নিজস্ব প্রতিবেদক
দুই দশক ধরে মো: নজরুল ইসলাম (৫৯) ও তাসলিমা আক্তার (৪২) দম্পতির সংসার জীবন বেশ কাটছিল। এ সময়ে তাদের কোলজুড়ে আসে তিন সন্তান। তবে বছর খানেক ধরে তাদের মধ্যে শুরু হয় কলহ। সেই কলহ থেকে একে অপরকে কোনো কাজেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এরই মধ্যে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন স্বামী মো: নজরুল, বিয়ের দুই দশক পর স্ত্রী পরকীয়ায় জড়িয়েছে বলে সন্দেহ করেন। এর পর সম্পদ ও ব্যাংকে থাকা প্রায় দেড় কোটি টাকা এফডিআর থাকায় তাকে হত্যা করে স্ত্রী অন্য পুরুষের সাথে সংসার করতে পারে বলে মনে আশঙ্কা জন্মে। এসব চিন্তায় স্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। সে মোতাবেক গত ১২ অক্টোবর রাতে স্ত্রীকে অচেতন করে হাত-পা বেঁধে নৃশংসভাবে হত্যার পর ডিপ ফ্রিজে লাশ লুকিয়ে সন্তানদের ফুফুর বাড়িতে দিয়ে আত্মগোপনে চলে যায় নজরুল ইসলাম। তবে আত্মগোপনে থেকেও শেষ রক্ষা হয়নি তার। মঙ্গলবার (১৩ অক্টোবর) রাতে রাজধানীর বংশাল থানাধীন নবাবপুর রোড এলাকায় অভিযান চালিয়ে নজরুল ইসলামকে গ্রেফতার করেছে কলাবাগান থানা পুলিশ। এ সময় বাসার ওয়্যারড্রোব থেকে জব্দ করা হয় হত্যায় ব্যবহৃত ধারালো দা।
গতকাল বুধবার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম।
তিনি বলেন, গত ১২ অক্টোবর রাত ১১টার দিকে নজরুল ইসলাম কলাবাগান থানাধীন একটি ফ্ল্যাটে ফিরে দেখেন দরজার তিনটি লকের মধ্যে দুটি খোলা। এ সময় স্ত্রী তাসলিমা আক্তারের প্রতি দীর্ঘদিনের সন্দেহ থেকে পরপুরুষের সাথে সম্পর্ক ও তার সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার ভয় তাকে উত্তেজিত করে। এর পর রাত ১২টার দিকে ঘুমন্ত স্ত্রীর মাথায় ধারালো দা দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করেন তিনি। পরে লাশ গামছা দিয়ে বেঁধে, বিছানার চাদর ও ওড়না দিয়ে মুড়িয়ে বাসার ডিপ ফ্রিজে লুকিয়ে রাখেন।
তার পর রক্তমাখা তোশক উল্টিয়ে, মেঝে পরিষ্কার এবং নিজের জামাকাপড় ধুয়ে আলামত গোপনের চেষ্টা করেন। পরদিন সকালে নজরুল ইসলাম বড় মেয়ে নাজনীন আক্তারকে জানান, তাদের মা অন্য পুরুষের সাথে পালিয়েছে। এ সময় নাজনীন আক্তার ঘরের দেয়ালে রক্তের দাগ দেখতে পায়। এরপর দুই মেয়েকে নানার বাড়ি রেখে আসার কথা বলে রাজধানীর আদাবরে তাদের ফুফুর বাসায় রেখে নিজের প্রাইভেটকারে করে পালিয়ে যান নজরুল ইসলাম।
ডিসি মাসুদ আলম বলেন, এ বিষয়ে সন্দেহ হলে নিহতের ছোট ভাই নাঈম হোসেন ও দুই মেয়ে ১৩ অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে কলাবাগান থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে কলাবাগান থানা পুলিশের একটি টিম নিহতের ফ্ল্যাটে যেয়ে দরজার তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে ঘরের মধ্যে রাখা ডিপ ফ্রিজ খুলে ওপর থেকে মাছ-গোশত সরালে ভেতরে চাদর দিয়ে পেঁচানো অবস্থায় তাসলিমা আক্তারের লাশ দেখতে পায়।
তিনি বলেন, নিহতের পরিবারের লোকজন ও সিআইডির ক্রাইম সিন টিমের সহায়তায় কলাবাগান থানা পুলিশ ডিপ ফ্রিজ থেকে হাত-পা ও মুখ বাঁধা অবস্থায় লাশ উদ্ধার করে। নিহতের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি শেষে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠায়। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ওই দিন রাতে তাসলিমার ছোট ভাই নাঈম হোসেন বাদি হয়ে কলাবাগান থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলা পর সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ, গোয়েন্দা তথ্য ও প্রযুক্তির সহায়তায় কলাবাগান থানা পুলিশ নিহতের স্বামী মো: নজরুল ইসলামের অবস্থান শনাক্ত করে তাকে গ্রেফতার করে। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে নিজ বাসার ওয়্যারড্রোব থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ধারালো দা জব্দ করা হয়।
ডিসি মাসুদ আলম বলেন, গ্রেফতার নজরুলকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন স্ত্রী তাসলিমা আক্তারের সাথে দীর্ঘদিন ধরে দাম্পত্য কলহ চলছিল। অবৈধ সম্পর্ক আছে সন্দেহে স্ত্রীকে প্রতিনিয়ত মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করতেন। এমনকি স্ত্রী তার সম্পত্তি ও ব্যাংকে রাখা অর্থ হাতিয়ে নেবে- এমন আশঙ্কাও করতেন। এই চরম সন্দেহ ও নিয়ন্ত্রণের মানসিকতা থেকেই এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঘাতক নজরুলের একটি অ্যাকাউন্টে এক কোটি টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করা আছে। যার নমিনি ছিলেন স্ত্রী তাসলিমা। আরেক অ্যাকাউন্টে ৪০ লাখ টাকা ছিল- সেটারও নমিনি স্ত্রী। এই টাকার জন্য স্ত্রী তাসলিমা যেকোনো সময় তাকে মেরে ফেলতে পারে বলে ধারণা ছিল নজরুল ইসলামের।



