নিজস্ব প্রতিবেদক
মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা করা হবে আগামী ১৩ নভেম্বর। গতকাল বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ কথা জানিয়েছে। এ দিন তার বিরুদ্ধে মামলায় আদালতে শুনানি পর্ব শেষ হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ তিন বিচারপতির বেঞ্চে হাসিনার বিরুদ্ধে মামলাটি চলছে। বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম মর্তুজার নেতৃত্বাধীন ওই বেঞ্চে রয়েছেন বিচারপতি মোহাম্মদ শফিউল আলম মাহমুদ এবং বিচারক মোহম্মদ মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। হাসিনাসহ মোট তিন জন অভিযুক্ত রয়েছেন এ মামলায়। অপর দু’জন হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। মামুন বর্তমানে এ মামলায় নিজের দোষ স্বীকার করে রাজসাী হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার আদালতে যুক্তিতর্ক পর্বের কোজিং স্টেটমেন্ট পেশ করেন রাষ্ট্রপরে প্রধান আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল মো: আসাদুজ্জামান। হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সর্বোচ্চ শাস্তির (মৃত্যুদণ্ড) দাবি জানান তিনি। বাংলাদেশের ঘোষিত ‘পলাতক’ দুই অভিযুক্ত হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হয়ে আদালতে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপ নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। তিনি দুই অভিযুক্তের খালাসের আর্জি জানান। পরে ট্রাইব্যুনাল জানায়, আগামী ১৩ নভেম্বর হাসিনাদের বিরুদ্ধে মামলায় রায় ঘোষণার দিন জানানো হবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল শুরুতেই পবিত্র কুরআনের সূরা নিসাসহ দু’টি সূরার আয়াতের রেফারেন্স টেনে আনেন। তিনি বলেন, আজ আমি ন্যায়বিচার প্রত্য করতে ও সাী হতে এসেছি। এ মামলায় সব ধরনের দালিলিক-মৌখিক প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন প্রসিকিউশন প। তবে আসামিরা কোনো নির্দেশ দেননি, বলেননি যুক্তি দেখিয়েছেন স্টেট ডিফেন্স। ভাগ্যিস বলেননি এ দেশে কোনো জুলাই রেভ্যুলেশন হয়নি, কেউ মারা যাননি কিংবা আহত হননি। অথচ বাংলাদেশে ১,৪০০ মানুষ মারা গেলেন। এত বড় একটা জুলাই রেভ্যুলেশন হলো। হত্যাকাণ্ড হলো সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় স্টেট অ্যাপারেটাস (রাষ্ট্রযন্ত্র) ব্যবহার করে।
এক পর্যায়ে তিনি বলেন, বিচার যত কঠিনই হোক যত বাধার প্রাচীর আসুক, সব বাধার প্রাচীর ভেঙে যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না হয় তাহলে আমরা জাতি হিসেবে আগামী দিন এগোতে পারব না। আমি একটা বিচারের মানদণ্ড তুলে ধরতে চাই। ১৯৫১ সালে মাত্র এক মাসের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করেছিলেন আমেরিকান আদালত। সেই বিচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন জুলিয়াস রোজেনবার্গ ও ইথেল রোজেনবার্গ। এ দম্পতির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যারা দেশের বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে গুপ্তচর ভিত্তি করে যার কারণে কোরিয়া দ্বীপে লাখ লাখ নিরীহ মানুষ মারা গেছেন। তাদের বিচার প্রক্রিয়ায় আমেরিকার সিভিল সোসাইটি থেকে শুরু করে গোটা বিশ্ব জেগে উঠেছিল। সব নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীরা এর বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। খালাস দিতে বলেছিলেন। এ বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে ফ্রান্সের সাথে আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার অবস্থা গিয়েছিল। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে তাদেরও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। দু’জন মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর অবশ্যই একটি বড় ঘটনা। আমরাও মনে করি নিশ্চয়ই এ আসামিদের মৃত্যুদণ্ড দাবি করা, মৃত্যুদণ্ড হওয়া, কার্যকর হওয়া।
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মানবতাবিরোধী অপরাধে বিভিন্ন দেশে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া কয়েকজন সরকারপ্রধানের তথ্য ট্রাইব্যুনালে জমা দেন। তাদের মধ্যে জাপানের প্রধানমন্ত্রী, হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজনের কথা উল্লেখ আছে। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। বিচারের মুখোমুখি হওয়া প্রসঙ্গে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘তিনি (শেখ হাসিনা) আরেক জনকে বলেছিলেন সাহস থাকলে যেন দেশে এসে বিচারের মুখোমুখি হন। আমি সেটা বিশ্বাস করেছিলাম, তিনি এটা মন থেকে বলেছেন। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি মন থেকে বলেননি।’ শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে ইঙ্গিত করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, যদি এ আসামিদের মৃত্যুদণ্ড হয়, তাহলে অনেকেই প্রতিবাদ করবেন। এ দুইজনের যদি বিচার না হয়, তাহলে বাংলাদেশের মানুষ ভীরু-কাপুরুষ হয়ে উপহাসের পাত্র হয়ে থাকবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল আরো বলেন, ন্যায় শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে এ আসামিদের হাতে বাংলাদেশের অসংখ্য-অগণিত মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। তাদের হাতে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাবে। পাঁচ বছরের শিশু মারা যাবে। ১০ বছরের আনাস মারা যাবে। পানি বিতরণ করা অবস্থায় মুগ্ধ মারা যাবে। বুক চিতিয়ে আবার রাজপথে দাঁড়িয়ে আবু সাঈদরা মারা যাবেন। আমরা যদি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে না পারি বা এ দু’জনের বিচার ব্যাহত হয় অথবা শাস্তি না হয় যেটা আইনে প্রেসক্রাইব করা আছে। তাহলে বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাসে একটি ভীরু কাপুরুষের উপমা হয়ে রয়ে যাবে। সে কারণেই আমরা মনে করি এ বিচারে আমরা যা প্রমাণ করেছি সেটা বিয়ন্ড অল রিজনেবল ডাউট (এ নিয়ে কোনো যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ নেই)। আসামিদের প্রতি আকাক্সা রেখে আসাদুজ্জামান বলেন, আমি প্রত্যাশা করি ন্যায়বিচারের মানদণ্ড নিশ্চিত করতে হলে এ আসামিরা বলবেন যেমন বলেছিলেন জুলিয়াস নিজের আইনজীবীর মাধ্যমে। তিনি গোটা বিশ্বকে জানিয়েছিলেন স্বাধীনতা ও অন্য যেসব জিনিস জীবনকে সত্যিই সুন্দর-সার্থক করে তোলে তা পাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে খুব বেশি মূল্য দিতে হয়। তারা হয়তো এমন একটি উক্তি দিয়েই এ বিচারের রায় মেনে নেবেন। অন্য কোনো পথ বেছে নেবেন না। অন্য কোনো পথে তারা হাঁটবেন না। যেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাসযোগ্য ভূমি গড়ে তোলা যায়। সবশেষ ট্রাইব্যুনালের কাছে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ সাজা প্রার্থনা করেন দেশের এ সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা। এ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, কোন প কী উপস্থাপন করল, কে কী বলল তা বড় কথা নয়; ট্রাইব্যুনাল ন্যায় বিচার নিশ্চিত করবে। অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য শেষ হলে ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসূলি মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম উঠে আদালতের অনুমতি নিয়ে শেখ হাসিনার আইনজীবীর যুক্তিতর্কে দেয়া বক্তব্যের জবাব দেন। শেখ হাসিনার আইনজীবী বলেছিলেন, ‘এ আইনে বিচার করা মানে আসামিকে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে বলা, ‘সাঁতার কাটো’।’ তিনি বলেন, এ আইনটি (আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন, ১৯৭৩) রোম স্ট্যাটিউটের সাথে ‘কমপেটিবল’ করা হয়েছে। সংবিধান এ আইনকে ‘প্রটেকশন’ দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আইনটির ১৯ ধারার কথা উল্লেখ করেন প্রধান কৌঁসূলি তাজুল। এ ছাড়া ভিডিও, অডিও যাচাইয়ের েেত্র এনটিএমসি, বিবিসি এবং আল জাজিরার সঠিকতা যাচাইয়ের কথা উল্লেখ করেন। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, যারা এখানে আসামি হয়েছেন, তাদের (শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান) মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। এত বড় অপরাধ করেছেন, দুনিয়ার সবাই জানে এ অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তিনিও জানেন; কিন্তু কখনোই তার মধ্যে কোনো ধরনের অনুশোচনা পরিলতি হয়নি। উল্টো তিনি যারা তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, স্যা দিচ্ছেন, তাদের হত্যা করার হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করে দেয়ার কথা বলছেন। তাদের লাশগুলো বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেয়ার কথা বলছেন।
সেনাবাহিনীকে উসকে দেয়ার চেষ্টা করেছেন হাসিনা : তাজুল ইসলাম বলেন, সর্বশেষে তিনি (শেখ হাসিনা) রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে গণ্ডগোল লাগানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি সেনাবাহিনীকে উসকে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। সেনাবাহিনীকে বলার চেষ্টা করেছেন, তোমাদের অফিসারদের বিচার হয়, তোমরা কেন রুখে দাঁড়াচ্ছ না? রাষ্ট্রের মধ্যে একটা সিভিল ওয়ার (গৃহযুদ্ধ) লাগানোর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী সে পাতা ফাঁদে পা দেয়নি। বাংলাদেশের জনগণ সে পাতা ফাঁদে পা দেয়নি। যারা পারপিট্রেটর (অপরাধী) ছিল, তাদের বিচারের মুখোমুখি করার জন্য তাদের অঙ্গীকারের প্রতি দৃঢ় আছেন। আদালতে তাদের নিয়ে এসেছেন। বিচারের প্রক্রিয়া স্মুথলি সামনে পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কোনো উসকানিতে কেউ পা দেয়নি। চিফ প্রসিকিউটর আরো বলেন, এ রকম নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ, পুরো প্রজন্মকে হত্যা করে ফেলার চেষ্টা, ৩৫ হাজার মানুষকে আহত করা, অঙ্গহানি করা, এরপরও সামান্যতম রিমোর্স (অনুশোচনা) না থাকা। এখানে শিশু ছিল, নারী ছিল, মজুর ছিল, ছাত্ররা ছিল, তাদের হত্যা করতে তার বুক কঁাঁপেনি। এখন পর্যন্ত তার মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। সুতরাং সর্বোচ্চ শাস্তিটা তার অবশ্যই প্রাপ্য। সব শেষে শেখ হাসিনার পে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, ‘মাননীয় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, আমার আসামি পালিয়ে গেছেন। আমি বলতে চাই, তিনি পালিয়ে যাননি। তাকে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল।’ শেখ হাসিনাকে দেশে এনে বিচারের মুখোমুখি করার বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য প্রসঙ্গে আমির হোসেন বলেন ‘যে কারণে ওই ব্যক্তি (তারেক রহমানকে ইঙ্গিত করে) দেশে আসেননি, আমার আসামিও সে কারণে দেশে আসছেন না।’ এরপর ট্রাইব্যুালের চেয়ারম্যান এ মামলার রায়ের তারিখ আগামী ১৩ নভেম্বর জানানো হবে বলে জানান।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র দুই হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দতালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি চার হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার ও শহীদদের তালিকার বিবরণ দুই হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার। সাী করা হয়েছে ৮১ জনকে। গত ১২ মে চিফ প্রসিকিউটরের কাছে এ মামলার প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।



