দিগন্ত কবিতাবলী

Printed Edition
দিগন্ত কবিতাবলী
দিগন্ত কবিতাবলী

কাজী জহিরুল ইসলাম

মানুষের দৈর্ঘ্য

মানুষের কোনো স্থায়ী ঠিকানা কি আছে?

না, একদম নেই। মানুষ মূলত এক যাযাবর প্রাণী।

তার হেঁটে যাওয়া পথখানিই শুধু সে;

অনেকে বলেন সব রেখে আমরা একদিন স্থায়ী ঠিকানায়, অমোঘ মৃত্যুর কাছে, অন্য পৃথিবীতে, চলে যাই।

এটি মানুষের মূলত রোমান্টিকতা।

মানুষ আসলে কোথাও যায় না, মৃত্যুও প্রকৃতপক্ষে মানুষের স্থায়ী কিংবা দীর্ঘমেয়াদি ঠিকানা নয়

মানুষ নিজের অঙ্কিত পদরেখায় পড়ে থাকে, বসে থাকে, শুয়ে থাকে, একা...

এই দীর্ঘ, আঁকাবাঁকা, হয়তোবা ছোট,

এবড়ো-খেবড়ো রেখাটিই, কেবল মানুষ, শুধু এইটুকু মানুষের দৈর্ঘ্য, এর বেশি কিছু নয়।

আমার অতীতই আমি, অতীত ক্রমশ বড় হয়,

বড় হতে হতে কবরের ঘাস ছুঁয়ে ফেলে;

কবর একটি সুবৃহৎ যতিচিহ্ন, দাঁড়ি,

এর বেশি কিছু নয়।


শাহীন ভূঁঞা

বিবর্তন

এ-নিস্তব্ধ বালুচরে মাছরাঙা এখন আসে না

একদা এখানে ছিল জল জল নদীর বসতি

তারাজ্বলা রাতে ঢেউয়ের দোলা ছিল প্রেম

নারী এলে ঢেউ ঢেউ জল হতো সুরের ব্যঞ্জন

রাতচরা নাও হতো জলপ্রিয় মানুষের সাথী

এখন কিছুই নেই- লুপ্ত কিছু জলদাগ ছাড়া

প্রকল্প রয়েছে; তবে ঢেউবতী জল নেই বুকে

পরিযায়ী পাখি নেই; ঘুঘুরাও ফিরছে পাহাড়ে

নদী মরে বালুজ্বরে; জলমুনি কাঁদে হাহাকারে


আবু জাফর দিলু

একজন মানুষের প্রয়োজন

এইভাবে ছিন্নভিন্ন হতে হতে সূর্য রশ্মিগুলো

বিবস বরণে কেন অবেলার বুকে ডুবে যায়?

নিরীহ বালক হবারও বারে ধুম, চারিদিকে

বিরুদ্ধ হাওয়া বয় নিরবধি মানুষের বুকে,

তুষ-আগুনের মতো জ্বলেজ্বলে হিম হয়ে যায়!

অবয়বে পিতৃকোষ ভবিষ্যৎ মুখ চেয়ে থাকে

নদী ভাঙনের মতো সীমাহীন কেন ধসে যায়?

কোথাও একটু শক্ত মাটি নেই যেখানে দাঁড়িয়ে

অন্তত সমুদ্র সীমানার মতো বাতিঘর হয়ে

দূরগামী নাবিকের অন্ধকারে জ্বলে থাকা যায়।

এই পৃথিবীর বুকে কোথাও কি নেই শোষিতের

দহনের জ্বালা জুড়োবার মন্ত্র, স্বচ্ছ মাটি প্রেম?

এখানে এখন একজন মানুষের খুব প্রয়োজন,

যার বুকে সূর্য হাসে, চোখে জ্বলে দুরবিন প্রভা,

যার তাবৎ শরীরে জ্যোৎস্নার মতো দীপ্ত আলো

জ্বেলে মানুষে মানুষে ভালোবাসতে শেখাবে।

যে ভালোবাসায় রমণীরা হবে রণঘ্রাণ প্রিয়,

তরুণেরা হবে রণাঙ্গন প্রিয় শুধু সম্মুখ রণের।


শারমিন নাহার ঝর্ণা

শেষ অধ্যায়

জীবন নামক বইয়ের শেষ অধ্যায়টা

যেন দিনের শেষ আলোটা ঢলে পড়ার মতো,

মনে হয় সূর্য নয় আমিই ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছি,

এখন জীবন কেবল নদীর এক শেষ বাঁক,

স্মৃতিগুলো ভেসে ভেসে আসে ছোট ছোট

নৌকার মতো হৃদয় নদীর তীরে।

কেউ হাসির বোঝা বয়ে আনে

আবার কেউ নীরব অশ্রু।

রাতে পৃথিবীর কোলাহল থেমে গেলে

আমি শুনি নিজের ভেতর এক বিদায়ের সুর!

যেন কেউ বলছে ফিরে চলো,

পবিত্র আলো এখন তোমার অপেক্ষায়।

আমি মৃদু হেসে চোখ বুঁজি

কারণ জানি শেষ মানেই তো আরেক শুরু,

শুধু দিকটা বদলায় পবিত্র আলোর।


ইসমাইল জুমেল

হুক্কা হুয়া

সভ্যতার কুণ্ডলী ধোঁয়ায় পেঁচিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে আকাশ জয়ীর স্বপ্ন, বিশেষ এবং বিশিষ্টের হয়ে যাচ্ছে আবার সব কিছু। আকাশটা ভেঙে চুরে নিজেকে সাজায়, লুকানো থাকে হাজারো তারকারাজির পতনের চিৎকার। যার শব্দ তরঙ্গ আল্ট্রা-লো ফ্রিকোয়েন্সি এবং তা বিশিষ্টের শ্রুতিসীমার বাইরে।

তবুও এই ত্যাগের রঙধনুতে মিশে যায় কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, হাইড্রোজেন সায়ানাইড, হাইড্রোজেন ক্লোরাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, অ্যালডিহাইডের মতো কুখ্যাত রাসায়নিক যৌগ। রঙিন আকাশ আবার কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায়, অশ্বত্থামার চক্রান্তে। জীবনের আলোয় নামে আরো আরো অন্ধকার। তাণ্ডব নৃত্যে দিশেহারা নর্তকী মন। এসব আবার, পৃথিবীর সর্বপ্রথম অলঙ্কার নাসারিয়াস শামুকের তৈরি পুঁতির হারের মতো হয় বহুমুখী প্রদর্শনী। আশঙ্কা শুধু, আবার আকাশে ঝড়ের তাণ্ডব আসবে। এসিড বৃষ্টি নামবে। আবার কত কত তারকারাজির পতন হবে। আবার একটি অশ্বত্থামার চক্রান্ত হবে। এই যেন স্বনির্মিত এক গোলকধাঁধা। সবাই ঢুকে যাচ্ছে। কেউ বেরোতে পারছে না। নিজেকে দেখতেও পাচ্ছে না, নিজেকে চিনতেও পারছে না


অনন্য কাওসার

নীরব বিপ্লব

আমি এক নীরব বিপ্লব হয়ে উঠেছি

তোমাদের তৈলমর্দন চত্বরে, নগরভবনে

নদীবন্দরে শালিকের ঠোঁট ছিঁড়ে

যে বিদেশী অবৈধ জাহাজ নির্বিঘেœ

গোলটেবিল বৈঠকে বসে, শকুনের চোখ

শ্বাপদের দাঁতের হিংস্রতা দেখে

তোমরা যারা মৃতদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকো

ভান করে বসো শতাব্দীর বুদ্ধিজীবী ও কবি

আমি আজ তোমাদের জন্য নীরব বিপ্লব।

শব্দে শব্দে কীভাবে আগুন জ্বালাতে হয়

টর্নেডো সাইক্লোন কীভাবে সুপ্ত থাকে নদীর ভেতর

পাহাড়ে কীভাবে নীরবে জেগেছে আগ্নেয়গিরি,

ভিসুভিয়াস তোমাদের তা বড়জোর মুখস্থ পাঠ;

অথচ তোমাদের শব্দে শব্দে দাউদাউ করে

জ্বলে ওঠে না মানবিক বোধ

থরথর করে কেঁপে ওঠে না পৃথিবীর নোংরা নগরী

অথচ তোমরা যারা স্বদেশ ও মৃত্তিকা রক্ষায় উদাসীন,

ভান করে বসো শতাব্দীর বুদ্ধিজীবী ও কবি,

আর ওদিকে তোমাদের যুগলবন্দী শব্দে শব্দে

কেবলই খসে পড়ে চুম্বনের আধিখ্যেতা ভাষা

আমি আজ তোমাদের জন্য নীরব বিপ্লব।


আনোয়ার আল ফারুক

নীল বেদনার তরজমা

তোমার অঙ্কিত মানচিত্র দুর্ভেদ্য পাঠ

কেবল তাতে দেখি বেদনার নীল হরফ

তোমার পরিসীমা কেবল মরুময় মাঠ

খা খা হৃদয় খুঁজে শীতল টুকরো বরফ।

কিন্তু , আমি খুঁজে পাই দগদগে অঙ্গার

তাতে মেলে বেদনার তরজমার ঝঙ্কার।