মামুন সরকার
আকাশে মেঘ জমেছে। নদী যেন নিঃশব্দে গর্জে উঠছে,আলো আর আঁধারের ভেতর দিয়ে। গফুর মাঝি দাঁড়িয়ে আছে ঘাটে। তার চোখে নদী কোনো সাধারণ জলধারা নয়, এ যেন জীবনের আয়না।
সে বিড় বিড় করে,আজ আবার মনে হচ্ছে নদী আমাদের পরীক্ষা নেবে।
দূরে গ্রামের পথ ধরে আসছে এক কিশোরী।
তার হাতে ছেঁড়া বই, চোখে কষ্টের ছায়া। নাম সালমা। মা বারবার বলেছে বই ফেলে দিতে, বন্যায় ভেসে যাবে। কিন্তু সে আঁকড়ে ধরেছে, যেন বইয়ের পাতাগুলোই তার স্বপ্ন। সালমা ঘাটে এসে বলল, চাচা, আপনি জানেন? স্কুল আবার ডুবে গেছে।
গফুর মাঝি তাকাল, মলিন হাসি দিয়ে বলল, স্কুলটা চোখে ভাসে, কিন্তু স্বপ্ন ভাসে না মা। নদী যতই ভাঙতে থাকুক, মানুষের মন নদীর চেয়ে গভীর।
পাশের জমিতে কাজ করছে কৃষক হরিদাস।
হাঁসফাঁস করে কাদায় নেমে গাছের গোড়ায় মাটি চেপে ধরছে। তার গলা ভাঙা, কিন্তু দৃঢ়। সে বলে, এই মাটি আমার বাবার রক্তে ভেজা। নদী যদি কাড়ে, আমি আবার ফিরিয়ে আনব।
হঠাৎ করেই দূরে ভেসে উঠল এক অপরিচিত ছায়া।
বাজার থেকে ফিরছে রাশেদ। শহরে বছর কয়েক চাকরি করে ফিরেছে। চোখে নতুন আলো, হাতে নকশা আর কিছু কাগজ। সে এসে বলল, চাচা, শুনেন না? আমি দেখেছি শহরে কেমন বাঁধ বানায়। মেশিন আছে, নতুন কৌশল আছে। চাইলে গ্রামটাকে বাঁচানো যায়।
হরিদাস হেসে বলল, বাঁচাবে মেশিন, না মানুষ? নদীকে মেশিনে বাঁধতে গেলে নদী হাসবে।
কথা থেমে গেল হাওয়ার ঝাপটায়। নদী যেন এক মুহূর্তে সবাইকে শুনিয়ে দিল তার নিজস্ব সঙ্গীত।
সেই সন্ধ্যায় গ্রামে ফিরে এলো কবি আনিস।
বিদেশে ছিল বহু বছর। হাঁটতে হাঁটতে ভাঙ্গা ঘর, শূন্য মাঠ দেখে তার বুকটা কেঁপে উঠল। সে মনে মনে লিখে ফেলল, ‘নদী শুধু ভাঙে না, নদী আমাদের শেখায়, সব কিছু ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু স্বপ্ন স্থায়ী।’
গ্রামের মানুষজন চুপচাপ তাকিয়ে রইল নদীর দিকে। নদী গর্জন করছে, কিন্তু তার ভেতরে যেন এক রহস্যময় ডাক।
নদী ভোরের আলোয় লালিমা ছড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু গ্রাম শান্ত নয়। পাড় ভাঙার গন্ধ বাতাসে। সালমা পায়ে কাদা মেখে চলেছে। সে বলল, চাচা, আমার বই কোথায় যাবে? আমার লেখাপড়ার স্বপ্ন?
গফুর মাঝি হাত দিয়ে তার চুল ছুঁয়ে বলল, বই হারাবে, কিন্তু তোমার স্বপ্ন নদীর মতো গভীর। হারানো মানে শেষ নয় মা।
কৃষক হরিদাস ধুলো মেখে হাঁসফাঁস করছে। আমার ধানক্ষেত নদী ভেঙে নিলো। আমার হাতের সব জমি খালি। আমি কী করব?
সেলিম যুবক এগিয়ে এসে বলল, হরিদাস দাদা, আমরা যদি এক হই, কিছু বাঁচাতে পারব। নতুন বাঁধ তৈরিতে সবাইকে মিলে কাজ করতে হবে।
সজল ছোট্ট ছেলে, বয়স বারো তেরো। কাদায় লাফিয়ে লাফিয়ে বলল, নদী যদি সব খেয়ে ফেলে, আমরা নতুন মাঠ বানাবো, তাই না মা?
মায়ের চোখে কষ্টের জল। শাড়ির আঁচলে মুছে বলেন, হ্যাঁ বাবা, নতুন মাঠ হবে। হারানো মানেই সবকিছু শেষ নয়। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন।
রাশেদ নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে নদীর গর্ভে বিলীন হওয়া ফসলি জমির সীমানা কোথায় আন্দাজ করার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। চার দিকে থইথই জলরাশি আর পাড়ভাঙা ঢেউয়ের গর্জন। রাশেদ বলে, মানুষ যদি এক হয়, আমরা নদীভাঙা রোধের চেষ্টা করতে পারি। বিপদে সাহস চাই।
সেলিম বলল, হ্যাঁ ভাইয়া। দশের হাত এক হলে সব কিছুই সম্ভব। ভাঙাগড়া নিয়েই তো মানুষের জীবন। আমাদেরকে সাহস নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে হবে।
রাত্রি নেমে এলে নদী আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল।
ভাঙা ঘর, ভেসে যাওয়া কুঁড়েঘর, আর কাঁদায় মানুষের পদচিহ্ন, সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ চিত্র।
গফুর মাঝি নীরব দাঁড়িয়ে নদীর দিকে চেয়ে বলল,
আমাদের ঘরবাড়ি, ফসলের মাঠ সবই নদী কেড়ে নিচ্ছে। নদী ক্যান বুঝে না আমরা ক্ষুদ্র, আমাদের বিস্তর জমিজিরাত নেই। সব কেড়ে নিলে পখে বসতে হবে।
সালমা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার স্কুল আর বই যাবে কোথায়?
আনিস কবি সালমার কাঁধে হাত রেখে বলল, সালমা, সব হারালেও গল্প বেঁচে থাকে। তুমি সে গল্পের অংশ।
রাত্রি শেষে সবাই একত্রে নদীর ধারে বসে থাকে।
নদী গর্জন করছে, কিন্তু তার ভেতরেও যেন নতুন সকাল লুকিয়ে আছে।
রাত নেমে এসেছে।
চাঁদের আলো নদীর জলে ঝিলমিল করছে। জল যেন আকাশের আয়না। জলের আরশিতে হাজার হাজার মুখের ছবি ভেসে ওঠে, হাসি, কান্না, ভাঙা ঘর, ফসলিজমি।
মায়া নদীর ধারে বসে, চোখ বন্ধ করে ভাবছে, এই নদী শুধু রাক্ষস নয়, সব হারানোর ইতিহাস, স্মৃতি, ভালোবাসা, বেদনার প্রতীক।
সেলিম যুবক পাশে এসে বসে বলে, মায়া, দেখছ? নদী আমাদের ভাঙছে, কিন্তু একসাথে হলে আমরা বাঁচতে পারি।
মায়া নদীর দিকে তাকিয়ে বলে, ভাঙন ভয়ঙ্কর ঠিক, কিন্তু নদীর আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পারলে, মনে হয় আমরা এখনো আছি।
সালমা কাঁদছে, তার চোখে স্বপ্নের ছায়া। ‘চাচা, আমার বই কি ভেসে যাবে?’
গফুর মাঝি বলল, বই হয়তো যাবে, কিন্তু লেখাপড়া, স্বপ্ন, এসব তোমার হৃদয়ে বেঁচে থাকবে মা।
রাশেদ নদীর পাড়ে এসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে, সব হারিয়ে ফেলা মানে শেষ নয়। আমরা প্রযুক্তি, জ্ঞান দিয়ে বাঁধ বানাতে পারি। গ্রাম বাঁচানো সম্ভব।
কৃষক হরিদাস মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, সব মানুষ যদি এক হয়, নদীকে প্রতিহত করা যায়। কিন্তু মাটি আর নদী, এ দুইয়ের মধ্যে বোঝাপড়া লাগবে।
রাত্রির নীরবতা ভেঙে ভেসে আসে কবি আনিসের কণ্ঠ স্বর, নদী শুধু ভাঙে না, নদী শিখায়। সব হারিয়ে যাওয়ার পরও বাঁচার পথ আছে। নদীর আয়নায় মানুষ নিজেকে দেখে, হারানো আর আশা একসাথে দেখে।
মায়ের কোলে শিশু সজল মাথা রেখে বলে, নদী যদি সব খেয়ে ফেলে, আমরা নতুন গ্রাম বানাবো, তাই না মা?
ছেলের কথায় মা হাসলেন। হাসির মধ্যে চোখ ভিজে গেল।
হ্যাঁ, নতুন গ্রাম হবে। নতুন নতুন ঘর হবে। সাংবাদিকরা ছবি তুলবে। নতুন গল্প লিখবে। আর আমরা পথেঘাটে দিন কাটাব।
বিকালবেলা নদীর জলে সূর্য রক্তিম আভা ছড়াচ্ছে। কিন্তু নদী শান্ত নয়। ঢেউয়ের সঙ্গে ভাঙনের শব্দে মিলেমিশে মানুষের হৃদয় কেঁপে উঠছে।
কৃষক হরিদাস নিজের ভাঙা জমির দিকে তাকিয়ে বলল, এই মাটি আর আমার নেই। নদী সব কেড়ে নিল। আমি কী করব?
সেলিম যুবক আশ্বাস দিয়ে বলল, হরিদাস দাদা, আমরা একসাথে থাকলে কিছুটা হলেও বাঁচাতে পারব। নতুন বাঁধ, নতুন কৌশল।
জেলে রহিম মিয়া নদীর ধারে দাঁড়িয়ে বলল, মাছও কমে গেছে। নদী শুধু ভাঙছে। আমরা কেমনে বাঁচব?
গফুর মাঝি ধীরে ধীরে বলল, বাঁচা মানে শুধু ঘর, জমি নয়। নদী শিখায়, কিভাবে হারিয়ে ও টিকে থাকা যায়।
ছোট্ট সজল খেলছে কাদায়, হেসে হেসে বলে, নদী সব খেয়ে ফেলুক, আমরা নতুন মাঠ বানাবো, তাই না মা?
মায়ের চোখ ভিজে আসে। মা বলেন, হ্যাঁ, নতুন মাঠ হবে। হারানো মানেই শেষ নয় বাবা। তবে সেই মাঠ হারানো মানুষের হয় না। জোর দখলে চলে যায় অন্যের হাতে।
রাশেদ গ্রামে নতুন যুবক দল গঠন করছে। আমরা যদি সবাই একসাথে থাকি, কেউ হারাবে না। আমরা নদীর ভাঙন নিয়ে পত্রিকায় সব লিখব, সবার কাছে পৌঁছে দেবো। সরকার যেন বাঁধ নির্মাণে এগিয়ে আসে।
বৃদ্ধা আমেনা খালা বলল, এই মাটিতে আমার স্বামী কবর। নদী যদি সব কেটে নেয়, আমি কোথায় যাবো? আমার তো এই ভিটে ছাড়া আর কিছু নেই।
গফুর মাঝি খালার হাত ধরে বলে, আপনি কোথাও যাবেন না। আমরা যদি বেঁচে থাকি আপনিও থাকবেন।
রাত্রি শেষে নদী, ভোরের আলোয় রুপালি হয়ে উঠল। সেই আলো দেখতে সুন্দর, অথচ শূন্যতার মতো শীতল। রাতে নদী ছিল ভয়ঙ্কর উন্মত্ত দানব।
যুবক দলের হাজার বস্তার বাঁধকে মুহূর্তেই গিলে নিল। বালির বস্তাগুলো যেন ছিল নদীর দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা দানা। বাঁধের সাথে ভেসে গেল পাড়ঘেঁষা কয়েকটি কুঁড়েঘর, মানুষের দীর্ঘদিনের ঘাম, অশ্রু আর স্বপ্ন। এখন গ্রামের বুক ফাঁকা, মানুষের চোখে শূন্যতা।
স্মৃতির চিহ্ন হয়ে পড়ে আছে, কাদার ওপর ভাঙা কাঠের তক্তা, ছেঁড়া শাড়ি, ডুবে থাকা মাটির হাঁড়ি। সব যেন নদীর শিকার হয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে।
ধীরে ধীরে মানুষ গ্রাম ছাড়তে লাগল। কেউ শহরে ছুটল, আবার কেউ দূরের গ্রামে আত্মীয়ের উঠোনে সামান্য জায়গা পেল। তাদের চোখে ছিল সেই একই দীর্ঘশ্বাস। ভিটেমাটি হারানো মানে শুধু আশ্রয় নয়, হারানো মানে শিকড় উপড়ে যাওয়া। যে শিকড় ছাড়া মানুষ গাছের মতো দাঁড়াতে পারে না।
সেলিম যুবক আর রাশেদ, যারা স্বপ্ন দেখেছিল গ্রাম বাঁচানোর, তাদের মনে বড় আক্ষেপ। হাজার বস্তা বালু দিয়েও নদীর ভাঙন রোধ করতে পারল না। এই রাক্ষসী নদী সব স্বপ্ন শেষ করে দিলো।
যুবক দলের সবার বুকে কষ্টের দীর্ঘশ্বাস। তাদের চোখ শুধু স্থির নদীর স্রোতের দিকে। যেন বুঝতে চাইছে, মানুষের ঘাম আর রক্ত নদীভাঙনের কাছে খুবই তুচ্ছ।
গফুর মাঝির চোখে বুকভাঙা কষ্টের জল। বুকে জমা সব হারানোর দীর্ঘশ্বাস। যেন নদীর গর্জনই তার বুকের ভেতর প্রতিধ্বনি করছে। তিনি বিড় বিড় করে বললেন, নদী ভাঙা, মানুষ হারায়। তবু নদী আমাদের শিখায়। হারিয়েও বাঁচতে হয়, ভেসে গিয়েও দাঁড়াতে হয়।
সেই মুহূর্তে নদীর ওপারে সূর্য উঠল। আলোর ফালি যেন ভাঙনের ধ্বংসস্তূপের ওপর পড়ে বলছে, ‘এখনো শেষ হয়নি।’
মানুষ চলে গেল, গ্রাম বিলীন হলো। তবু নদীর বুকে থেকে গেল তাদের স্মৃতি, তাদের দীর্ঘশ্বাস, তাদের স্বপ্ন।
নদী শুধু ঘর কেড়ে নেয়নি, মানুষের বেদনা আর ভালোবাসাকেও নিজের বুকে ধারণ করেছে।
নদীর তীরে পড়ে রইল শিশু সজলের ভাঙা খেলনা আর সালমার ছেঁড়া বইয়ের পাতা।
তাতে ভোরের আলো পড়তেই মনে হলো, শিশুর হারানো হাসি নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে যাচ্ছে দূরে,
কিন্তু আবার ফিরে আসবে কোনো নতুন প্রজন্মের হাসি হয়ে।
কারণ নদী যেমন ভাঙে, তেমনি আবার ভরাটও হয়।
এটাই ভাঙনের নিয়ম। আজ যারা হারাল, আগামীকাল তাদের সন্তানরা হয়তো নতুন মাটিতে দাঁড়াবে।
তখন ভাঙনের স্মৃতি হয়ে উঠবে তাদের উত্তরাধিকারের জন্য এক অমোচনীয় শিক্ষা। যা বলে দেবে, ‘নদী ভিটেমাটি ভাঙতে পারে,
কিন্তু মানুষের মন ভাঙতে পারে না। নতুন করে ঘুরে দাড়ানোর স্বপ্ন কাড়তে পারে না।


