প্রবৃত্তির কামনা-বাসনাও একটি বাতিল উপাস্য

Printed Edition

জাফর আহমাদ

আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘কখনো কি তুমি সেই ব্যক্তির অবস্থা ভেবে দেখেছ, যে তার নিজের প্রবৃত্তির কামনাকে প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে? তুমি কি এহেন ব্যক্তিকে সঠিক পথে নিয়ে আসার দায়িত্ব নিতে পারো।’ (সূরা ফুরকান-৪৩) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন-‘তুমি কি কখনো সেই ব্যক্তির অবস্থা ভেবে দেখেছ যে তার প্রবৃত্তির কামনা-বাসনাকে খোদা বানিয়ে নিয়েছে আর জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ তাকে গোমরাহির মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন, তার দিলে ও কানে মোহর মেরে দিয়েছেন এবং চোখে আবরণ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ ছাড়া আর কে আছে যে তাকে হিদায়াত দান করতে পারে? তোমরা কি কোনো শিক্ষা গ্রহণ করো না?’ (সূরা জাসিয়া-২৩)

প্রবৃত্তির কামনাকে মাবুদে পরিণত করার মানে হচ্ছে- তার পূজা করা। আসলে এটিও ঠিক মূর্তিপূজা করা বা কোনো সৃষ্টিকে উপাস্য পরিণত করার মতোই শিরক। আবু উমামাহ বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘এ আকাশের নিচে যতগুলো উপাস্যের উপাসনা করা হয়ে থাকে, তাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট উপাস্য হচ্ছে এমন প্রবৃত্তির কামনা করা যার অনুসরণ করা হয়।’ (তাবারানি) এ জন্য আল্লাহর রাসূল সা: সবসময় প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা থেকে আল্লাহর আশ্রয় চেয়েছেন। জিয়াদ ইবনে ইলাকাহ রহ: থেকে চাচার সনদে বর্ণিত আছে- তিনি বলেন, নবী সা: বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি গর্হিত চরিত্র, গর্হিত কর্ম ও কুপ্রবৃত্তি থেকে আশ্রয় চাই।’ (তিরমিজি-৩৫৯১, কিতাবুদ দাওয়াত আন রাসূলিল্লাহ, বাবু দোয়ায়ে উম্মি সালামাহ, মিশকাত-২৪৭১, আবু ঈসা বলেন, এ হাদিসটি হাসান গরিব) জিয়াদ ইবনে ইলাকাহর চাচার নাম ইবনে মালিক আত তাগলিবি রা:, তিনি রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাহাবি)

যারা নিজেদের কামনাকে বুদ্ধির অধীনে রাখে এবং বুদ্ধি ব্যবহার করে নিজের জন্য ন্যায় ও অন্যায় পথের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়, সে যদি কোনো ধরনের শিরকি বা কুফরি কর্মে লিপ্ত হয়েও পড়ে তাহলে তাকে বুঝিয়ে সঠিক পথে আনা যেতে পারে। কিন্তু প্রবৃত্তির দাস হচ্ছে একটি লাগামহীন উট। তার কামনা তাকে যেদিকে নিয়ে যাবে সে পথহারা হয়ে সেদিকেই দৌড়াতে থাকবে। তার মনে ন্যায় ও অন্যায় এবং হক ও বাতিলের মধ্যে ফারাক করার এবং একটিকে ত্যাগ করে অন্যটিকে গ্রহণ করার কোনো চিন্তা আদৌ সক্রিয় থাকে না। তাহলে কে তাকে বুঝিয়ে সঠিক পথে আনতে পারে। আর ধরে নেয়া যাক, যদি সে মেনেও নেয় তাহলে তাকে কোনো নৈতিক বিধানের অধীন করে দেয়া কোনো মানুষের সাধ্যায়ত্ত নয়। এ ধরনের ব্যক্তিদের বুঝিয়ে সাময়িকভাবে সত্য পথে আনা হলেও আবার সে আগের পথেই চলে যায়। অনেকটা কম্পাসের কাঁটার মতো, কম্পাসের কাঁটা জোর করে ধরে রাখার পর ছেড়ে দিলে সেটি তার নির্ধারিত স্থানে চলে যায়। প্রবৃত্তির পূজারিরাও অনেকটা সে রকমই। দুনিয়ার লালসা একবার পেয়ে বসলে, তৎক্ষণাৎ সে দিকে ছুটে চলে।

যারা কামনা-বাসনার দাস হয়েছে, অর্থাৎ প্রবৃত্তির কামনা-বাসনাকে খোদা বানিয়েছে, নিজের ইচ্ছা আকাক্সক্ষার দাস বনে যায়। তার মন যা চায় তাই সে করে বসে যদিও আল্লাহ তা হারাম করেছেন এবং তার মন যা চায় না তা সে করে না যদিও আল্লাহ তা ফরজ করে দিয়েছেন। ব্যক্তি যখন এভাবে কারো আনুগত্য করতে থাকে তখন তার অর্থ দাঁড়ায় এই, তার উপাস্য আল্লাহ নয়; বরং সে এভাবে যার আনুগত্য করছে সে-ই তার উপাস্য। সে মুখে তাকে ইলাহ এবং উপাস্য বলুক বা না বলুক কিংবা মূর্তি তৈরি করে তার পূজা করুক বা না করুক তাতে কিছু এসে যায় না। কারণ দ্বিধাহীন আনুগত্যই তার উপাস্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এভাবে কার্যত শিরক করার পর কোনো ব্যক্তি শুধু এই কারণে শিরকের অপরাধ থেকে মুক্ত হতে পারে না যে, সে যার আনুগত্য করছে মুখে তাকে উপাস্য বলেনি এবং সিজদাও করেনি। সমস্ত মুফাসসিরিন এই ব্যাখ্যাই করেছেন। ইবনে জারির এর অর্থ বর্ণনা করেছেন এভাবে যে, সে তার কামনা-বাসনাকে উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে।

প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা একধরনের তাগুতও বটে। ইসলাম কামনা-বাসনাকে নিয়ন্ত্রণ করে বিধায় তারা ইসলামের অনুসরণ বাদ দিয়ে তাগুতের অনুসরণ করে। তাই প্রবৃত্তিও তাগুত। তাগুত মানুষকে আল্লাহর বিধান ও তাঁর নির্দেশাবলি অমান্য করে অন্য কারো বিধান ও নেতৃত্ব মেনে চলতে বাধ্য করে। সে মুখে আল্লাহর শরিক বলে ঘোষণা না দিলেও আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বে তাকে শরিক করারই শামিল। ওই ভিন্ন সত্তাদের প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করেও যদি আল্লাহর হুকুমের মোকাবেলায় তাদের হুকুম মেনে চলা হয় তাহলেও মানুষ শিরকের অপরাধে অভিযুক্ত হবে। কাজেই এখানে শয়তানদের ব্যাপারে প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে, দুনিয়ায় সবাই তাদের ওপর অভিশাপ বর্ষণ করছে; কিন্তু এ অভিশাপের পরও যারা তাদের অনুসরণ করে কুরআন তাদের সবার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আনছে যে, ‘তোমরা শয়তানদের আল্লাহর শরিক করে রেখেছ। এটি বিশ্বাসগত শিরক নয়; বরং কর্মগত শিরক এবং কুরআন একেও শিরক বলে।

বলা হয়েছিল, প্রবৃত্তি মানুষের একপ্রকার তাগুত। তাগুত মানে সীমালঙ্ঘনকারী। সে আল্লাহর দেয়া সীমারেখাকে তছনছ করে নিজের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে। শয়তান হলো সবচেয়ে বড় তাগুত। মানুষ শয়তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে পূজা অর্চনা করে না বা তাকে সরাসরি আল্লাহর মর্যাদায় অভিসিক্তও করে না। এ অর্থে কেউ শয়তানকে মাবুদ বানায় না, এ কথা ঠিক। তবে নিজের প্রবৃত্তি, ইচ্ছা আশা-আকাক্সক্ষা ও চিন্তা-ভাবনার লাগাম শয়তানের হাতে তুলে দিয়ে যেদিকে সে চালায় সেদিকে চলে এবং এমনভাবে চলা যেন সে শয়তান তার প্রভু- এটিই তো শয়তানকে মাবুদ বানাবার একটি পদ্ধতি। এ জন্য দেখবেন ব্যক্তি সালাত ও সাওম পালন করছে আবার ওজনে কম দিচ্ছে বা ওজনে বেশি নিচ্ছে, খাদ্যে ভেজাল মিশাচ্ছে এবং মিথ্যা বা বাকপটুতার মাধ্যমে কাজ নিজের দিকে নিয়ে নিচ্ছে, মানুষের ক্ষেতের সীমানা ঠেলছে, গায়ের জোরে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করছে, ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সম্পদ অবৈধভাবে লুটে নিচ্ছে এবং বিদেশে পাচার করছে। সবচেয়ে মারাত্মক হলো- সালাত, সাওমসহ জিকির-আজকারে মগ্ন, দেশের মানুষ যাদের ইসলামের সৌল এজেন্ট মনে করে, মসজিদ-মাদরাসার ইমাম ও মুহতামিম; কিন্তু প্রবৃত্তি তাকে এমন সব দলের লেহন করতে বাধ্য করে, যাদের মৌলিক দর্শন ও মতবাদ হচ্ছে কুফরি ও শিরক। ইমাম রাজি তার তাফসিরে কবিরে এ আয়াতগুলোর ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘তোমার সামনে যদি কোনো লোক আসে এবং তোমাকে কোনো জিনিসের হুকুম দেয় তাহলে দেখো তার এ হুকুম আল্লাহর হুকুমের অনুসারী কি না। অনুসারী না হলে শয়তান সে লোকদের সহযোগী হয়েছে। যদি এ অবস্থায় তুমি তার আনুগত্য করো তাহলে তুমি তার ও তার শয়তানের ইবাদত করলে। অনুরূপভাবে তোমার নিজের প্রবৃত্তি যদি তোমাকে কোনো কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে তাহলে এ ক্ষেত্রে শরিয়তের দৃষ্টিতে সে কাজটি করার অনুমতি আছে কি না দেখো। অনুমতি না থাকলে তোমার প্রবৃত্তি নিজেই শয়তান হয়ে গেছে অথবা শয়তান তার সহযোগী হয়েছে। এ অবস্থায় যদি তুমি তার আনুগত্য করো তাহলে তুমি তার ইবাদত করলে।’ সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে তিনি আবার বলেছেন; কিন্তু শয়তানের ইবাদত করার বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। কখনো এমন হয়, মানুষ একটি কাজ করে এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে সাথে তার কণ্ঠও তার সহযোগী হয় এবং মনও তার সাথে অংশগ্রহণ করে। আবার কখনো এমনো হয়, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে মানুষ একটি কাজ করে কিন্তু অন্তর ও কণ্ঠ সে কাজে তার সহযোগী হয় না। কেউ কেউ এমন অবস্থায় একটি গুনাহ করে, যখন তার অন্তর তাতে সায় দেয় না এবং তার কণ্ঠ সে জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হয়, এ অবস্থায় সে স্বীকার করে আমি এ খারাপ কাজ করেছি। এ হচ্ছে নিছক বাইরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে শয়তানের ইবাদত। আবার এমন কিছু লোকও আছে যারা ঠাণ্ডা মাথায় অপরাধ করে এবং মুখেও নিজেদের এ কাজে আনন্দ ও সন্তোষ প্রকাশ করে। এরা ভেতরে-বাইরে শয়তানের ইবাদাতকারী।’ (তাফসিরে কবির, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা : ১০৩-১০৪)

আল্লাহ তয়ালা বলেন-‘এসব লোক কি আল্লাহর এমন কোনো শরিকে বিশ্বাস করে যে, এদের জন্য দ্বীনের মতো এমন পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছে আল্লাহ যার অনুমোদন দেননি?’ (সূরা শূরা-২১) এখানে সেই সব শরিকের কথা বলা হয়নি, যাদের মানুষ নজর-নিয়াজ দেয় বা পূজা অর্চনা করে; বরং এখানে সেসব মানুষকে বুঝানো হয়েছে, মানুষ যাদের আদেশ দানের ক্ষেত্রে অংশীদার বানিয়ে নিয়েছে, যাদের শেখানো ধ্যান-ধারণা, আকিদা-বিশ্বাস, মতবাদ এবং দর্শনের প্রতি মানুষ বিশ্বাস পোষণ করে। যাদের দেয়া মূল্যবোধ মেনে চলে যাদের পেশকৃত নৈতিক নীতিমালা এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতির মানদণ্ডগুলো গ্রহণ করে, যাদের রচিত আইন-কানুন, পন্থা ও বিধি-বিধানকে নিজেদের রাজনীতি ও সরকারব্যবস্থা এমনভাবে গ্রহণ করে যেন এটিই সেই শরিয়াত যার অনুসরণ তাদের করা উচিত। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করা এবং অন্য কারো কাছে প্রার্থনা করা যেমন শিরক, এটিও ঠিক তেমনি শিরক।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট