দাওয়াহ

Printed Edition
দাওয়াহ
দাওয়াহ

ইকবাল হোসেন ইমন

দাওয়াহ আরবি শব্দ। যার শাব্দিক অর্থ- ডাকা, আহ্বান করা বা আমন্ত্রণ জানানো। পরিভাষায় ইসলামী দাওয়াহ হলো- ইসলামের শাশ্বত বাণীর দিকে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশিত ও রাসূল সা:-এর আদর্শগত পদ্ধতিতে মানুষকে আহ্বান জানানো। অর্থাৎ- দাওয়াহ বলতে মানুষের মধ্যে পরিপূর্ণতা বিধান নয়, মানুষকে বাধ্য করা নয়, তিরস্কার করা নয়; বরং দাওয়াহ হলো আহ্বান পৌঁছানো। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-‘এবং রাসূলের উপর দাওয়াত সুস্পষ্টভাবে পৌঁছে দেয়া ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব নেই।’ (সূরা নূর, আয়াত-৫৪) আর যিনি আল্লাহর দিকে দাওয়াহর এই কাজটি করেন, তাকে বলা হয় দায়ী।

আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে কিসের দিকে দাওয়াত দিতে বলেছেন, সেটি পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে বিধৃত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘তুমি মানুষকে নিজ প্রতিপালকের পথের দিকে আহ্বান করো।’ (সূরা নাহল, আয়াত-১২৫)

আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে রাসূল সা:-কে নির্দেশ দিয়েছেন মানুষকে আল্লাহর পথের দিকে আহ্বান করার জন্য। অর্থাৎ গন্তব্যে পৌঁছল কিনা সেটি মুখ্য নয়; বরং মানুষকে পথ চিনিয়ে দেয়া, পথে উঠিয়ে দেয়া, পথের দিকে আমন্ত্রণ জানানো-এটিই একজন দায়ীর প্রধান কাজ।

ইসলামী দাওয়াহর বিষয়বস্তু কী হবে? রাসূল সা: মানুষকে কিসের আহ্বান জানিয়েছেন? নবী-রাসূলগণ মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন আল্লাহর একত্ববাদ, এক আল্লাহর ইবাদত, শিরক পরিত্যাগ ও যাবতীয় তাগুতি শক্তি বর্জন এবং ন্যায়পরায়ণতার দিকে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘আপনার আগে আমি যত রাসূলই পাঠিয়েছি, প্রত্যেককে এ ওহিই করেছি যে, আমিই ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। কাজেই তোমরা শুধু আমারই ইবাদত করো।’ (সূরা আম্বিয়া, আয়াত-২৫)

এ সম্পর্কে বিস্তারিত বুঝতে হলে রাসূল সা:-এর সিরাত, মাক্কি ও মাদানি যুগে অবতীর্ণ আয়াতগুলোর বৈশিষ্ট্যের দিকে লক্ষ করতে হবে। কুরআন নাজিল হয়েছে দীর্ঘ ২৩ শ’ বছর ধরে। যার মধ্যে রাসূল সা:-এর মাক্কি যুগ ছিল ১৩ বছর। এই দীর্ঘ ১৩ বছরে ইসলামের সাধারণ ফিকহি বিষয়াবলি আল্লাহ তায়ালা অবতীর্ণ করেননি। এ সময়কার নাজিলকৃত আয়াতগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল ঈমান, তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদ, আখিরাত, মুশরিকদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ইত্যকার বিষয়াদি। নবুয়তের দশম বছরে রাসূল সা:-এর পবিত্র মিরাজের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারদের উপর ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সালাতের বিধান দিয়েছেন। তাহলে ইসলামের প্রাথমিক দীর্ঘ ১০ বছর নববী দাওয়াহর প্রধান উপাদান ছিল ঈমান, তাওহিদ, শিরক, চারিত্রিক শিক্ষা, সামাজিক ন্যায় ইত্যাদি।

তারপর রাসূল সা:-এর হিজরতের পর মাদানি যুগে বিভিন্ন ফিকহি বিধান আল্লাহ তায়ালা নাজিল করতে থাকেন। ততদিনে মুসলিমদের একটি রাষ্ট্রকাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এবার দ্বিতীয় হিজরিতে অবতীর্ণ হয় ইসলামের তৃতীয় ও চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ জাকাত ও রোজার বিধান। অবতীর্ণ হয় জাকাত ফরজ সংক্রান্ত আয়াত। আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘তোমরা নামাজ কায়েম করো, জাকাত আদায় করো এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু করো।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-৪৩)

সব বালেগ মুসলিম নর ও নারীর উপর রোজা ফরজ করে আল্লাহ তায়ালা নাজিল করেন-‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৩)

এ ছাড়াও হজের হুকুম অবতীর্ণ হয় হিজরতের নবম বছরে। মুসলিম নারীদের উপর হিজাব বা পর্দার বিধান হিজরতের পঞ্চম বছরে অবতীর্ণ হয়। তাহলে ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিধানাবলিও আল্লাহ তায়ালা অনেক পরে এবং ধীরে ধীরে নাজিল করেছেন। অথচ মুসলিমরা ইতোপূর্বে ইসলামের জন্য অজস্র কষ্ট সহ্য করেছেন। হিজরত করেছেন, বিভিন্ন যুদ্ধে জীবন দিতে পিছপা হননি। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যে তারা ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সম্মুখসারির মুসলিম। তাদের উপরেও আল্লাহ তায়ালা একবারে ইসলামের যাবতীয় বিধান চাপিয়ে দেননি। নিকৃষ্টতম মদ হারাম করেছেন তিন ধাপে। প্রথম ধাপে আল্লাহ এর পাপের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেন- ‘তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলো, এ দুটোয় রয়েছে বড় পাপ ও মানুষের জন্য উপকার। আর তার পাপ তার উপকারিতার চেয়ে অধিক বড়।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-২১৯)

দ্বিতীয় ধাপে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সালাত নিষেধ করেছেন। নাজিল হয়-‘হে মুমিনগণ! তোমরা যখন মদ্যপান করে নেশাগ্রস্ত থাকো, তখন সালাতের কাছেও যেও না, যতক্ষণ না বুঝতে পারছ যা বলছ।’ (সূরা নিসা, আয়াত-৪৩)

এবং সর্বশেষ আল্লাহ তায়ালা মদকে হারাম ঘোষণা করে নাজিল করেন সূরা মায়িদার ৯০-৯১ নং আয়াত।

এভাবেই প্রথমে মানুষের মনস্তত্ত্বকে প্রস্তুত করে রাসূল সা: মানুষকে আল্লাহর তায়ালার চূড়ান্ত বিধান জানাতেন। অর্থাৎ দাওয়াহর ক্ষেত্রে আল্লাহ এবং তার রাসূলের সুন্নাত পদ্ধতি হলো- সর্বপ্রথম মানুষের অন্তরে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসকে দৃঢ় করা। মানবহৃদয়কে আল্লাহর সাথে সম্পর্কযুক্ত করা। আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও ভয়ের মাধ্যমে তার একনিষ্ঠ আনুগত্যের জন্য মানবহৃদয়কে সদাসর্বদা প্রস্তুত রাখা। কুফর, শিরক, বিদয়াত ইত্যকার অন্ধকারগুলোকে চিনতে পারা। আখিরাত, জান্নাত-জাহান্নামের প্রতি ঈমান বা বিশ্বাসকে দৃঢ় করা। সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতার প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। সব প্রকার মিথ্যা, কলুষতা ও তাগুতি শক্তি হতে দূরে থাকা। মানুষের মধ্যে দাওয়াহর মাধ্যমে যখন এ বিষয়গুলো দৃঢ় করা যাবে, তখন ইসলামের ফিকহি বিষয়গুলো নিঃসঙ্কচিত্তে একনিষ্ঠভাবে সবাই পালন করবে। কিন্তু যদি এইগুলো তুলনামূলক দুর্বল রেখে শুধু ফিকহি বিষয়গুলো মানুষের মধ্যে অধিক গুরুত্বের সাথে তুলতে থাকা হয় তবে এটি কখনোই ইসলামের প্রকৃত দাওয়াহ পদ্ধতি নয়।

বর্তমান সময়ে এ বিষয়টি অনেক আলেমসমাজ ধরতে কিছুটা ব্যর্থ হন। অধিকাংশের দাওয়াহ, ওয়াজ কিংবা খুতবা সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ফিকহি মাসলা-মাসায়েল, বিভিন্ন নফল ইবাদতের সওয়াব ইত্যাদি বিষয়গুলো। এগুলো স্থান-কাল-পাত্রভেদে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ বিষয়ে খুতবা কিংবা বক্তব্য হয়তো এমন মানুষদের সামনে দেয়া হচ্ছে, যাদের ইসলাম সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান নেই। তারা জানে না ইসলাম কী, জানে না প্রকৃত শিরক বা কুফর কী এবং এগুলো কিভাবে অজান্তেই আমাদের ঈমানকে ধ্বংস করে। এ ছাড়াও অধিকমাত্রায় ফিকহি বিধিনিষেধ আলোচনার ফলে সাধারণের কাছে ইসলাম শুধু হালাল-হারামের ধর্মে পরিণত হয়েছে। তাই সর্বপ্রথম ইসলামী দাওয়াহর কেন্দ্রবিন্দু হতে হবে ব্যাপকভাবে জ্ঞান বা ইলমের সম্প্রসারণ। মানুষকে ইসলামের আলো এবং এর বাইরের যাবতীয় অন্ধকারের বিষয়ে অবগত করাতে হবে। যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বই, ওয়াজ বা খুতবা সব কিছুর মাধ্যমে। এটিই হবে একজন দায়ীর জন্য নববী সুন্নাহর প্রকৃত অনুসরণ। যে দায়ীর মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘ওই ব্যক্তি অপেক্ষা কথায় কে উত্তম যে আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহ্বান করে, সৎ কাজ করে এবং বলে, আমি তো আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা ফুসসিলাত, আয়াত-৩৩)

লেখক : শিক্ষার্থী, আল-হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।