বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন প্রবিধান

পরিচালক পদে রাজনৈতিক বা স্বজনপ্রীতি করা যাবে না

Printed Edition

বিশেষ সংবাদদাতা

পতিত হাসিনা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এস আলম, নজরুল ইসলাম মজুমদার, সালমান এফ রহমানের মতো মাফিয়ারা দেশের ব্যাংক খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। মাফিয়া এস আলমের দখলেই নেয়া হয় সাতটি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। পছন্দের লোকজনকে পরিচালক পদে বসিয়ে জনগণের আমানতের অর্থ পাচার করা হয়েছে। এতে দেশের আর্থিক খাত নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম, খেলাপি ঋণ, তারল্য সঙ্কট ও সুশাসনের ঘাটতি নিয়ে জনমনে উদ্বেগ এখনো কাটেনি। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্যা দ্রুত ও কার্যকরভাবে সমাধান করার ল্েয বাংলাদেশ ব্যাংক রেগুলেশন ফর ব্যাংক রেজুলেশন নামক নতুন এক প্রবিধানমালা গতকাল জারি করেছে।

ব্যাংক রেজুলিউশন অধ্যাদেশ ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়া : সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ব্যাংক রেজুলিউশন অধ্যাদেশ’ প্রণয়ন করেছে, যা দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে একটি বড় পরিবর্তন হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর আর্থিক সঙ্কট দেখা দিলে দ্রুত পুনর্গঠন, একীভূতকরণ বা লিকুইডিশন প্রক্রিয়া কার্যকরভাবে সম্পাদনের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

অতীতে কোনো ব্যাংক আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লে সমাধান প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও জটিল ছিল। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি হস্তপে করে প্রয়োজনীয় রেজুলিউশন কমিটি গঠন করতে পারবে, যাতে আমানতকারীদের স্বার্থ তিগ্রস্ত না হয়। বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংকসহ তফসিলি ব্যাংকগুলোকে আর্থিক শৃঙ্খলার মধ্যে রাখাই এই প্রবিধানের অন্যতম উদ্দেশ্য।

শাসনকাঠামো ও পরিচালনা পর্ষদে নতুন নির্দেশনা : নতুন প্রবিধান অনুযায়ী, প্রতিটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য সংখ্যা, যোগ্যতা ও দায়িত্ব নির্ধারণে কঠোর নিয়ম আরোপ করা হয়েছে। পরিচালক পদে রাজনৈতিক বা স্বজনপ্রীতির বদলে দতা ও অভিজ্ঞতাকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। এ ছাড়া ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী (সিইও) ও পরিচালক পর্ষদের মধ্যে ভূমিকা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে ব্যবস্থাপনায় সঙ্ঘাত বা অনিয়ম না ঘটে। প্রতিটি ব্যাংকে অডিট কমিটি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটি বাধ্যতামূলকভাবে গঠন করার নির্দেশও দেয়া হয়েছে।

খেলাপি ঋণ ও ঋণ পুনঃতফসিলের নিয়ন্ত্রণ : বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন প্রবিধানে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এখন থেকে কোনো ব্যাংক ঋণ অবলোপনের আগে সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে লিখিতভাবে জানাতে বাধ্য থাকবে এবং সেই ঋণ আদায়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের উৎসাহ দিতে প্রণোদনা দেয়া হবে।

এ ছাড়া বারবার ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে দায় এড়ানোর সুযোগ সীমিত করা হয়েছে। ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হলে ব্যাংকগুলোকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আইনি পদপে নিতে হবে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া আরো গতিশীল হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

প্রযুক্তি ও সাইবার নিরাপত্তা বিধান : নতুন প্রবিধানে ডিজিটাল ব্যাংকিং ও অনলাইন লেনদেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও জোর দেয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোকে এখন থেকে সাইবার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ইউনিট গঠন করতে হবে এবং প্রতিটি অনলাইন লেনদেনের জন্য উন্নত এনক্রিপশন ব্যবস্থার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

একই সাথে ফিনটেক ও এমএফএস (মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস) প্রতিষ্ঠানের সাথে ব্যাংকগুলোর আন্তঃলেনদেন কার্যক্রমের ওপর কঠোর তদারকি চালাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে করে মানি লন্ডারিং, হ্যাকিং ও জালিয়াতির ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস পাবে।

জনআস্থা পুনরুদ্ধারের প্রত্যাশা : নতুন এসব প্রবিধানের ফলে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ও দায়বদ্ধতা বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক খাত নিয়ে সাধারণ মানুষের যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছিল, তা দূর করতে এ পদপে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

ব্যাংক বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, এসব প্রবিধান শুধু নিয়ন্ত্রণের জন্য নয়; বরং ব্যাংকগুলোকে আরো প্রতিযোগিতামূলক ও জনগণের আস্থার জায়গায় উন্নীত করাই এর মূল উদ্দেশ্য।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন প্রবিধানগুলো দেশের আর্থিক ব্যবস্থাকে আধুনিক ও স্বচ্ছ করার দিকে একটি বড় পদপে। এতে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। যদি এসব বিধান কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে ব্যাংক খাতে নতুন আস্থার যুগ সূচিত হবে, যা টেকসই উন্নয়ন ল্যমাত্রা অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।