অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
পতন সামলে উঠতে পারছে না পুঁজিবাজার। গতকাল সূচকের বড় পতন দিয়েই সপ্তাহ শুরু করেছে দেশের পুঁজিবাজার। এ নিয়ে টানা তিন দিন সূচক হারাল দেশের দুই পুঁজিবাজার। আগের সপ্তাহের প্রায় পুরোটাই পতনের মধ্য দিয়ে পার করার পর গতকাল লেনদেনের শুরুতে বাজারগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিলেও দিনশেষে ঘটেছে উল্টোটাই। সূচকের আরো বড় ধরনের অবনতিতেই সপ্তাহের প্রথম দিনের লেনদেন শেষ করে দুই পুঁজিবাজার। সংশ্লিষ্টরা গত ক’দিন ধরে বাজারের এ পতনকে সংশোধন হিসেবে বর্ণনা করলেও এখন আর বাজার পরিস্থিতি নিয়ে মুখ খুলছেন না। অথচ টানা এ দরপতনে নতুন করে শঙ্কার মুখে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গতকাল দিনের শুরুতে প্রধান সূচকটির বড় ধরনের উন্নতি ঘটতে দেখা যায়। পাঁচ হাজার ৪৪৯ দশমিক ৯২ পয়েন্ট থেকে যাত্রা শুরু করা সূচক প্রথম কয়েক মিনিটে পৌঁছে যায় পাঁচ হাজার ৪৮৯ পয়েন্টে। অর্থাৎ ৪০ পয়েন্টের বেশি উন্নতি ঘটে। কিন্তু মাত্র আধঘণ্টার মধ্যে তথা সকাল সাড়ে ১০টা থেকেই বিক্রয়চাপের শিকার হয় বাজারটি। দিনের বাকি সময় আর এ চাপ সামলে উঠতে পারেনি। দিনশেষে ৬৮ দশমিক ০৮ পয়েন্ট হারিয়ে পাঁচ হাজার ৩৮১ দশমিক ৮৪ পয়েন্টে স্থির হয় সূচকটি। একই সময় ডিএসইর দুই বিশেষায়িত সূচক ডিএসই-৩০ ও ডিএসই শরিয়াহ সূচকের অবনতি ঘটে যথাক্রমে ২৩ দশমিক ৭১ ও ১৯ দশমিক ২৪ পয়েন্ট।
দেশের দ্বিতীয় পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) ছিল লেনদেনের একই চিত্র। এখানে প্রধান সূচক সিএএসপিআই ১৩৮ দশমিক ৫৮ পয়েন্ট কমেছে। ১৫ হাজার ৩৩০ দশমিক ৯৯ পয়েন্ট থেকে লেনদেন শুরু করা সূচকটি দিনশেষে নেমে আসে ১৫ হাজার ১৯৯ দশমিক ১৯ পয়েন্টে। বাজারটির দুই বিশেষায়িত সূচক সিএসই-৩০ ও সিএসসিএক্স সূচকের অবনতি ঘটে যথাক্রমে ৭১ দশমিক ৭৪ ও ৮১ দশমিক ০৩ পয়েন্ট।
প্রসঙ্গত দীর্ঘদিনের মন্দা কাটিয়ে গত জুন মাসের শুরু থেকে ইতিবাচক ধারায় ফিরতে শুরু করেছিল দেশের পুঁজিবাজার। ২৮ মে ডিএসইর প্রধান সূচকটির অবস্থান ছিল চার হাজার ৬১৫ পয়েন্টে। পরবর্তী দিনগুলোতে বাজার পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৭ সেপ্টেম্বর ডিএসইর প্রধান সূচক সাম্প্রতিক সময়ের সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার ৬৩৬ পয়েন্টে পৌঁছে যায়। একই দিন ডিএসইর লেনদেন পৌঁছে যায় এক হাজার ৪৪১ কোটি টাকায়। এটাই ছিল সাম্প্রতিক সময়ে ডিএসইর লেনদেন ও সূচকের সর্বোচ্চ অবস্থান। কিন্তু এর পরেই বাজারে নেতিবাচক প্রবণতা শুরু হয়। গত ১১ কর্মদিবসে ডিএসই্ সূচকের অবনতি ঘটে ২৫৫ পয়েন্টের বেশি। আর এতে প্রভাবিত হয় বাজারের লেনদেনও। গতকাল ডিএসইতে ৬২১ কোটি টাকার লেনদেন হয়। সে হিসেবে এই সময়টিতে ডিএসইর লেনদেন কমেছে প্রায় ৮২০ কোটি টাকা।
এদিকে, চলমান বাজার আচরণ নিয়ে বড় ধরনের শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা চলমান বাজার আচরণকে সংশোধন হিসেবে দেখলেও তা মানতে রাজি নন তারা। গতকাল মতিঝিলে ডিএসইর বিভিন্ন ব্রোকার হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের ট্রেডিং ফ্লোরগুলোতে বিনিয়োগকারীদের সাথে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে তারা তাদের এ শঙ্কার কথা জানান। নয়া দিগন্তকে তারা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে লেনদেন ও সূচকের উন্নতি ঘটেছে এটা ঠিক। কিন্তু কোনো অবস্থা থেকে এখানে উত্তরণ ঘটেছে তা বিবেচনায় রাখতে হবে। সাধারণ বাজারের মন্দা কাটতে শুরু করলে বিনিয়োগকারীরা আশান্বিত হয়ে ওঠেন। নতুন করে বিনিয়োগে উৎসাহী হন। কিন্তু বাজারের সাম্প্রতিক আচরণে মনে হচ্ছে, আবার ধারাবাহিক পতনের দিকে যাচ্ছে। এ অবস্থায় আগের লোকসানতো এখনো কাটেনি, তার ওপর নতুন করে লোকসানের মধ্যে পড়তে হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের। বাজার সংস্কারে তারা নিয়ন্ত্রক সংস্থার নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও সংস্থাটির কোনো কোনো পদক্ষেপ বাজারের অস্থিরতার কারণ বলেও মনে করেন তারা। তাই যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ বিবেচনায় রাখার অনুরোধ করেন তারা।
গতকাল দুই বাজারেই বেশির ভাগ শেয়ারের দাম কমেছে। ঢাকায় লেনদেন হওয়া ৩৯৬টি কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় ছিল মাত্র ৩৯টি আর দরপতনের শিকার ছিল ৩০৭টি কোম্পানি ও ফান্ড।
অপরদিকে চট্টগ্রাম শেয়ারবাজারে ২১৪টি সিকিউরিটিজের মধ্যে ৩২টির দাম বাড়লেও কমেছে ১৬১টির।
গতকাল ডিএসইতে লেনদেনের শীর্ষস্থানটি দখলে রাখে খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ। ২৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকায় কোম্পানিটির ১৬ লাখ ১০ হাজার শেয়ার হাতবদল হয়। ২৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকায় ৬৩ লাখ ৬৭ হাজার শেয়ার বেচাকেনা করে সামিট অ্যালাইয়েন্স পোর্ট ছিল লেনদেনের দ্বিতীয় অবস্থানে। শীর্ষ ১০ কোম্পানির মধ্যে ছিল যথাক্রমে ফারইস্ট নিটিং অ্যান্ড ডাইং, টেকনো ড্রাগস, ওরিয়ন ইনফিউশন, এনভয় টেক্সটাইলস, রবি অজিয়াটা, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ, লাভেলো আইসক্রিম ও মালেক স্পিনিং।
ডিএসইর মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষে ছিল ডিবিএইচ ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড। গতকাল ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ দাম বাড়ে ফান্ডটির। ৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ মূল্য বেড়ে এ তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ফারইস্ট নিটিং অ্যান্ড ডাইং। ডিএসইর মূল্যবৃদ্ধিতে শীর্ষ ১০ সিকিউরিটিজের অন্যগুলো ছিল যথাক্রমে আইসিবি এএমসিএল সেকেন্ড মিউচুয়াল ফান্ড, আরগন ডেনিমস, ট্রাস্ট ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, হা ওয়াল টেক্সটাইলস, তশরিফা ইন্ডাস্ট্রিজ, শাশা ডেনিমস, সমতা লেদার ও সামিট অ্যালাইয়েন্স পোর্ট।
এদিন দরপতনের শীর্ষে ছিল ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ দর হারায় জীবন বীমা কোম্পানিটি। ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ দরপতন ঘটা ফার্স্ট ফিন্যান্স ছিল এ তালিকার দ্বিতীয় কোম্পানি। ডিএসইর দরপতনের শীর্ষ ১০ কোম্পানির অন্যগুলো ছিল যথাক্রমে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ফার ইস্ট ফিন্যান্স, ওরিয়ন ইনফিউশন, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইনফরমেশন সার্ভিসেস নেটওয়ার্ক, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ, বঙ্গজ লিমিটেড ও বিডি অটোকারস।



