ভেঙে পড়ছে ফটিকছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সেবা

Printed Edition

আজগর আলী ফটিকছড়ি (চট্টগ্রাম)

চট্টগ্রাম বিভাগের শ্রেষ্ঠ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হিসেবে স্বীকৃত ফটিকছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এখন ভয়ের ও বিশৃঙ্খলার প্রতীক। জনবল সঙ্কট, অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও স্থানীয় কিছু গোষ্ঠীর অপতৎপরতায় সরকারি স্বাস্থ্যসেবা আজ চরম সঙ্কটে।

১৬ অক্টোবর বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে চিকিৎসা নিতে আসা সহস্রাধিক রোগী যেমন অনিশ্চয়তায় ভুগছেন, তেমনি চিকিৎসক-নার্সরাও এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। পুলিশি পাহারায় চলছে চিকিৎসা সেবা। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার প্রায় সাত লাখ ও পাশের হাটহাজারী উপজেলার ফরহাদাবাদ, ধলই ও মির্জাপুর ইউনিয়নের প্রায় এক লাখসহ মোট আট লাধিক মানুষ এই হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এত বড় জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা এখন কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, প্রতি মাসে গড়ে ২২ হাজার রোগী চিকিৎসা নিতে আসে। অথচ ৫০ শয্যার এই হাসপাতালে বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র পাঁচজন কনসালট্যান্ট, ১৮ জন মেডিক্যাল অফিসার, তিনজন উপসহকারী মেডিক্যাল অফিসার ও ১৪ জন নার্স।

ভারপ্রাপ্ত উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: মনৌজ চৌধুরী জানান, প্রতিদিন প্রায় ৮০০ রোগীকে সেবা দিতে হয়। প্রতি মাসে তিন শতাধিক নরমাল প্রসব ও প্রতি মাসে গড়ে ৩০টির বেশি সিজার সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু জনবল সঙ্কট ও সীমিত অবকাঠামোর কারণে আমরা ভীষণ চাপে আছি। তিনি আরো জানান, হাসপাতালটি ১০০ শয্যায় উন্নীত হওয়ার কথা থাকলেও এখনো ৫০ শয্যা নিয়েই চলছে, তাও মাত্র ৩১ শয্যার অনুমোদিত জনবল দিয়ে।

হাসপাতাল চত্বরে দেখা যায়, বহিরাগতদের আনাগোনা, ভাঙাচোরা ভবন, অপ্রতুল যন্ত্রপাতি, ওষুধের সঙ্কট, আর তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর অভাব। তবে চিকিৎসকদের সবচেয়ে বড় ভয় এখন স্থানীয় কিছু গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তার ও অপতৎপরতা। হাসপাতালে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর দাবি, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর থেকে কিছু বহিরাগত ব্যক্তি সামাজিক সংগঠনের নেতা পরিচয়ে হাসপাতালে ঢুকে চিকিৎসা সেবায় হস্তপে শুরু করেছে। তারা চিকিৎসকদের ওপর খবরদারি, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, এমনকি শারীরিকভাবে হেনস্তাও করছে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাদের বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।

একজন চিকিৎসক ােভ প্রকাশ করে বলেন, চিকিৎসার চেয়ে এখন নিরাপত্তাহীনতাই বড় সমস্যা। প্রতিদিনই কোনো না কোনো হুমকির মুখে থাকতে হয়। উপস্থিত ফটিকছড়ি থানার ওসি নুর আহমদ জানান, স্থানীয় কিছু ব্যক্তি হাসপাতালের সামনে কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। আইন-শৃঙ্খলার অবনতি রোধে আমরা তাৎণিকভাবে পুলিশ টিম নিয়ে উপস্থিত হই, যাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকে ও কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে।

জানা যায়, স্থানীয় একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালের বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রভাব বিস্তার করছে। ২০২৪ সালের আগস্টের পর তাদের দৌরাত্ম্য আরো বেড়ে যায়। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে তাদের মানহানি করছে। চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা: মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কিছু গোষ্ঠী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাদের বিষয়ে তদন্ত চলছে, দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। সাবেক উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা: সৌনেম বড়ুয়া বলেন, উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা না বুঝে চিকিৎসকদের হয়রানি করা অত্যন্ত দুঃখজনক। চিকিৎসকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে জরুরি।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি হাসপাতালের সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। তারা দাবি করছে সব পরীা বিনামূল্যে করা, চিকিৎসকদের বদলি দেয়া এবং রোগীর সহযোগীদের জন্য খাবার প্রদান করতে হবে। চিকিৎসকরা বলছেন, এসব দাবি বাস্তবসম্মত নয়, বরং চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আরো দুর্বল করে তুলছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, চিকিৎসকদের হয়রানি করার অধিকার কারো নেই। অভিযোগ থাকলে তা প্রশাসনের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে হবে, আইনই তার সমাধান দেবে।

আন্দোলনকারীদের দাবি, এক সপ্তাহের মধ্যে নাজিরহাট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সব চিকিৎসক-কর্মচারী বদলি, হাসপাতালে সব ধরনের ওষুধ সরবরাহ ও কোম্পানির প্রতিনিধিদের প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। ভর্তি রোগীর একজন সহযোগীকেও খাবার দিতে হবে। দাবিগুলো না মানলে হাসপাতালের সামনে অবরোধ কর্মসূচি দেয়া হবে। স্থানীয় সচেতন মহলের দাবি দ্রুত প্রশাসনিক পদপে, নিরাপত্তা জোরদার এবং অপপ্রচার বন্ধ না করলে ফটিকছড়ির সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা পুরোপুরি অচল হয়ে পড়বে।