বিশেষ সংবাদদাতা
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম, সালমান এফ রহমান, নজরুল ইসলাম মজুমদারসহ ব্যাংক লুটেরাদের লুটপাটের প্রভাব পড়ছে দেশের ব্যাংকিং খাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে ১১টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে মাফিয়া এস আলম একাই ঋণের নামে বের করে নিয়েছে সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা। লুটেরাদের অনেকেই আইনের আওতায় আসলেও বেশির ভাগই এখন বিদেশে পালিয়ে রয়েছেন। এস আলমসহ কেউ কেউ দেশ থেকে অর্থ লুট করে এখন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে বিদেশী নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। ব্যাংকের টাকা আদায় হচ্ছে না। ফলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ক্রমেই লাগামহীন হয়ে উঠছে। যদিও আগামী বছরের মধ্যে খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, কিন্তু বাস্তব চিত্র উল্টো দিকেই যাচ্ছে। গত এক বছরে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ছয় লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা যা দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), যারা বর্তমানে ঢাকায় অবস্থানরত তাদের নিয়মিত পর্যালোচনা মিশনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে বৈঠক করেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সদর দফতরে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র, ব্যাংক খাতের তারল্যসঙ্কট, রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা এবং রফতানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) গঠন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আইএমএফের গবেষণা বিভাগের ডেভেলপমেন্ট ম্যাক্রো ইকোনমিকস শাখার প্রধান ক্রিস পাপার্জিওর নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল। অন্য দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পে অংশ নেন ডেপুটি গভর্নর ড. হাবিবুর রহমান, গবেষণা বিভাগের নির্বাহী পরিচালক ড. এজাজুল ইসলাম এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কর্মকর্তারা।
সূত্র জানায়, আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির শর্ত অনুযায়ী, সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তার উল্টো চিত্রই দেখা যাচ্ছে। সরকার পরিবর্তনের পর গোপন করে রাখা প্রকৃত খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ পেলে দেখা যায়, মাত্র এক বছরে খেলাপির পরিমাণ প্রায় চার লাখ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকায়। সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি হার ৪০ শতাংশ ছাড়িয়েছে, আর বেসরকারি খাতেও খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের ওপরে পৌঁছেছে।
আইএমএফ প্রতিনিধি দল জানায়, এই খেলাপি প্রবণতা শুধু আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্যই নয়, বিনিয়োগ প্রবাহ এবং সামষ্টিক অর্থনীতির জন্যও বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। তারা ব্যাংকগুলোর পুনঃমূলধন, প্রভিশন ঘাটতি এবং তারল্যসঙ্কটের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য চান। একই সাথে জানতে চান, এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কী ধরনের নীতিমালা অনুসরণ করছে। বৈঠকে আলোচনায় উঠে আসে রিজার্ভ থেকে ইডিএফ গঠনের বিষয়টিও। আইএমএফের প থেকে প্রশ্ন তোলা হয়, রিজার্ভের অর্থ থেকে পুনঃঅর্থায়ন ও প্রাক-অর্থায়ন সুবিধা দেয়ার ফলে প্রকৃত বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে কি না। সংস্থাটি এ বিষয়ে নীতিগত ব্যাখ্যা ও স্বচ্ছ হিসাব পেশ করার অনুরোধ জানায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প থেকে জানানো হয়, ইডিএফ তহবিল মূলত রফতানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানির সহায়তা হিসেবে কাজ করছে। এতে দেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে সাহায্য হয়েছে। তবে রিজার্ভ থেকে এই অর্থ ব্যবহারের েেত্র আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে স্বচ্ছতা বজায় রাখা হচ্ছে বলেও দাবি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বৈঠকে আইএমএফ প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের মুদ্রানীতি কাঠামো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, সুদের হার, এবং রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা নিয়েও আলোচনা করে। তারা জানান, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে, যা ইতিবাচক। তবে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে যে, অতিরিক্ত সঙ্কোচনমূলক নীতি দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কী ধরনের সমন্বিত পদপে নিচ্ছে, তা জানতে চায় সংস্থাটি।
সূত্র জানায়, আইএমএফের প্রতিনিধি দল ব্যাংক খাতের বর্তমান চিত্রের পাশাপাশি পরবর্তী ১২ মাসের সামষ্টিক অর্থনৈতিক রূপরেখা সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য চেয়েছে। তারা জলবায়ু সহনশীল বিনিয়োগ, সবুজ অর্থনীতি গঠন এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য ব্যাংক খাতের প্রস্তুতি সম্পর্কেও জানতে চায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে খেলাপি ঋণ কমানোই তাদের প্রধান অগ্রাধিকার। এজন্য বড় ঋণগ্রহীতাদের পুনঃতফসিল নীতি কঠোর করা, ঋণ অনুমোদনে স্বচ্ছতা আনা এবং ব্যাংক পরিচালনায় জবাবদিহিতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি, ঝুঁকিপূর্ণ খাতগুলোতে ঋণ বিতরণে কঠোর নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। বৈঠকের শেষ পর্যায়ে আইএমএফের প থেকে সতর্ক করা হয় যে, যদি খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে না আসে, তাহলে আগামী রিভিউতে ঋণ ছাড়ের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প থেকে আশ্বস্ত করা হয়, ডিসেম্বরের মধ্যে খেলাপি ঋণ হ্রাসে একটি সময়সীমাভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে তা বাস্তবায়ন শুরু করা হবে।



