প্রথম প্রান্তিকে পোশাক খাতে ধীর গতি

বাংলাদেশের রফতানি আয়ে নতুন সম্ভাবনা কৃষি ইঞ্জিনিয়ারিং খাত

Printed Edition

বিশেষ সংবাদদাতা

বাংলাদেশের রফতানি খাতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আশাব্যঞ্জক প্রবৃদ্ধি দেখা গেলেও খাতভিত্তিক চিত্রে দেখা যাচ্ছে বৈচিত্র্য ও উদ্বেগের ইঙ্গিত। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে দেশের মোট রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে ১৩.৯৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫.৬৪ শতাংশ বেশি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই প্রবৃদ্ধি মূলত অপ্রচলিত খাতের উত্থান ও কৃষিপণ্য ও ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের রফতানিতে উন্নতির ফল। তবে বাংলাদেশের প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাক (আরএমজি) এ প্রবৃদ্ধি অনেক কমে এসেছে, যা বৈশ্বিক চাহিদা ও ক্রেতাদের সতর্কতার প্রতিফলন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বাংলাদেশের রফতানি খাতের সার্বিক চিত্র ইতিবাচক হলেও খাতভিত্তিক বৈষম্য উদ্বেগের। তৈরি পোশাকের প্রবৃদ্ধি যদি আরো কমে যায়, তাহলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রভাবিত হতে পারে। তবে কৃষি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ওষুধ খাতের উত্থান নতুন অর্থনৈতিক দিগন্তের ইঙ্গিত দিচ্ছে- যা সঠিক নীতি সহায়তা ও রফতানি বহুমুখীকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আরো টেকসই পথে এগিয়ে নিতে পারে।

তৈরি পোশাক খাতে প্রবৃদ্ধি শ্লথ : মোট রফতানির প্রায় ৮২ শতাংশজুড়ে থাকা তৈরি পোশাক খাত চলতি প্রান্তিকে অর্জন করেছে ১১.৪৫ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের তুলনায় মাত্র ৩.৪৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নির্দেশ করে। এর মধ্যে বোনা পোশাক (ওভেন গার্মেন্ট) খাতে আয় বেড়েছে ২.৭৩ শতাংশ, আর নিট পোশাক (নীটওয়্যার) খাতে বেড়েছে ৪.১১ শতাংশ।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) বলছে, বৈশ্বিক বাজারে ক্রেতাদের অর্ডার এখনো সতর্ক ও সীমিত। ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দা, আমেরিকায় সুদের হার বৃদ্ধির প্রভাব এবং বৈদেশিক মুদ্রা সঙ্কট এ খাতের রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন-‘আরএমজি খাতের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের নিচে নামা একটি সতর্ক সঙ্কেত। নতুন বাজার, যেমন দণি আমেরিকা ও আফ্রিকায় প্রবেশের কৌশল এখন জরুরি।’

কৃষিপণ্যে আশার আলো : অন্য দিকে কৃষিপণ্য রফতানিতে ১২.৭২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক বার্তা এনেছে। এই সময়ে কৃষিপণ্য রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩২৭ মিলিয়ন ডলার, যেখানে সবজি, ফুল, মাছ ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রফতানিতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখা গেছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাজ্যে চাহিদা বেড়েছে হিমায়িত খাদ্য ও হালাল প্রক্রিয়াজাত পণ্যের। কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি প্রণোদনা ও শুল্ক ছাড়ের ফলে এই প্রবৃদ্ধি টেকসই করার সম্ভাবনা রয়েছে।

চামড়া ও জুতাশিল্পে দুর্বলতা অব্যাহত : রফতানি আয়ের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী খাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যতে এবারো পতন অব্যাহত। চলতি প্রান্তিকে খাতটির আয় কমেছে ৬.৩ শতাংশ, যা মূলত কাঁচা চামড়া রফতানির সীমাবদ্ধতা ও পরিবেশগত সার্টিফিকেশন না থাকার কারণে।

তবে তৈরি জুতা রফতানিতে সামান্য ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি (২.১ শতাংশ) দেখা গেছে, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে।

ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যে রফতানির উত্থান : রফতানি বহুমুখীকরণের েেত্র সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক চিত্র এসেছে ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য খাত থেকে। এই খাতে আয় বেড়েছে ১৮.৯ শতাংশ, যা সব খাতের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক্স, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, সাইকেল ও স্টিল প্রোডাক্টস রফতানি বেড়েছে ভারত, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় বাজারে।

বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন (বিইএলএ) মনে করছে, সরকার যদি এই খাতে কর ছাড় ও প্রযুক্তি সহায়তা বজায় রাখে, তবে এটি পোশাকনির্ভর অর্থনীতি থেকে বের হওয়ার অন্যতম পথ হতে পারে।

অপ্রচলিত খাতে উত্থান : হোম টেক্সটাইল, ওষুধ, সিরামিক ও আসবাব খাতেও প্রান্তিক প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। বিশেষ করে ওষুধ রফতানি বেড়েছে ৬.২ শতাংশ এবং সিরামিক পণ্য ৫.৭ শতাংশ। হোম টেক্সটাইল ও আসবাবপত্র খাতেও নতুন বাজারের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে।

মোট প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক, তবে ঝুঁকি রয়ে গেছে : রফতানি বিশ্লেষকরা বলছেন, সামগ্রিকভাবে প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হলেও বৈশ্বিক মুদ্রা বাজারের অস্থিরতা, লজিস্টিক ব্যয় বৃদ্ধি এবং ডলার ঘাটতির কারণে বাংলাদেশের রফতানি প্রতিযোগিতা এখনো ঝুঁকির মুখে।

ইপিবি’র তথ্য অনুযায়ী, রফতানির বার্ষিক ল্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৯.৭০ বিলিয়ন ডলার। সেই হিসাবে প্রথম প্রান্তিকে অর্জন হয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। ল্যমাত্রা অর্জনে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা এখন মূল চ্যালেঞ্জ।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায় সংগঠনগুলো বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কয়েকটি সুপারিশ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে- রফতানি বৈচিত্র্য ও উদ্ভাবনের আওতায়- পোশাকের বাইরে ওষুধ, কৃষিপণ্য ও ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে নীতি সহায়তা জোরদার করা; বাজার সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে বাণিজ্য মিশন বাড়ানো; মান ও সার্টিফিকেশন সহায়তার আওতায় চামড়া ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত পণ্যে আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন সহজ করা এবং মুদ্রানীতি স্থিতিশীলতা : রফতানি আয়ের পুনর্বিনিয়োগে ডলার সঙ্কট দূর করা ও ব্যাংকিং সেক্টরকে স্থিতিশীল করা।