সিলেটে এইচএসসির ফল বিপর্যয়ের ৬টি বড় কারণ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা

Printed Edition

আবদুল কাদের তাপাদার সিলেট

উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় সিলেট বোর্ডে ফলাফল বিপর্যয়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। অর্ধেক শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়ায় অভিভাবক মহল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মাঝেও এক ধরনের উদ্বেগ উৎকন্ঠা দেখা দিয়েছে। গতকাল শুক্রবার থেকে অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীরা ফল পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন শুরু করেছেন।

সিলেটে পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটোতেই নেমেছে ধস। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত সিলেট বোর্ডের ফলাফলে এ চিত্র ফুটে উঠেছে।

এ দিকে সিলেটে ফল বিপর্যয়ের ৬টি বড় কারণ দেখছেন বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক ও অভিভাবকরা। এগুলো হচ্ছে, উত্তরপত্র মূল্যায়নের নির্দেশনায় দুর্বলতা, প্রশিক্ষণবিহীন পরীক্ষক দ্বারা উত্তরপত্র মূল্যায়ন, নিবন্ধনধারী শিক্ষকের অভাব, মোবাইলে (স্মার্ট ফোন) বিভিন্ন রকমের গেইমে আসক্তির কারণে পড়াশোনায় অমনোযোগিতা, শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখী প্রবণতা এবং ইংরেজি ভীতি ও বিজ্ঞান শিক্ষায় অনাগ্রহতা। বিগত সাত বছরের মধ্যে চলতি বছরের মারাত্মক ফলাফল বিপর্যয়ের কারণে সিলেটে হতাশা ও উদ্বেগের বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে বিশেষজ্ঞদের মাঝে। এ পরিস্থিতি উত্তরণে এখনই বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তারা।

এ দিকে, শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ ফল বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ে পাসের হার কম হওয়াকে দায়ী করছেন। এবারের পরীক্ষায় ইংরেজি বিষয়ে পাসের হার ৬৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ। গত বছর এ বিষয়ে পাসের হার ছিল শত ভাগ। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন পাসের হার আইসিটিতে ৮০.৮৭ শতাংশ। গত বছর ছিল ৮৭.৭৮ শতাংশ।

সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো: আনোয়ার হোসেন চৌধুরী নয়া দিগন্তকে জানান, মানসম্মত শিক্ষকের অভাব, বিজ্ঞান শিক্ষায় অনাগ্রহ, অভিভাবকদের অসচেতনতা, সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখী প্রবণতা খারাপ ফলাফলের পেছনে প্রভাব ফেলছে। এবার ইংরেজিতে অনেক শিক্ষার্থী কৃতকার্য হতে না পারায় সিলেটে পাসের হার কমেছে। সেই সাথে মানবিকের তুলনায় বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে শিক্ষার্থী কম থাকায় ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বোর্ড চেয়ারম্যান স্বীকার করেন, দুর্গম হাওরাঞ্চল ও গ্রামের অনেক প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি শিক্ষকের অভাব রয়েছে।

শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মনে করেন সিলেটে এ বছর যে ফলাফলটা এসেছে সেটা সিলেটের বাস্তব চিত্র। ২০০৩-২০০৬ সাল পর্যন্ত এবং তারপরের ফলাফলগুলো, আবার ২০২০ সাল থেকে ফলাফল থেকে বুঝে যাবেন এগুলো কিভাবে তৈরি করা হয়েছিল। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যায় না, ইংরেজি ভালো করে বুঝে না।

যার কারণে ফল খারাপ হচ্ছে। মফস্বল এলাকায় ভালো ইংরেজি শিক্ষক নেই। তা ছাড়া, শহরের মতো কোচিংয়ের সুবিধাও শিক্ষার্থীরা পায় না। এবারের ফলাফল নিয়ে অভিভাবক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ ও উদ্বেগ উৎকণ্ঠা থাকলেও ফলাফল নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মুহাম্মদ হায়াতুল ইসলাম আখঞ্জি নয়া দিগন্তকে বলেন, এসএসসির পর এইচএসসিতেও সিলেট শিক্ষা বোর্ডে ফল বিপর্যয়ের ঘটনা উদ্বেগজনক। এটাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়ার কোনো কারণ দেখি না। এ ব্যাপারে শিক্ষক অভিভাবকসহ সচেতন মহলকে এখনই সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করার আহ্বান জানান সিলেটের এ শিক্ষা বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, নতুবা সিলেট অঞ্চলে শিক্ষার অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে।

সিলেট শিক্ষা বোর্ডের সাবেক সচিব প্রফেসর কবির আহমদ নয়া দিগন্তকে বলেন, মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাবে সিলেট শিক্ষা বোর্ডের কাক্সিক্ষত ফলাফল অর্জিত হচ্ছে না। শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে বাংলাদেশ এক্সামিনেশন ডেভেলপমেন্ট ইউনিট (বেডোর) প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান চৌধুরী বলেন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে আন্তরিকতার ঘাটতির কারণে ফলাফল বিপর্যয় ঘটছে। এসব সমস্যা দূরীকরণে অভিভাবকদের ভূমিকা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

সিলেটের একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক ও সিলেট লেখিকা সঙ্ঘের সাধারণ সম্পাদক ইশরাক জাহান জেলী বলেন, এখনো শিক্ষার্থীরা পিতামাতার চেয়ে কলেজের শিক্ষকদের কথাবার্তা বেশি শুনে। একেক জন শিক্ষকের কারণে অনেক শিক্ষার্থী জীবনে সফল হয়। কলেজে মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব পূরণের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, কলেজ আঙিনায়ই শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। তিনি শিক্ষার্থীদের মারাত্মক মোবাইল আসক্তি কমাতে অভিভাবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

এমরান আহমদ চৌধুরী মোহন নামে এক অভিভাবক বলেন, করোনা মহামারীর পর থেকে শিক্ষার্থীদের মাঝে অটোপাস প্রবণতা বিরাজ করছে। তা ছাড়া, ইন্টারনেটের অপব্যবহার শিক্ষা কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো: আনোয়ার হোসেন চৌধুরী জানান, নানা সমস্যা ও দুর্বলতাকে চিহ্নিত করে বোর্ড কর্তৃপক্ষ কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে এসএসসি পর্যায়ে পরীক্ষকদের ছয়টি ব্যাচের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। অচিরেই উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পরীক্ষকদের প্রশিক্ষণের প্রক্রিয়া শুরু হবে বলেও জানান। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকদের সম্পর্কটা আগের মতো নেই। একজন শিক্ষার্থী একজন শিক্ষককে নির্দেশ দিচ্ছে, তাহলে একজন শিক্ষক কিভাবে পাঠদান করবেন। এসব বিষয়েও খোঁজ নেয়ার দরকার বলে মনে করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, সিলেট শিক্ষা বোর্ডে এবার এইচএসসি পরীক্ষায় ৬৯ হাজার ১৭২ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়। এর মধ্যে পাস করেছে ৩৫ হাজার ৮৭১ জন। পাসের হার ৫১.৮৬ ভাগ। জিপিএ-৫ পেয়েছে এক হাজার ৬০২ জন শিক্ষার্থী, যা গত বছরের তুলনায় পাঁচ হাজার ৯৬টি কম। গত বছর জিপিএ-৫ পেয়েছিল ছয় হাজার ৬৯৮ জন।