গাজায় ফের বিমান হামলা ইসরাইলের

Printed Edition

নয়া দিগন্ত ডেস্ক

  • ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলার পরিকল্পনার খবর মিথ্যা : হামাস
  • আরো ১৫ ফিলিস্তিনির লাশ ফেরত দিলো ইসরাইল
  • আরো দুই ইসরাইলি বন্দীর লাশ ফেরত দিলো হামাস
  • রাফাহ ক্রসিং বন্ধ রাখার ঘোষণা নেতানিয়াহুর
  • যুদ্ধবিরতি ৪৭ বার লঙ্ঘন করেছে ইসরাইল

ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজায় আবার বিমান হামলা করেছে দখলদার ইসরাইল। গতকাল রোববার যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে জায়নিস্ট বাহিনী এ হামলা চালায় বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আলজাজিরা। খবরে বলা হয়, ইসরাইলি গণমাধ্যমগুলো রাফা ও দক্ষিণ গাজার বিভিন্ন এলাকায় হামলার খবর দিচ্ছে। ইসরাইলের চ্যানেল ১২ জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাটজ এবং সেনাকর্মকর্তারা এক ফোনালাপে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছেন।

ইসরাইলের সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম জানায়, হামাস যোদ্ধাদের সাথে ‘গোলাগুলি বিনিময়’-এর পর এই হামলা চালানো হয়। ইসরাইলি মিডিয়ার দাবি, দক্ষিণ গাজার রাফা এলাকায় ‘সন্ত্রাসী তৎপরতার’ জবাব হিসেবেই এ অভিযান চালানো হয়েছে। ইসরাইলি সংবাদমাধ্যমগুলো আরো জানায়, রাফায় সামরিক যান বিস্ফোরণে ইসরাইলের দুই সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন।

ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলার পরিকল্পনার খবর মিথ্যা : হামাস

হামাস সাধারণ ফিলিস্তিনি নাগরিকদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করছে। এমন অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের দেয়া বিবৃতি ইসরাইলি প্রপাগান্ডা বলে অভিহিত করেছে হামাস। গতকাল রোববার এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের এসব অভিযোগ মিথ্যা। তাদের ‘বিশ্বস্ত সূত্রের তথ্য’ ইসরাইলি প্রোপাগান্ডার সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। এসব অভিযোগ ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে চলমান দখলদারিত্ব ও আগ্রাসন চালিয়ে যাওয়ার জন্য আড়াল তৈরির প্রচেষ্টা। এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা করেনি হামাস। ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা করতে চায় না তারা। হামাস যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বস্ত সূত্রের বরাতকে ইসরাইলের পাঠানো তথ্য বলে ইঙ্গিত করেছে। তারা আহ্বান জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যেন ইসরাইলের বক্তব্যে বিভ্রান্ত না হয়। বরং আর যেন যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন না করে সেদিকে মনোযোগ দেয়। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর এক বিবৃতিতে বলেছিল, হামাস কোনো হামলা করলে তা হবে চলমান যুদ্ধবিরতি চুক্তির মারাত্মক লঙ্ঘন। সেই সাথে গাজার সাধারণ মানুষদের রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো ধরনের পদক্ষেপ নেবে বলেও জানায়।

আরো ১৫ ফিলিস্তিনির লাশ ফেরত দিলো ইসরাইল : যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় গাজা উপত্যকার কর্তৃপক্ষের কাছে আরো ১৫ ফিলিস্তিনির লাশ ফেরত দিয়েছে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী। এ নিয়ে ইসরাইলের কাছ থেকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ মোট ১৫০ জন ফিলিস্তিনির লশি ফেরত পেয়েছে। রোববার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই তথ্য জানিয়েছে।

ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়েছে, রোববার গাজায় আরো ১৫ জন ফিলিস্তিনির লাশ ফেরত দিয়েছে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী। ফলে মোট ফেরত দেওয়া লাশের সংখ্যা বেড়ে ১৫০ জনে পৌঁছেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় প্রত্যেক মৃত ইসরাইলির লাশের বিনিময়ে ১৫ ফিলিস্তিনির লাশ ফেরত দেয়ার কথা রয়েছে ইসরাইলের। এর আগে, শুক্রবার রাতে হামাস আরো এক ইসরাইলি বন্দীর লাশ ফেরত দেয়। যুদ্ধবিরতি শুরুর পর থেকে হামাস এখন পর্যন্ত ৯ জন ইসরাইলি ও এক নেপালি শিক্ষার্থীর লাশ হস্তান্তর করেছে। পরে শনিবার ১৫ ফিলিস্তিনির লাশ ফেরত দেয় ইসরাইলি বাহিনী। একই দিন রাতে গাজা উপত্যকায় বন্দী থাকা দুই ইসরাইলিকে ফেরত দিয়েছে হামাস। তারা হলেন, ইসরাইলি নাগরিক রোনেন এনজেল ও থাই কৃষি শ্রমিক সনথায়া ও আখারাসরি। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, শনিবার ফেরত আসা কিছু লাশে নির্যাতন, মারধর, হাতকড়া পরানো এবং চোখ বেঁধে রাখার আলামত পাওয়া গেছে। এর আগেও যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় ফেরত আসা কিছু লাশ নিয়ে একই ধরনের অভিযোগ করে গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।

রাফাহ ক্রসিং বন্ধ রাখার ঘোষণা নেতানিয়াহুর : গাজায় যুদ্ধবিরতির পরও বন্ধ হয়নি ইসরাইলি আগ্রাসন। ১০ অক্টোবর চুক্তি কার্যকরের পর থেকে এ পর্যন্ত ৪৭ বার লঙ্ঘন করেছে তেলআবিব। গোলাবর্ষণ, টার্গেট হামলা ও বেসামরিকদের ওপরগুলো চালানোর অভিযোগ এনেছে স্থানীয় প্রশাসন। মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, এসব হামলায় ব্যবহার করা হয়েছে ট্যাংক, ড্রোন ও সেনা যান। শেজাইয়া, আল-তুফাহ ও যায়তুনেসেনা মোতায়েন অব্যাহত রেখেছে নেতানিয়াহু বাহিনী। খান ইউনুস থেকেও সেনা পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হয়নি। এমনকি বেইত লাহিয়া ও বেইত হানুনে এখনো ফিলিস্তিনিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ রয়েছে। এই অবস্থার মধ্যে গাজার একমাত্র আন্তর্জাতিক প্রবেশদ্বার রাফাহ সীমান্ত খুলে দেয়ার কথা থাকলেও তা পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তার দাবি, হামাস এখনো সব মৃত বন্দীর লাশ ফেরত দেয়নি, তাই সীমান্ত খোলা সম্ভব নয়।

ফিলিস্তিনি দূতাবাসের পক্ষ থেকে গত সোমবার থেকে রাফাহ খুলে দেয়ার কথা জানানো হয়েছিল। কিন্তু নেতানিয়াহুর সিদ্ধান্তে তা স্থগিত হয়ে যায়। হামাস বলেছে, রাফাহ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘন। রাফাহ সীমান্ত পুনরায় খোলা ও মানবিক সহায়তা প্রবেশের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল। ওই চুক্তির লক্ষ্য ছিল যুদ্ধ বন্ধ করে গাজার মানবিক সঙ্কট কিছুটা লাঘব করা। হামাস শনিবার জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে ইসরাইল রাফাহ সীমান্ত বন্ধ রাখলে বন্দীদের লাশ হস্তান্তর বিলম্বিত হবে।

যুদ্ধবিরতি ৪৭ বার লঙ্ঘন করেছে ইসরাইল : চলমান যুদ্ধবিরতি চুক্তি ৪৭ বার লঙ্ঘন করে ৩৮ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরাইল। গাজার মিডিয়া অফিস শনিবার এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানিয়ে ইসরাইলি ‘আগ্রাসন’ বন্ধে দ্রুত মধ্যস্থতাকারীদের হস্তক্ষেপ চেয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর থেকে ইসরাইলি দখলদার বাহিনী ধারাবাহিক ও গুরুতর লঙ্ঘন চালিয়ে যাচ্ছে। শনিবার পর্যন্ত মোট ৪৭টি নথিভুক্ত লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে।’ মিডিয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এই লঙ্ঘনের ঘটনায় ৩৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত, ১৪৩ জন আহত এবং বেশ কয়েকজন বেসামরিক নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে গোলাবর্ষণ, ইচ্ছাকৃতভাবে সাধারণ মানুষকে লক্ষ্যবস্তু বানানো এবং সরাসরি গুলি চালানোর মতো ঘটনা রয়েছে।

এই হামলাগুলোকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের ‘সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বিবৃতিতে আরো উল্লেখ করা হয়, ইসরাইলি সেনাবাহিনী আবাসিক এলাকার উপকণ্ঠে অবস্থানরত সামরিক যান, ট্যাংক, দূর নিয়ন্ত্রিত সেন্সরযুক্ত বৈদ্যুতিক ক্রেন এবং বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সরাসরি হামলা চালাতে সক্ষম কোয়াডকপ্টার ড্রোন ব্যবহার করে এই লঙ্ঘনগুলো ঘটিয়েছে।

গাজা মিডিয়া অফিস জোর দিয়ে বলেছে, তাদের দলগুলো গাজা উপত্যকার সমস্ত গভর্নরেটে এই লঙ্ঘনগুলো নথিভুক্ত করেছে। তারা বলেছে, ‘দখলদার বাহিনী যুদ্ধবিরতি মেনে চলছে না এবং ফিলিস্তিনিদের হত্যা ও আতঙ্কিত করার নীতি অব্যাহত রেখেছে।’ এই কর্মকাণ্ডের জন্য ইসরাইলকে সম্পূর্ণ দায়ী করে গাজার বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষায় এবং চলমান আগ্রাসন বন্ধে ইসরাইলকে বাধ্য করতে মধ্যস্থতাকারী ও জাতিসঙ্ঘের প্রতি জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রতিদিন ইসরাইলিদের সরাসরি হামলায় হতাহতের খবর দিলেও ইসরাইলি সেনাবাহিনী দাবি করছে, তারা ‘ইয়েলো লাইন’ বা ‘হলুদ রেখা’ লঙ্ঘনের জবাবে গুলি চালায়। হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির সাথে ‘হলুদ রেখা’ শব্দটি চালু হয়। এটি গাজার ভেতরের সেইসব এলাকাকে বোঝায় যেখান থেকে ইসরাইলি বাহিনী তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নতুন করে মোতায়েন করেছে।

যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর ইসরাইলি সেনাবাহিনী গাজা শহরের বেশির ভাগ অংশ থেকে সরে গেলেও শেজাইয়া পাড়া এবং আল-তুফাহ ও জাইতুন এলাকার কিছু অংশ থেকে সরেনি। খান ইউনুসে, সেনাবাহিনী মধ্য ও পূর্বাঞ্চলের কিছু অংশ থেকে সরে গেছে। তবে ফিলিস্তিনিদের উত্তরের বেইত হানুন ও বেইত লাহিয়ার পাশাপাশি রাফাহ শহর এবং গাজার সমুদ্র উপকূলে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে।