সিইসিকে জামায়াতের ১৮ দফা

আরপিও’র সংশোধিত ২০ নং অনুচ্ছেদ বহাল রাখার দাবি

Printed Edition
নির্বাচন কমিশনের সাথে বৈঠকে মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ জামায়াতে ইসলামীর নেতারা : নয়া দিগন্ত
নির্বাচন কমিশনের সাথে বৈঠকে মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ জামায়াতে ইসলামীর নেতারা : নয়া দিগন্ত

বিশেষ সংবাদদাতা

  • নভেম্বরেই গণভোট দিতে হবে
  • কেন্দ্রের নির্বাচনী বুথে সিসি ক্যামেরা স্থাপন
  • বিতর্কিতদের নির্বাচনী দায়িত্ব দেয়া যাবে না

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির পরেই আগামী নভেম্বরে গণভোটের আয়োজন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ২০ নং অনুচ্ছেদের সর্বশেষ সংশোধনীর বিধান অনুযায়ী প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকে তাদের নিজস্ব দলীয় প্রতীক ব্যবহার করতে হবে- এই বিধান বহালসহ ১৮ দফা লিখিত দাবি নির্বাচন কমিশনের কাছে জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, একটি দলের পক্ষ থেকে আরপিও’র সংশোধিত ২০ নং অনুচ্ছেদে আপত্তি দেয়াটা অ্যালার্মিং। আর একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট হলে নির্বাচন কেন্দ্রে সহিংসতা সৃষ্টি হতে পারে। দু-চারটা কেন্দ্রে ভোট বন্ধ হলে গণভোটের দশা কী হবে? এমন টেকনিক্যাল সমস্যা আলোচনা করা হয়।

রাজধানীর আগারগাঁওস্থ নির্বাচন ভবনে সভাকক্ষে গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিনের সাথে বৈঠক করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী লিখিত ১৮ দফা পেশ করেছে। দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার স্বাক্ষরিত ওই লিখিত দাবিগুলো তারা সিইসিকে প্রদান করেন। এতে চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিব ও অন্যান্য কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের নেতৃত্বে জামায়াতের সাত সদস্যের প্রতিনিধিদলে ছিলেন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মা’ছুম, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান ও ড. হামিদুর রহমান আযাদ, কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুল, ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমির মো: সেলিম উদ্দিন। পরে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বৈঠকের আলোচনা নিয়ে সাংবাদিকদেরকে ব্রিফিং করেন। তিনি ১৮ দফার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তুলে ধরেন। মিয়া গোলাম পরওয়ার সাংবাদিকদেরকে বলেন, নির্বাচন কমিশন জামায়াতে ইসলামী নেতৃবৃন্দের বক্তব্য শোনেন এবং বলেন, জামায়াতের দাবিগুলো যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত। কমিশন এসব বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে আশ্বাস প্রদান করেন।

আরপিও’র সংশোধনীর আপত্তি অ্যালার্মিং : বিএনপির সমালোচনা করে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, সংসদ নির্বাচনের চার মাস আগেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নষ্টের প্রবণতা দেখা গেছে। আমরা নির্বাচন কমিশনকে বলেছি, যেই বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে সেখানে তারা যেন অটল থাকেন। সম্প্রতি একটি দলের (বিএনপি) পক্ষ থেকে এসে এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে আপত্তি জানানো এবং তা পরিবর্তনের দাবি তোলার বিষয়টিকে ‘খুবই দুর্ভাগ্যজনক’ মনে করে জামায়াত। তার অভিযোগ, জেন্টলম্যান অ্যাগ্রিমেন্ট-এর মাধ্যমে আরপিও সংশোধনীর পরিবর্তনের প্রচেষ্টা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড লঙ্ঘনের খারাপ উদাহরণ। জামায়াত এই আপত্তি দেয়াকে অ্যালার্মিং এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অশনি সঙ্কেত হিসেবে দেখছে। তারা এই সংশোধিত বিধান বহাল রাখার দাবি করেছে।

তিনি বলেন, ইসিকে অবশ্যই জুলাই সনদ ও সংস্কারের বিষয়গুলো পাবলিক করতে হবে যাতে ভোটাররা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। গণভোট আয়োজনে ইসির পক্ষ থেকে কোনো চ্যালেঞ্জ বা অক্ষমতার কথা জানানো হয়নি বলে জামায়াত নেতারা জানান। এ ছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)-এর সর্বশেষ সংশোধনে জোটবদ্ধ প্রত্যেক দলকে নিজ নিজ নির্ধারিত প্রতীকে ভোট করতে হবে বলে যে বিধান অনুমোদিত হয়েছে, জামায়াত তার পক্ষে রয়েছে। তারা নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব এবং উপদেষ্টা পরিষদের সংশোধিত সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন।

তালিকা দেয়া প্রসঙ্গে বিএনপিকে জবাব : বিএনপির সমালোচনায় দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল এবং ইবনে সিনা হাসপাতালের সাথে জামায়াতের কোনো ধরনের মালিকানার সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, বিএনপির দাবি আমাদের জন্য দুঃখজনক। এটার ঘোর আপত্তি জানাই। ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনার মতো প্রতিষ্ঠানের সাথে জামায়াতের কোনো মালিকানার সম্পর্ক নেই। তারা এটা বিতর্কিত করছে। তিনি বলেন, বিএনপিও অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান চালায়। আমরাও অভিযোগ দিতে পারতাম। কিন্তু আমরা তা করিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে ইসলামী ব্যাংকসহ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তাদের নিয়োগ না দেয়ার বিষয়ে আপত্তি প্রসঙ্গে জামায়াত এটিকে দুঃখজনক এবং অরাজনৈতিক চিন্তা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। জামায়াত দাবি করেছে যে তারা যে প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা বলেছে তার কোনো একটারও মালিকানার সাথে জামায়াতে ইসলামীর কোনো সম্পর্ক নেই। তারা এটিকে ব্যাড ট্রেডিশন আখ্যা দিয়ে বলেছে, পাল্টা বিবৃতি বা তালিকা দেয়া রাজনৈতিক শিষ্টাচার নয়।

ইসিতে দেয়া জামায়াতে ইসলামীর ১৮ দফা : জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদানের লক্ষ্যে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির পরেই আগামী নভেম্বরে গণভোটের আয়োজন করতে হবে। উপদেষ্টা পরিষদে গৃহীত সর্বশেষ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ২০ নং অনুচ্ছেদের সর্বশেষ সংশোধনীর বিধান অনুযায়ী প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকে তাদের নিজস্ব দলীয় প্রতীক ব্যবহার করতে হবে। অন্য কোনো দলের প্রতীক ব্যবহার করতে পারবেন না। এ বিধান বহাল রাখতে হবে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের জোটগতভাবে নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করার বিধান অন্তর্ভুক্তির জন্য নির্বাচন ব্যবস্থা সংক্রান্ত সংস্কার কমিশনই সুপারিশ করেছে। ফলে এই বিধান কোনো ক্রমেই পরিবর্তন করা যাবে না। সংশোধিত বিধানই বহাল রাখতে হবে।

নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের প্রত্যেক স্তরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শত ভাগ নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনী কাজের জন্য নিযুক্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যথা প্রিজাইডিং, পোলিং, আনসার, আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত বাহিনীকে নিয়োগের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। সব ভোটকেন্দ্রে পর্যাপ্ত পরিমাণ সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগ করতে হবে। সব ভোটকেন্দ্রের নির্বাচনী বুথে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। বিগত অবৈধ নির্বাচনগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল এমন সব প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত কর্মকর্তা কর্মচারীদের আগামী নির্বাচনে নির্বাচনী দায়িত্ব দেয়া যাবে না। শত ভাগ লটারির ভিত্তিতে মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা (ডিসি, এসপি, ইউএনও এবং ওসি) নিয়োগ দিতে হবে। দলটি বলেছে, রিটার্নিং অফিসার এবং সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রশাসনের অফিসারদের সাথে সাথে সাধ্য মতো বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্যে থেকেও নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সৎ, দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। সব ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনের কমপক্ষে এক সপ্তাহ আগে সামরিক বাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা প্রদান নিশ্চিত করে নির্বাচনী মাঠ সমতল করতে হবে।

সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা সব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। এ ছাড়া বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে দলীয় লোকদের রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করে তা সরকারের কাছে জমা দিতে হবে। নির্বাচনী এলাকাগুলোতে যারা অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে সন্ত্রাস ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে থাকে তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে হবে।

ভোটারদের নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে আসা-যাওয়ার সুবিধার্থে ভোটকেন্দ্রের নির্ধারিত এলাকার মধ্যেই শুধু নয় বরং এর বাইরেও নির্বাচনী এলাকার যেকোনো স্থানে সন্ত্রাসী তৎপরতার খবর পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক তা দমন করতে হবে। ছবিসহ ভোটার তালিকায় ভোটারদের ছবি পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না। তাই স্পষ্ট ছবিসহ ভোটার তালিকা পোলিং এজেন্টদেরকে যথাসময়ে সরবরাহ করতে হবে। নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত পোলিং, প্রিজাইডিং অফিসার, আনসার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাইকে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে তাদের ভোট প্রদানের সুযোগ দিতে হবে। প্রবাসীদের ব্যাপারে বলেছে, প্রবাসী ভোটারদের ভোট প্রদানের পদ্ধতি সহজ করার জন্য ভোটার আইডি কার্ড বা পাসপোর্ট যেকোনো একটির মাধ্যমে ভোট প্রদানের সুযোগ দিতে হবে। রেজিস্টার্ড প্রবাসী ভোটারদের তালিকা রাজনৈতিক দলগুলোকে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সরবরাহ করতে হবে। নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও নিরপেক্ষতা যাচাই করতে হবে। ফ্যাসিস্ট আমলে নিজেদের সুবিধা মতো ভোটকেন্দ্র পরিবর্তন করা হয়েছে। তাই অভিযোগ বিবেচনায় নিয়ে সেগুলো এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র পরিবর্তন করতে হবে।