কারসাজিকারীদের হাতেই জিম্মি শেয়ারবাজার

সপ্তাহজুড়ে স্বল্পমূলধনী কোম্পানির আধিপত্য

Printed Edition

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের এক বছরের বেশি সময় পার হলেও কারসাজিকারীদের হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছে না দেশের শেয়ারবাজার। ঘুরে ফিরে আবারও গুটিকয়েক কারসাজিকারীদের হাতেই জিম্মি হয়ে পড়ছে বাজারগুলো। গত এক সপ্তাহের পুঁজিবাজারের আচরণ দেখলে তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে পুঁজিবাজার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তির হাতেই জিম্মি ছিল। পটপরিবর্তনের পর পুনর্গঠিত নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিভিন্ন পদক্ষেপে সাময়িকভাবে এ চক্রটি কিছু দিন ঘাপটি মেরে থাকলেও সম্প্রতি আবার তাদেরই সরব উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে বাজারে।

গত জুন মাসের শেষ দিকে পুঁজিবাজার গতি ফিরে পাওয়ার পর শুরুর দিকে বাজার আচরণ ছিল স্বাভাবিক। ওই সময় বাজারের মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিগুলোই ছিল বিনিয়োগকারীদের প্রথম পছন্দের। কিন্তু বাজারের স্বাভাবিক এ অবস্থা বেশি দিন টেকেনি। হঠাৎ করে স্বল্পমূলধনী কোম্পানিগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়েন বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ। লেনদেনের পাশাপাশি প্রতিদিনই মূল্যবৃদ্ধিতেও এগিয়ে থাকতে দেখা যায় কোম্পানিগুলোকে। কোনো কোনো কোম্পানির শেয়ারে গত দুই মাসের মধ্যে ১০০ শতাংশের বেশি মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। কারণ একটাই। মৌলভিত্তির ধারেকাছে না থাকলেও কোম্পানিগুলোর মূলধন কম। কয়েকজন মিলে পরিকল্পিতভাবে খুব সহজেই এদের মূল্যবৃদ্ধি ঘটানো যায়। একটি আইটি খাতের কোম্পানি গত বছর দশমিক ৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। গত সপ্তাহের তিনটি কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ার ডিএসইর মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষে ছিল। ডিএসইর পক্ষ থেকে মূল্যসংবেদন কোনো তথ্য আছে কি না জানতে চাইলেও তেমন কিছু জানাতে পারেনি কোম্পানি। অথচ মন্দা বাজারেও অস্বাভাবিক দর বেড়ে চলছে কোম্পানিটির শেয়ারের।

একই অবস্থা দেখা গেছে আরেকটি বিবিধ খাতের কোম্পানির। মূলত বলপেন তৈরির কথা বলা হলেও বাস্তবে কোম্পানিটির সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। গত অর্থবছরে কোম্পানিটি শেয়ার হোল্ডারদের ৩০ পয়সা লভ্যাংশ দেয়। গত তিন মাসের ১৩১ টাকা থেকে সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ৩৬১ টাকায় লেনদেন হয়েছে কোম্পানিটির শেয়ার। এভাবে উৎপাদনে না থাকা বেশ কয়েকটি কোম্পানিও একই সময়ে প্রতিনিয়তই মূল্যবৃদ্ধি ঘটে চলেছে। অথচ এ সম্পর্কে স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে তথ্য যাচাই করতে চাইলে কর্তৃপক্ষ গ্রহণযোগ্য কোনো উত্তর দিতে পারছে না।

বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এভাবে চলতে থাকলে বিনিয়োগকারীরা আবারো পুঁজিবাজারের ওপর আস্থা হারাবেন। আবার দীর্ঘমেয়াদি মন্দায় আক্রান্ত হতে পারে বাজার। তাই বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রাখতে এ বিষয়গুলোতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কিছু করা দরকার বলে মনে করেন তারা। অতীতে এ চক্রের সাথে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কিছু কর্মকর্তাও জড়িত থাকার কথা শোনা গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে এ বলয় থেকে মুক্ত আছে সংস্থাটি।

এ দিকে গত সপ্তাহে ডিএসইর সবগুলো সূচক ছিল ইতিবাচক। সপ্তাহের শেষ তিনটি কর্মদিবসে বাজারে মন্দা বিরাজ করলেও প্রথম দু’দিন সূচকের উন্নতি ঘটে। ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স বিগত সপ্তাহে ২৪ দশমিক ৭১ পয়েন্ট বৃদ্ধি পায়। রোববার ৫ হাজার ৩৫০ দশমিক ২৫ পয়েন্ট থেকে সপ্তাহ শুরু করা ডিএসইর প্রধান সূচকটি বৃহস্পতিবার দিনশেষে পৌঁছে যায় ৫ হাজার ৩৭৪ দশমিক ৯৬ পয়েন্টে। বাজারটির অপর দুই বিশেষায়িত সূচক ডিএসই-৩০ ও ডিএসই শরিয়াহ এ সময় যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৬২ ও ১৭ দশমিক ১৭ পয়েন্ট।

সূচকের পাশাপাশি গত সপ্তাহে বাজারটির লেনদেনেও যথেষ্ট উন্নতি ঘটে। আগের সপ্তাহের ৩ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার স্থলে গত সপ্তাহে ডিএসইর লেনদেন দাঁড়ায় ৪ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকায়, যা আগের সপ্তাহ অপেক্ষা ৩১ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি। একই হারে বেড়েছে গড় লেনদেনও। আগের সপ্তাহে ডিএসইর গড় লেনদেন ছিল ৬৮৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা, যা গত সপ্তাহে ৯০৭ কোটি ১৩ লাখ টাকায় উন্নীত হয়।

সূচকের উন্নতি ঘটলেও পুরো সপ্তাহজুড়ে মূল্যবৃদ্ধিতে স্বল্প মূলধনের আধিপত্য থাকায় স্বাভাবিকভাবেই বড় মূলধনী কোম্পানিগুলো এ সময় মার খায় যার ফলে এ সময় ডিএসইর বাজার মূলধনের অবনতি ঘটে। আগের সপ্তাহে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ১১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা, যা গত সপ্তাহে দশমিক ৪৯ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ৭ লাখ ৮ হাজার ১৮১ কোটিতে নেমে আসে।

বিদায়ী সপ্তাহে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের শীর্ষে উঠে এসেছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন লিমিটেড (বিএসসি)। ডিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্র মতে, সপ্তাহজুড়ে কোম্পানিটির গড়ে ৩৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকার টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে, যা ছিল ডিএসইর ফলে কোম্পানিটি লেনদেনের শীর্ষে অবস্থান। লেনদেনের শীর্ষ দশ কোম্পানির তালিকার দ্বিতীয় স্থানে থাকা বেক্সিমকো ফার্মার গড়ে লেনদেন হয়েছে ২৭ কোটি ৭০ লাখ টাকার, যা ছিল বাজারটির মোট লেনদেনের ৩ দশমিক ০৫ শতাংশ। আর গড়ে ২৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা লেনদেন করে এ তালিকায় তৃতীয় স্থানে জায়গা করে নেয় ওরিয়ন ইনফিউশন।

ডিএসইর লেনদেনের তালিকায় থাকা অন্য কোম্পানিগুলো ছিল যথাক্রমে সিটি ব্যাংক, বিচ হ্যাচারি, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ, সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস, মালেক স্পিনিং, টেকনো ড্রাগস এবং ডমিনেজ স্টিল বিল্ডিং সিস্টেম লিমিটেড।

বিদায়ী সপ্তাহে ডিএসইতে দর বৃদ্ধির তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে তথ্য প্রযুক্তি খাতের কোম্পানি ইনফরমেশন সার্ভিস নেটওয়ার্ক লিমিটেড (আইএসএন)। গত সপ্তাহে কোম্পানির দর বেড়েছে ৪৭ দশমিক ২৬ শতাংশ। তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা মেঘনা সিমেন্টের শেয়ার দর বেড়েছে ২৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ। আর ২৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি পেয়ে তালিকায় তৃতীয় স্থানে উঠে আসে বাংলাদেশ অটোকার্স লি.। তালিকায় উঠে আসা অন্যান্য কোম্পানির মধ্যে আরো ছিল যথাক্রমে জিকিউ বলপেন, শ্যামপুর সুগার মিলস, জিলবাংলা সুগার মিলস, জাহিনটেক্স, সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস, আজিজ পাইপ এবং টেকনো ড্রাগ।