বিবিসি
ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। এক দিকে সরকারকে সহযোগিতা করে আসা তিন প্রভাবশালী দল- বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখন একই সাথে সরকারের কিছু উপদেষ্টার বিরুদ্ধে পক্ষপাত, ষড়যন্ত্র ও স্বার্থ রক্ষার অভিযোগ তুলছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে প্রশাসনিক নিয়োগ, রদবদল ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারই দলগুলোর প্রধান উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।
বিএনপির অভিযোগ : প্রশাসনে পক্ষপাতের ইঙ্গিত
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। দলের অভিযোগ, পাঁচ আগস্টের পর প্রশাসনে যেসব রদবদল বা পদায়ন হয়েছে, সেখানে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।
দলীয় সূত্র বলছে, বিএনপি ইঙ্গিত করছে জামায়াতে ইসলামীর দিকেই। তাদের অভিযোগ, কিছু উপদেষ্টা ওই দলের পক্ষে প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করছেন।
স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, কিছু উপদেষ্টার বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
জামায়াতের পাল্টা অভিযোগ : ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’
অন্য দিকে জামায়াতে ইসলামী সরকারে থাকা কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার’ অভিযোগ তুলেছে।
নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো: তাহের এক মানববন্ধনে বলেন, ‘আমাদের কাছে কিছু উপদেষ্টার বৈঠকের রেকর্ড আছে। তারা একটি বিশেষ দলের হয়ে কাজ করছেন।’
পরদিন দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার একই অভিযোগ করেন, দাবি করেন- কিছু উপদেষ্টা ‘একটি দলের সাথে গোপন যোগাযোগ রেখে’ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে বিভ্রান্ত করছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, জামায়াতের এই ‘বিশেষ দল’ বলতে বিএনপিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
এনসিপির ক্ষোভ : ‘সেফ এক্সিট’ ইস্যু
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্র নেতৃত্বের দল এনসিপি, যারা অন্তর্বর্তী সরকারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে বিবেচিত, তারাও এখন সরকারের কিছু উপদেষ্টার ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
দলটির সাবেক উপদেষ্টা ও বর্তমান নেতা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘উপদেষ্টাদের কেউ কেউ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে লিয়াজোঁ করে নিজেদের সেফ এক্সিটের চিন্তা করছে’।
এনসিপি সদস্যসচিব আখতার হোসেনও দাবি করেছেন, ‘সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা বিশেষ একটি দলের প্রতি পক্ষপাত দেখাচ্ছেন’।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এনসিপির ক্ষোভের আরেকটি কারণ হলো নির্বাচন কমিশনে দলটির প্রতীক নিবন্ধন এখনো ঝুলে থাকা।
সরকারের প্রতিক্রিয়া : ‘সব অভিযোগই রাজনৈতিক’
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘যখন বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি- সবাই সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে, তখনই বোঝা যায় সরকার নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে।’
তিনি বলেন, দলগুলো তাদের দলীয় স্বার্থে কথা বলছে। আমরা সবার স্বার্থ বিবেচনায় নিয়েই নির্বাচন আয়োজন করছি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ : অভিযোগের পেছনে ক্ষমতার সমীকরণ
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘নির্বাচনের আগে প্রশাসন ও ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ঘিরেই এই বিরোধ। প্রতিটি দলই চায় তাদের প্রভাব বজায় থাকুক।’ অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ মনে করেন, দেশের রাজনীতিতে দলীয় ট্যাগিং ও সন্দেহের সংস্কৃতি এখনো কাটেনি। নতুন রাজনীতির কথা বলা হলেও পুরনো মানসিকতা থেকে দলগুলো মুক্ত হতে পারেনি।
সব দলের অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দু প্রশাসন যেখানে পদায়ন, নিয়োগ ও রদবদল ঘিরে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা তীব্র হচ্ছে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, এই পাল্টাপাল্টি অভিযোগও তত বাড়ছে। প্রশ্ন এখন একটাই- অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার কি সব পক্ষের আস্থা নিয়ে একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে?



