্টার ফর এ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির (সিএনএএস) ইন্দো-প্যাসিফিক সিকিউরিটি প্রোগ্রামের সিনিয়র ফেলো লিসা কার্টিস, কারিগরি বিশেষজ্ঞ জেসিকা কিগান, আবাসিক প্রোগ্রাম ডিরেক্টর স্টিভ সিমা, প্রোগ্রাম ডিরেক্টর (এনডিআই) জেমি স্পাইকারম্যান, প্রচারণা ও পরামর্শদাতা জন ফুহার্টি, পরামর্শদাতা ডারিন বিয়েলেকি, প্রোগ্রাম পরামর্শদাতা অমিতাভ ঘোষ এবং পরামর্শদাতা সাইদা মুশরেফা জাহান।

জামায়াত নেতৃবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- সংগঠনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসাইন ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য, লইয়ার্স কাউন্সিলের সভাপতি অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকার এবং ড. যুবায়ের আহমেদ।

বৈঠকে তারা বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিশেষ করে বিচার কার্যক্রম, রাষ্ট্রীয় সংস্কার এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের অগ্রগতির বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেন।