সিলেট নগরের পাঠানটুলা এলাকার জিন্নাহ, শেরেবাংলার স্মৃতিবিজড়িত অনিন্দ্য স্থাপত্যেশৈলীর দৃষ্টিনন্দন ‘মিনিস্টার বাড়ি’ ভাঙার কাজ অবশেষে বন্ধ করা করা হয়েছে। রোববার (২৬ অক্টোবর) বেলা দেড়টার দিকে জেলা প্রশাসনের একজন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনাস্থলে এসে কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দেন। তিনি জানান, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অমান্য করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কয়েক দিন ধরে ঐতিহ্য ও কৃষ্টি সংস্কৃতি সচেতন নাগরিকরা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাড়িটি রক্ষা ও সংরক্ষণের দাবিতে আন্দোলন চলছিল। গত শুক্রবার প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর বাড়ি ভাঙার কাজ বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেন। কিন্তু নির্দেশ অমান্য করে আবার ভাঙার কাজ শুরু হওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ে।
‘পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ট্রাস্ট’সহ বিভিন্ন সংগঠন শনিবার (২৫ অক্টোবর) মিনিস্টার বাড়ির সামনে মানববন্ধন করে বাড়িটির সংরক্ষণের দাবি জানান। মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি কর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষক ও স্থানীয় ইতিহাস-প্রেমীরা।
প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের কুমিল্লা ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মোছা: নাহিদ সুলতানা নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ঐতিহাসিক এ বাড়িটি সিলেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ভাঙার কাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনাটি ভাঙার খবর অনেকেরই অজানা ছিল।
সিলেটের কনটেন্ট ক্রিয়েটর আবদুর রহমান হিরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রথমে এই খবর ছড়িয়ে দেন। তার পোস্ট ভাইরাল হয়ে যায়। পরে নয়া দিগন্তসহ কয়েকটি গণমাধ্যমে বিষয়টি ফলাও করে প্রচার হলে সাড়া পড়ে যায়।
নয়া দিগন্তের অনলাইনে প্রতিবেদনে উঠে আসে বিস্তারিত তথ্য। প্রতিবেদনে জানানো হয়,‘সিলেটের ঐতিহ্য একে একে বিলীন হচ্ছে, তারই অংশ হিসেবে হাতুড়ির আঘাতে মাটিচাপা পড়ছে ঐতিহাসিক ‘মিনিস্টার বাড়ি’।’
গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর সচেতন নাগরিক, ইতিহাসবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী ও নগরবাসীর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। সেখানে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে দাবি ওঠে এই স্থাপনাটি ভেঙে ফেলার আগে অন্তত এটিকে প্রতœতাত্ত্বিক গুরুত্বের বিবেচনায় সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে।
নয়া দিগন্তের প্রতিবেদনের সূত্র ধরেই বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আসে। সিলেট জেলা প্রশাসন ও প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে প্রতিনিধি পাঠায়।
ঐতিহ্যবাহী এই বাড়িটি সিলেট নগরীর অন্যতম প্রাচীন স্থাপনা। অবিভক্ত ভারতবর্ষের আসাম প্রদেশের শিক্ষামন্ত্রী আব্দুল হামিদের নামানুসারে এই বাড়িটি ‘মিনিস্টার বাড়ি’ হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে।
দেশ ভাগের পর আবদুল হামিদ পাকিস্তান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। আব্দুল হামিদ ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তার পরিবারের শিকড় সিলেটের সমৃদ্ধ ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৩৪ সালে সুরমা নদীতে স্থাপিত ঐতিহাসিক কিনব্রিজ নির্মাণেও তার অবদান সুবিদিত।
আব্দুল হামিদের বোন হাফিজা বানু ছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী আবু আহমদ আব্দুল হাফিজের স্ত্রী। তারা বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের দাদা-দাদী।
এই বাড়ির সাথে জড়িয়ে আছে আরো এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সিলেট সফরে এসে এই বাড়িতে অতিথি ছিলেন।
এ ছাড়াও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ ব্রিটিশ ভারতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ এই বাড়িতে অতিথি হয়েছিলেন।
আব্দুল হামিদের চাচা মৌলভী আব্দুল করিম ছিলেন সিলেটের শিক্ষার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম। তিনি ছিলেন শিক্ষাবিদ, লেখক ও জাতীয়তাবাদী চিন্তাবিদ। সমাজে তার অবদান ও দানশীলতার অনেক ঘটনা এখনো সিলেটবাসীর মুখে মুখে।
এই পরিবারের ইতিহাস কেবল একটি পরিবারের নয় বরং এটি সিলেটের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সম্প্রতি বাড়িটি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ায় মালিকপক্ষ নিজ উদ্যোগে ভাঙার কাজ শুরু করেন। তবে এর স্থাপত্যশৈলী, দৃষ্টিনন্দন নকশা ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় বিষয়টি জানাজানি হতেই নগরবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
নগরবাসী ও স্থানীয় ইতিহাস গবেষকরা বলছেন, ‘যেভাবে ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে, সিলেটের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও বিলীন হচ্ছে। এখনই সংরক্ষণ না করলে একদিন এই শহরের ইতিহাস শুধু বইয়ের পাতায়ই থাকবে।
এ দিকে পরিদর্শনে আসা প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের প্রতিনিধি বলেন, ‘আমরা ভবনটির বয়স, নির্মাণশৈলী ও ঐতিহাসিক মূল্য যাচাই করে দেখছি। সংরক্ষণের উপযোগী মনে হলে ভবনটি জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হবে।’
আব্দুল হামিদের নাতি আনিসুল ইসলাম জানান, ‘বাড়িটি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ছাদ দিয়ে পানি পড়ে। তাই এই পুরনো বাড়িটি ভেঙে ফেলতে হচ্ছে। এটি ভাঙতে আমাদেরও কষ্ট হচ্ছে। তবে নিরুপায় হয়ে ভাঙতে হচ্ছে।’
সিলেটের ঐতিহ্য সন্ধানী সিনিয়র সাংবাদিক উজ্জ্বল মেহেদী জানান, ‘মিনিস্টার বাড়ি’ শুধু একটি পুরনো স্থাপনা নয়, এটি সিলেটের ইতিহাসের জীবন্ত অংশ। তাই এটি সংরক্ষণ করে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা জাদুঘর বা ঐতিহাসিক হেরিটেজ সেন্টার হিসেবে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেয়া উচিত।
প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ ও গণমাধ্যমের সক্রিয় ভূমিকায় সিলেটের এই প্রাচীন ঐতিহ্যটি ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ায় নয়া দিগন্তসহ মিডিয়ার প্রশংসা করছেন সিলেটের ঐতিহ্য সন্ধানী নাগরিক সমাজ।



