দুনিয়া আখিরাতের সেতু

Printed Edition
দুনিয়া আখিরাতের সেতু
দুনিয়া আখিরাতের সেতু

মো: আবদুর রহমান

দুনিয়া স্থায়ী আবাস নয়। এখানের সব কিছু ক্ষণিকের ও ক্ষয়িষ্ণুু। কিছুকাল দুনিয়া উপভোগ করার পর একসময় সব শেষ হয়ে যায়। দুনিয়া হলো প্রতারণার বাজার। দুনিয়ার ধোঁকায় যে পড়েছে, তার পরকাল বরবাদ হয়েছে। দুনিয়া তার সব কিছু কেড়ে নিয়ে নিঃস্ব করে কবরে আছড়ে ফেলেছে। খালি হাতে কবরে গিয়ে বুঝেছে, সে দুনিয়াতে কত বড় প্রতারণার স্বীকার হয়েছিল।

দুনিয়ার আরাম আয়েশের চাকচিক্য যদিও অপরূপ মনে হয়; কিন্তু এখানের কোনো সুখ-শান্তি, আনন্দ কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। পক্ষান্তরে আখিরাতের জীবন চিরস্থায়ী ও অনন্ত-অসীম। আখিরাতের আনন্দ ও নিয়ামত সব কিছুই চিরস্থায়ী। সুতরাং প্রকৃত জীবন শুধু আখিরাতেরই জীবন। এ জন্য প্রকৃত বুদ্ধিমান ওই ব্যক্তি, যে দুনিয়াতেই পরকালের পাথেয় ও পুঁজি সংগ্রহ করে। শাদ্দাদ ইবনে আওস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের প্রবৃত্তিকে স্বীয় আয়ত্তাধীনে রেখেছে এবং মৃত্যুর পরের জন্য (অর্থাৎ পরকালের মুক্তির জন্য) নেকির পুঁজি সংগ্রহ করেছে, সে ব্যক্তিই প্রকৃত বীরপুরুষ ও বুদ্ধিমান। আর যে ব্যক্তি স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসারী হয়ে আল্লাহর প্রতি ক্ষমার আশা পোষণ করে, মূলত সে-ই মূর্খ ও কাপুরুষ।’ (সুনানে তিরমিজি-২৪৫৯, ইবনে মাজাহ-৪২৬০)

দুনিয়াকে রাসূল সা: কতটুকু গুরুত্ব দিতেন, তা বোঝা যায় একটি হাদিস দ্বারা। আবদুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল সা: কোনো একসময় খেজুর পাতার মাদুরে শুয়েছিলেন। তিনি ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে দাঁড়ালে দেখা গেল তাঁর গায়ে মাদুরের দাগ পড়ে গেছে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা আপনার জন্য একটি নরম বিছানার (তোশক) ব্যবস্থা করতে চাই। তিনি বললেন, ‘দুনিয়ার সাথে আমার কী সম্পর্ক? দুনিয়াতে আমি এমন একজন পথচারী মুসাফির ছাড়া তো আর কিছুই নই, যে একটি গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিলো, তারপর তা ছেড়ে দিয়ে গন্তব্যের দিক চলে গেল।’ (মুসনাদে আহমাদ-৩৭০৯, সুনানে তিরমিজি-২৩৭৭, সুনানে ইবনে মাজাহ-৪১০৯)

অর্থাৎ- দুনিয়া আমাদের জন্য সেই পথের গাছের মতো, যার নিচে কোনো পথিক সামান্য সময়ের জন্য বসে। এত অল্প সময়ের জন্য কেউ কি বিল্ডিং নির্মাণ বা আরামদায়ক বিছানা আর ভোগবিলাসে মত্ত হবে? যে দুনিয়ায় এসেছে, সে আখিরাতের দিকে যাচ্ছে। সেখানেই তার গন্তব্য। গন্তব্যে পৌঁছানোর আগে আরাম করা বুদ্ধিহীনের কাজ। যে ব্যক্তি পথে আরামে পড়ে থাকবে, সে কীভাবে গন্তব্যে পৌঁছাবে?

দুনিয়ার ব্যাপারে রাসূল সা:-এর অবস্থান সম্পর্কে ইবনুল কাইয়িম রহ: বলেন, দুনিয়াকে তার যাবতীয় নিয়ামতসহ সামগ্রিকভাবে রাসূল সা:-এর সামনে পেশ করা হয়েছিল এবং দুনিয়া স্বয়ং নিজেও নিজকে রাসূল সা:-এর সামনে উপস্থাপন করেছিল। কিন্তু তিনি দু’হাত দিয়ে দুনিয়াকে দূরে ঠেলে দিলেন। দুনিয়াকে তাঁর পশ্চাতে ফেলে দিলেন। তারপর দুনিয়াকে পেশ করা হয়েছে তাঁর সাহাবায়ে কেরামের সামনে এবং দুনিয়া নিজেও উপস্থিত হয়েছে তাঁদের সামনে। সাহাবায়ে কেরামের মধ্য থেকে অনেকে পূর্ণরূপে রাসূল সা:-এর পথ অনুসরণ করেছেন। অর্থাৎ- তারা দুনিয়াকে দু’হাত দিয়ে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। তারা দুনিয়াকে গ্রহণ করেননি। তবে তাদের সংখ্যা কম। আর অনেক সাহাবায়ে কেরামের সামনে দুনিয়া পেশ হলে তারা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন- হে দুনিয়া! তোমার মাঝে কী কী আছে? দুনিয়া জবাব দিলো, হালাল আছে, সন্দেহযুক্ত জিনিস আছে, মাকরুহ আছে, সম্পূর্ণ হারামও আছে। তারা বললেন, তুমি শুধু তোমার হালালগুলোই আমাদের দাও। এছাড়া আর যা কিছু আছে তাতে আমাদের কোনো প্রয়োজন বা আগ্রহ নেই। এ শ্রেণীর সাহাবায়ে কেরাম কেবল দুনিয়ার হালালগুলোই গ্রহণ করেছেন। (আদ্দুনইয়া ওয়া হাকিকতুহা)

রাসূল সা: আখিরাতের প্রস্তুতি নেয়ার জন্যও উৎসাহ দিয়েছেন এবং দুনিয়ার জীবন থেকে পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করতে বলেছেন। দুনিয়ার জীবন যেহেতু তার বাসিন্দাদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। তাই হাসান বসরি রহ. বলেছেন, ‘তোমরা পার্থিব জীবনের ব্যস্ততা থেকে দূরে থাকো। দুনিয়া হলো ব্যস্ততার আখড়া। কেউ যখন ব্যস্ততার একটি দরজা খোলে, তা তার জন্য আরো ১০টি দরজা খুলে দেয়।’ (আনু নুআইম, হিলইয়াতুল আওলিয়া-২/১৫৩) রাসূল সা: বলেছেন, ‘তুমি দুনিয়ার জীবনে এমনভাবে থাকো, যেন তুমি একজন আগন্তুক বা পথচারী।’ (বুখারি-৬৪১৬) তিনি আরো বলেছেন, ‘তোমরা জীবনের স্বাদ হরণকারী মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করো।’ (সুনানে তিরমিজি-২৩০৭)

দুনিয়া হলো পরকালের আবাদ-ভূমি। রাসূল সা: বলেছেন, ‘দুনিয়া আখিরাতের শস্যক্ষেত্র’। (তিরমিজি-২৩২৩) দুনিয়ায় মানুষ আখিরাতের জন্য বীজ বপণ করে। সুতরাং দুনিয়াতে থাকা অবস্থায় আখিরাতের ফসল ফলাতে হবে। তাই দুনিয়ার জীবন কাটানো উচিত আল্লøাহর ইবাদত ও আনুগত্যে। আর এখানেই পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করে নেয়া উচিত। কেননা, পরকালের পাথেয় সংগ্রহের একমাত্র জায়গা দুনিয়া। পরকালীন সুখ-শান্তি ও দুঃখ-কষ্ট নির্ভর করে দুনিয়াতে মানুষের কাজকর্ম ও জীবনাচারের ওপর। আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘আল্লøাহ তোমাকে যা দান করেছেন তাতে তুমি পরকালের কল্যাণ অনুসন্ধান করো। তবে তুমি দুনিয়া থেকে তোমার প্রাপ্য অংশ নিতে ভুলে যেও না। তোমার প্রতি আল্লøাহ যেরূপ অনুগ্রহ করেছেন তুমিও (মানুষের প্রতি) সেরূপ অনুগ্রহ করো।’ (সূরা কাসাস-৭৭)

প্রকৃত অর্থে দুনিয়া স্বয়ং নিন্দিত বস্তু নয়; বরং প্রশংসা ও নিন্দা উভয়ই দুনিয়ার বান্দার কাজের প্রতি প্রযোজ্য। দুনিয়া আখিরাতের সেতু এবং পারাপারের রাস্তা। দুনিয়া থেকেই জান্নাতের পাথেয় সংগ্রহ করতে হয়। জান্নাতবাসী যে উত্তম জীবন লাভ করবে, তা মূলত দুনিয়ায় তাদের পুণ্যকর্ম ও উত্তম বীজ বপন কার্যের বিনিময়েই অর্জিত হবে। অতএব দুনিয়া হলো নামাজ, রোজা ও আল্লাহ তায়ালার পথে অর্থব্যয়ের স্থান এবং কল্যাণমূলক কাজে প্রতিযোগিতার সাথে ধাবিত হওয়ার স্থান। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করার তাওফিক দান করুন।

লেখক : সম্পাদক, মাসিক সারস