ফ্যাসিবাদের দুর্নীতি- ৫

পুরান ঢাকার গডফাদার হাজী সেলিম

Printed Edition

নিজস্ব প্রতিবেদক

  • জমি দখল ছিল তার নেশা
  • বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখল করে মার্কেট
  • হাজী পরিবার মানেই মূর্তিমান আতঙ্ক
  • সরকার বদলের সাথেই দলবদল

হাজী মোহাম্মদ সেলিম। দেশজুড়ে পরিচিত এক নামেই। পুরান ঢাকার গণ্ডি থেকেই তার নাম ছড়িয়ে যায় সর্বত্র। তার উত্থান সোয়ারীঘাটের কুলির সর্দার হিসেবে। ধীরে ধীরে বনে যান পুরান ঢাকার গডফাদার। এরশাদ সরকারের পতনের পর রাজনীতিতে নামার প্রচেষ্টা। ১৯৯৪ সালে যোগ দেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিতে। রাজনীতিতে যোগ দিয়েই বাজিমাত করেন তিনি। সাধারণ মানুষের সাথে মিশতে পারার গুণে নির্বাচিত হন ওয়ার্ড কমিশনার। এখান থেকেই তার উপরে ওঠার খায়েশ বাড়তে থাকে। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির টিকিট প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু তাকে হতাশ হতে হয়। তবে হাজী সেলিম দমবার পাত্র নন। অর্থের জোরে সওয়ার হন আওয়ামী লীগের ঘাড়ে।

দল বদলের সাথে সাথে বদলে যায় তার ভাগ্যের চাকা। আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত নেতা মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে পেছনে ফেলে শেখ হাসিনার নেকনজরে পড়েন তিনি। নৌকায় চড়ে কয়েক দফা নির্বাচিত হন সংসদ সদস্য। সেখান থেকে আর পেছন ফিরে আর তাকাতে হয়নি তাকে। গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী। বিস্তার করতে থাকেন তার সাম্রাজ্য। পুরান ঢাকায় যখন যেটার ওপর চোখ পড়েছে লুফে নিয়েছেন সমহিমায়। ওই বাহিনী দিয়েই জায়গা-জমি দখল করা তার নেশায় পরিণত হয়। প্রতœতাত্ত্বিক পুরাকীর্তি, নদীর জায়গা, সাধারণ মানুষের বসত-ভিটা কিংবা সরকারি খাস জমি বাদ যায়নি কোনোটাই। অবৈধভাবে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। বহুতল ভবন, বিলাসবহুল মার্কেট, তেলের পাম্প, ফলের আড়ত; কী নেই তার। এভাবে একের পর আধিপত্য বিস্তার করার পথে যাতে কেউ বাধা হতে না পারে সেজন্য এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। ছেলেরা বড় হয়ে বাবার শক্তি আরো বাড়িয়ে দেন। সাধারণ মানুষ হাজী পরিবারের ভয়ে দিন কাটাতেন আতঙ্কে। তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পাননি। গত ৫ আগস্টের পর নানা কুকীর্তির শিরোনাম হওয়া পতিত আওয়ামী লীগের এই এমপি কারাগারে। তারপরও এখনো কেউ ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না কেউ।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সদরঘাটের নবাববাড়িতে দেড় বিঘারও বেশি জায়গার ওপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাস ছিল। পুরনো হয়ে যাওয়ায় সেটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ২০১৫ সালে সেটি দখল করে নেন হাজী সেলিম। এরপর সেখানে তৈরি করেন আটতলা একটি মার্কেট। ‘গুলশানারা চিঠি’ নামে ওই কাপড়ের মার্কেটের নিচতলাতেই রয়েছে পাঁচ শতাধিক দোকান। এই মার্কেট দিয়েই শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন হাজী সেলিম। এখনো মার্কেটটি সেলিম পরিবারেরই নিয়ন্ত্রণে। ঠিক একইভাবে বাদামতলীতে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে বিআইডব্লিউটিএর প্রায় পাঁচ কাঠা জমি দখল করে বানিয়েছেন ফলের আড়ত। নাম দেয়া হয়েছে ‘এনটিসি ফলের আড়ত’। লালবাগের বেড়িবাঁধ এলাকায় বিআইডব্লিউটিএর প্রায় এক বিঘা জমি দখল করে বানিয়েছেন এমটিসি ক্রোকারিজ মার্কেট। অবৈধভাবে নদীর জমি দখল করে মার্কেট বানানোর কারণে বিআইডব্লিউটিএ একাধিকবার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে সেটি ভেঙে দেয়। ভেঙে দেয়ার কয়েক দিন পরই আবার আরো পোক্তভাবে মার্কেট তৈরি করেন হাজী সেলিম।

সূত্র আরো বলছে, নলগোলাতে প্রায় ১০ কাঠা খাস জমির ওপর বিহারিরা ঘরবাড়ি বানিয়ে বসবাস করত। হাজী সেলিম বিহারিদের উচ্ছেদ করে সেখানে বানিয়েছেন ‘হাজী সেলিম টাওয়ার’। আরমানিটোলাতে ঢাকা ওয়াসার মালিকানাধীন প্রায় ১০ কাঠা জায়গায় একটি পানির পাম্প ও ট্যাঙ্ক ছিল। ২০১০ সালে সেই জায়গাটি দখল করে হাজী সেলিম বানিয়েছেন ‘এমটিসি টাওয়ার’। ১৫ তলা ভবনটির নিচতলা কমার্শিয়াল।

এতেই ক্ষান্ত দেননি তিনি। ইমামগঞ্জে নিরীহ কয়েকজনের জমি দখল করে হাজী সেলিম ছেলের নামে তৈরি করছেন ‘ইরফান টাওয়ার’। জমির মালিকদের সাথে মামলাজনিত কারণে এর আগে কয়েকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেটার কাজ বন্ধ করে দেয়। কিছুদিন পর অদৃশ্য ক্ষমতাবলে সেখানে আবারো কাজ শুরু হয়। সেখানে ১০ তলা পর্যন্ত অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই ঈদের ছুটির মধ্যে হেরিটেজ তালিকাভুক্ত চকবাজারের ‘জাহাজ বিল্ডিং’টি দখল করে ভাঙা শুরু করেন হাজী সেলিম। দু’দিনের মধ্যে ভবনটি নিশ্চিহ্ন করে ফেলেন। সেখানে এখন ১১তলা ‘সোলায়মান টাওয়ার’। এভাবে চকবাজার এলাকায় কয়েকজন নিরীহ মানুষের প্রায় দেড় বিঘা জমি দখল করে তৈরি করেছেন আশিক টাওয়ার। জেলখানা রোডের চুড়িপট্টির দোকান দখল করে হাজী সেলিম নিজের নামে বানিয়েছেন ‘হাজী সেলিম টাওয়ার’।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে লালবাগের কামালবাগের চাঁদনীঘাট এলাকায় বধির স্কুল স্থাপনের জন্য প্রায় দুই বিঘা জায়গা বরাদ্দ দেয় সরকার। কিন্তু সেখানে আর বধির স্কুল তৈরি হয়নি। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বানিয়েছেন ‘মদিনা ফিলিং স্টেশন’। কামরাঙ্গীর চরের বেড়িবাঁধের লোহারপুলের পাশে বিআইডব্লিউটিএর দেড় বিঘা জায়গা দখল করে বানিয়েছেন লোহার মার্কেট। সোয়ারীঘাট এলাকায় বিআইডব্লিউটিএর ৫ কাঠা জায়গা দখল করে বানিয়েছেন নিজের কোম্পানি মদিনা ট্যাঙ্কের সেলস সেন্টার। সরকারি দলের দাপট দেখিয়ে পুরান ঢাকার অলিগলিতে যা খুশি তা-ই করেছেন হাজী সেলিম। এতে সহযোগী তার দুই ছেলে আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হওয়া সোলায়মান সেলিম ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কাউন্সিলর হওয়া ইরফান সেলিম। নানা অপকর্মের কারণে একাধিকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটকও হয়েছেন বাবা-ছেলে। তবে আইনের ফাঁকফোকর গলে আবার বেরিয়েও পড়েন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুরান ঢাকার এক ব্যবসায়ী জানান, হাজী সেলিম পরিবারের দাপটে এখানে গরিব অসহায় খেটে খাওয়া ও মধ্যবিত্ত সবাই সবসময় আতঙ্ক ও ভয়ে থাকেন কখন কার ওপর নজর পড়ে যায়। একবার নজর পড়লে তার আর রক্ষা নাই। ওই ব্যবসায়ী আরো জানান, ১৯৯৬-পরবর্তী সময়ে হাজী সেলিম নিজ এলাকার পঞ্চায়েত চালু করেন। জমি বা বাড়ি-সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে তার কাছে গেলে সেগুলো নামমাত্র মূল্যে কিনে দখল করে নিতেন। ক্যাডার বাহিনী দিয়ে জোর করে উচ্ছেদ করে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির ঘরে বা ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে দিতেন। ওই কারণে তিনি ‘তালা হাজী’ নামেও পরিচিতি পান।

স্থানীয় সূত্র বলছে, অসুস্থতার কারণে হাজী সেলিম ধীরে ধীরে বাক প্রতিবন্ধী হয়ে যান। এরপর থেকে শুরু হয় ছেলেদের ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার গল্প। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ২০২০ সালে কলাবাগানে গাড়ির সাইড দেয়া নিয়ে মোটর সাইকেল আরোহী বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধর ও তার স্ত্রীকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন মেজ ছেলে ইরফান সেলিম ও তার সহযোগীরা। ওই ঘটনার পর বাহিনীর চাপে গ্রেফতার হন ইরফান। এরপরই উন্মোচন হতে থাকে হাজী সেলিম পরিবারের ভয়ঙ্কর সব অজানা অধ্যায়। বাসার নিচে থাকা টর্চার সেলের নানা কাহিনীও ফাঁস হয়ে যায়। ওই বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে অবৈধভাবে রাখা বিপুল সংখ্যক ওয়াকিটকি ও বিদেশী মদের বোতল উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ রকম আরো ভয়ঙ্কর নানা গল্প রয়েছে হাজী সেলিম পরিবারের ত্রাসের রাজত্ব নিয়ে।

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের নজিরবিহীন পতনের পর ২ সেপ্টেম্বর পুরান ঢাকার বংশাল এলাকা থেকে গ্রেফতার হন হাজী সেলিম। এরপরই গ্রেফতার হন তার বড় ছেলে সোলায়মান সেলিম ও মেজ ছেলে ইরফান সেলিম। ছোট ছেলে আশিক আগেভাগেই অস্ট্রেলিয়াতে পাড়ি জমিয়েছেন। তবুও সাঙ্গোপাঙ্গদের ছত্রছায়ায় পুরান ঢাকায় এ পরিবারের রাজত্ব বহালতবিয়তেই রয়েছে। তার পালিত ক্যাডার বাহিনী এখনো তার রেখে যাওয়া সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে বলে জানা গেছে।

হাজী সেলিম কারাগারে থাকায় তার ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের বিষয়ে কোনো বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।