আন্তঃলেনদেন ব্যবস্থা চালু : দেশে ডিজিটাল অর্থনীতির নতুন দিগন্ত

Printed Edition

বিশেষ সংবাদদাতা

বাংলাদেশের আর্থিক খাতে বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগামী ১ নভেম্বর ২০২৫ থেকে ব্যাংক, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ও পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডারদের (পিএসপি) মধ্যে আন্তঃলেনদেন চালু হচ্ছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে বিকাশ, নগদ, এমক্যাশসহ যেকোনো এমএফএস থেকে অন্য এমএফএস বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ পাঠানো যাবে সহজে ও দ্রুত। বাংলাদেশ ব্যাংকের ন্যাশনাল পেমেন্টস সুইচ বাংলাদেশ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এই আন্তঃসংযোগ ব্যবস্থা কার্যকর হবে। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক এ-সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা (সার্কুলার) সব ব্যাংক, এমএফএস ও পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডারদের কাছে পাঠিয়েছে। এতে বলা হয়, নগদ অর্থের ব্যবহার কমিয়ে ডিজিটাল লেনদেন বৃদ্ধি এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তি জোরদার করাই এ উদ্যোগের মূল ল্য।

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় পাঁচ বছর আগে অর্থাৎ ২০২০ সালের অক্টোবরে, প্রথমবারের মতো ব্যাংক ও এমএফএসের মধ্যে আন্তঃলেনদেন ব্যবস্থা চালুর ঘোষণা দিয়েছিল। তবে সে সময় রাজনৈতিক হস্তেেপ এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। ২০২০ সালের ২২ অক্টোবর প্রকাশিত এক নির্দেশনায় জানানো হয়েছিল, ওই বছর ২৭ অক্টোবর থেকে এই ব্যবস্থা কার্যকর হবে। কিন্তু মাত্র একদিন আগে অর্থাৎ ২৬ অক্টোবর, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হঠাৎ ঘোষণা দেয় ‘এ উদ্যোগ আপাতত স্থগিত।’ সূত্র মতে, পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে এবং তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া থামিয়ে দেন। পরে ২০২২ সালের নভেম্বরে, জয় নিজেই ‘বনিময়’ নামে একটি আন্তঃলেনদেন প্ল্যাটফর্ম উদ্বোধন করেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পাঁচটি শেল কোম্পানির বিনিয়োগে চালু হওয়া এই প্ল্যাটফর্ম সরকার পরিবর্তনের পর বন্ধ হয়ে যায়। এখন পুনরায় বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি নিয়ন্ত্রণে নতুন ও নিরাপদ ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, এই আন্তঃলেনদেন ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হলো জনগণের জন্য আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানো এবং নগদবিহীন অর্থনীতির পথে অগ্রসর হওয়া। পূর্বে গ্রাহকরা কেবল একই প্ল্যাটফর্মের মধ্যে অর্থ স্থানান্তর করতে পারতেন। এখন বিকাশের গ্রাহক নগদের গ্রাহককে, অথবা কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টধারী এমএফএস ব্যবহারকারীকে টাকা পাঠাতে পারবেন কয়েক সেকেন্ডে। এতে সময় ও খরচ দুটোই কমবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি বাংলাদেশের ফিনটেক খাতের জন্য এক বিপ্লব। কারণ এতদিন এমএফএস ও ব্যাংক খাতের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকলেও, এখন তারা পারস্পরিকভাবে সংযুক্ত হবে। এতে সারা দেশে ডিজিটাল লেনদেনের পরিমাণ বহুগুণে বাড়বে এবং অর্থপ্রবাহ হবে আরো স্বচ্ছ।

এই ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দিষ্ট ফি নির্ধারণ করেছে। এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে বা এমএফএসে টাকা পাঠাতে এক হাজার টাকায় সর্বোচ্চ ৮ টাকা ৫০ পয়সা ফি দিতে হবে। পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডারদের েেত্র এই ফি মাত্র ২ টাকা এবং ব্যাংক থেকে ব্যাংকে লেনদেনে ২ টাকা সার্ভিস চার্জ থাকবে। এতে গ্রাহকরা তুলনামূলকভাবে কম খরচে দ্রুত লেনদেন করতে পারবেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আন্তঃলেনদেন ব্যবস্থা কার্যকর হলে প্রতারণা, জালিয়াতি ও অস্বচ্ছ লেনদেন কমে আসবে। একই সাথে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও অনলাইন বিক্রেতারা আরো সহজে ডিজিটাল পেমেন্ট গ্রহণ করতে পারবেন। এটি দেশের ই-কমার্স ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা খাতের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, আন্তঃলেনদেন ব্যবস্থা কেবল লেনদেন সহজ করবে না, বরং দেশের আর্থিক ব্যবস্থার স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও ডিজিটাল রূপান্তর ত্বরান্বিত করবে। গ্রাহকরা নগদের বিকল্প হিসেবে আরো বেশি ডিজিটাল লেনদেনের দিকে ঝুঁকবেন। সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশে আন্তঃলেনদেন ব্যবস্থা চালু হওয়া ডিজিটাল অর্থনীতির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। এটি শুধু ব্যাংক ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস খাতকে নয়, বরং পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেই সংযুক্ত ও আধুনিক করে তুলবে।