বিশেষ সংবাদদাতা
মানবিকতা ও ন্যায়ের পক্ষে থাকার কথা যাদের, সেসব কূটনীতি, মানবাধিকার ও নীতি-গবেষণার বিশেষজ্ঞদের একাংশ এখন হয়ে উঠেছেন আরাকান আর্মি (এএ)-এর মুখপাত্র। অর্থ ও প্রভাবের লোভে তারা মাদক বাণিজ্যের অর্থে পরিচালিত এক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে ‘স্থানীয় সরকার’ বা ‘স্থিতিশীলতার অংশীদার’ হিসেবে তুলে ধরছেন।
আরাকান স্ট্র্যাটেজিক ফোরামের নতুন প্রতিবেদন ‘ঞযব উবারষ’ং অফাড়পধঃবং ড়ভ ঞবৎৎড়ৎরংঃ অঅ : ঐড়ি চড়ষরপু চৎধমসধঃরংস ডযরঃবধিংযবং অঃৎড়পরঃু’-এ উঠে এসেছে এ বিষয়টি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব মানুষের জীবন রক্ষা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন (আরাকান) সঙ্কট ঘিরে গড়ে উঠেছে এক ভিন্ন বাস্তবতা।একদল ‘রাখাইন বিশেষজ্ঞ’ এখন আরাকান আর্মির ভয়াবহ অপরাধ আড়াল করে তাদেরকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বৈধতা দিতে ব্যস্ত।
এ নেটওয়ার্কের কয়েকজন পরিচিত মুখ হলেন- থমাস কিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমার-বাংলাদেশ পরামর্শক ও ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমারের সাবেক সম্পাদক; স্টিভ রস স্টিমসন সেন্টার, ওয়াশিংটন ডিসির সিনিয়র ফেলো ও রাখাইন সঙ্কট প্রকল্পের প্রধান; ড. এমা লেসলি সেন্টার ফর পিস এন্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ, কম্পোডিয়ার নির্বাহী পরিচালক ও ইভা বুজো ভিকটিম অ্যাডভোকেটস ইন্টারন্যাশনাল অষ্ট্রেলিয়ার নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকার আইনজীবী।
এ ব্যক্তিরা নীতি বিশ্লেষণ, সাক্ষাৎকার ও ফোরামগুলোর মাধ্যমে আরাকান আর্মিকে ‘শাসনক্ষম শক্তি’ বা ‘মানবিক প্রবেশাধিকারের অংশীদার’ হিসেবে উপস্থাপন করছেন। অথচ বাস্তবে এ গোষ্ঠী সেনাবাহিনীর নির্যাতনের একই ছক অনুসরণ করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা, বাস্তুচ্যুতি ও নিপীড়ন চালিয়েছে।
নৃশংসতা থেকে প্রশাসনে : আরাকান আর্মির রূপান্তরের মুখোশ : প্রতিবেদনে বলা হয়, আরাকান আর্মির অপরাধের তালিকা স্পষ্ট। স্বাধীন মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যে উল্লেখ রয়েছে- ২০২৫ সালের আগস্টে মংডুতে ১৭৫ রোহিঙ্গা হত্যাকাণ্ড, ২০২৪ সালের মে মাসে বুথিডংয়ের থান শুয়ে খানে প্রায় ৬০০ নারী, শিশু ও পুরুষকে হত্যা, দুই লাখের বেশি মানুষ অভ্যন্তরে বাস্তুচ্যুত, এক লাখের বেশি বাংলাদেশে আশ্রয়প্রার্থী।
তবুও ২০২২ সাল থেকে কিছু পশ্চিমা নীতিবিশারদ এ গোষ্ঠীকে ‘ডি ফ্যাক্টো অথরিটি বা প্রোটো-স্টেট’ হিসেবে তুলে ধরেছেন। এর মাধ্যমে অর্থাৎ সন্ত্রাসী নিয়ন্ত্রণকে ‘প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা’ হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে।
স্বাভাবিকীকরণের নকশাবিদরা : প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়- থমাস কিয়ান বলেছেন ঢাকার উচিত আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগ রাখা, কারণ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন তাদের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। স্টিভ রস দাবি করেন- নিরাপত্তা ও প্রত্যাবাসন পরস্পরনির্ভর। এমা লেসলি প্রস্তাব করেছেন-‘সব সংঘাতপক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করে-জাতীয় পুনর্মিলন কমিশন। এসব প্রস্তাব বাস্তবে আরাকান আর্মিকে ‘রাজনৈতিক স্টেকহোল্ডার’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যা তাদের অপরাধের দায় এড়াতে সাহায্য করছে।
নির্বাচিত নৈতিকতার ভণ্ডামি : প্রতিবেদনে বলা হয়, এ তথাকথিত ‘নীতি বাস্তববাদীরা’ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞকে নিন্দা করেন, কিন্তু একই ধরনের নৃশংসতা আরাকান আর্মি করলে তাকে বলেন ‘জাতিগত প্রতিরোধ’ বা ‘স্থানীয় শাসন’। এ যেন নৈতিকতার দ্বৈত মানদণ্ড। সেনাদের বর্বরতা অপরাধ, কিন্তু সন্ত্রাসী বাহিনীর বর্বরতা ‘শান্তি প্রক্রিয়া’র অঙ্গ! তাদের এ দ্বিমুখী অবস্থানই রোহিঙ্গাদের সংগ্রামকে ‘চরমপন্থা’ বলে অবমূল্যায়ন করছে এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আধিপত্যকে বৈধতা দিচ্ছে।
ভাষার রাজনীতি : শব্দচয়নেই তৈরি হয় বৈধতা : প্রতিবেদনে বলা হয়- ‘নন-স্টেট কাউন্টারপার্ট’, ‘প্রোটো-স্টেট’, ‘ডি ফ্যাক্টো অথরিটি’ এসব পরিভাষা শুধু শব্দ নয়; বরং রাজনৈতিক অর্থে স্বীকৃতির ইঙ্গিত দেয়। প্রতিটি শব্দ দাতাগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রগুলোর কাছে বৈধ যোগাযোগের দরজা খুলে দেয়, আর রোহিঙ্গা ভুক্তভোগীদের জন্য এটি ন্যায়বিচারের দরজা বন্ধ করে দেয়।
বৃহত্তর পরিণতি : ন্যায়বিচারের কবর রচিত হবে : প্রতিবেদনে বলা হয়- যদি আরাকান আর্মিকে বৈধতা দেয়া হয়, তবে এর অর্থ হবে- অপরাধীরা পার পাবে; রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দখল করবে তারাই যারা তাদের বিতাড়িত করেছে এবং আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার স্থায়ীভাবে স্থগিত হবে। এটি হবে শুধু রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা নয়; বরং মানবিক বিপর্যয়কে বৈধতা দেয়ার এক ভয়াবহ উদাহরণ।
সহাবস্থানের নামে সহিংসতার বৈধতা নয় : প্রতিবেদনে বলা হয়- আরাকান রাজ্যে এখন মানবিক সম্প্রদায়ের এক নৈতিক পরীক্ষার মুহূর্ত। যারা শান্তির নামে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আঁতাত করছেন, তারা আসলে রোহিঙ্গাদের রক্তের বিনিময়ে প্রভাব ও প্রবেশাধিকারের বাণিজ্য করছেন। যতক্ষণ ‘বাস্তববাদ’ নামে এ ভণ্ডামি চলবে, ততক্ষণ ন্যায়বিচার দূরস্বপ্নই থাকবে। রোহিঙ্গাদের মর্যাদা ও ন্যায়বিচারই হতে হবে বৈশ্বিক বিবেকের কেন্দ্রবিন্দু, আর যারা সহিংসতাকে ‘নীতির বাস্তবতা’ বলে বৈধতা দিয়েছেন, তাদেরও জবাবদিহি করতে হবে ইতিহাসের আদালতে।



