গাজায় আবারো ইসরাইলের ড্রোন হামলা : ৩ ফিলিস্তিনি নিহত

Printed Edition

- পশ্চিমতীরে জমি দখল করছে ইসরাইল

- আরো দুই ইসরাইলি বন্দীর লাশ ফেরত

- হামাসের বিরুদ্ধে চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র

- রাফাহ সীমান্ত খুলতে প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরাইল

নয়া দিগন্ত ডেস্ক

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও বিভিন্নভাবে হামলা অব্যাহত রেখেছে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী। খান ইউনুসের বানি সুআইলা এলাকায় গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে একটি ইসরাইলি কোয়াডকপ্টার ড্রোন থেকে বোমা নিেেপ দুই ব্যক্তি নিহত হন। অন্য ব্যক্তি দুই দিন আগে গাজা সিটির কলেজ অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির কাছে গুলিবিদ্ধ হন এবং গতকাল তার মৃত্যু হয়। আগে জানা গিয়েছিল, বানি সুআইলা এলাকায় ড্রোন হামলায় দুইজন আহত হন, যাদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

গতকাল বৃহস্পতিবার গাজা উপত্যকার খান ইউনুস এলাকায় ড্রোন হামলা চালায় ইসরাইল। স্থানীয় সূত্র জানায়, যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকলেও এলাকায় গোলাবর্ষণ ও হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরাইলি বাহিনী। গাজার আল-আহলি হাসপাতালে কর্মরত এক চিকিৎসক জানিয়েছেন, গাজা সিটির শুজায়া এলাকায় ইসরাইলি গোলাবর্ষণে দুই ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর আগের দিনও ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় অবরুদ্ধ উপত্যকায় অন্তত নয়জন নিহত হয়েছিলেন।

এ দিকে দখলকৃত পশ্চিমতীরে রামাল্লাহর উত্তর-পূর্বে আল-মুগাইয়ির গ্রামে একটি বাড়ি ভেঙে দিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। গ্রাম পরিষদের প্রধান আমিন আবু আলিয়া সংবাদ সংস্থা ওয়াফাকে জানিয়েছেন, ইসরাইলি সেনারা গ্রামটি ঘেরাও করে এবং ওয়াজিহ মুসা আবু আলিয়ার নির্মাণাধীন দুইতলা বাড়িটি ভেঙে ফেলে। বাড়িটি অনুমতি ছাড়া নির্মাণ করা হচ্ছিল বলে দাবি করে ইসরাইলি বাহিনী। আলজাজিরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও যাচাই করে দেখেছে, যেখানে দেখা যায় ইসরাইলি সেনারা একটি এক্সকাভেটর ব্যবহার করে ভবনটি ধ্বংস করছে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বুধবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ২৫ জনের লাশ হাসপাতালে আনা হয়েছে, যার মধ্যে লাশ ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়। আর একজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এই সময়ে আহত হয়েছেন আরো ৩৫ জন। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরাইলি হামলায় গাজায় অন্তত ৬৭ হাজার ৯৩৮ জন নিহত এবং এক লাখ ৭০ হাজার ১৬৯ জন আহত হয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের দৈনিক পরিসংখ্যান রিপোর্টে বলা হয়েছে, বহু মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে রয়েছেন। অ্যাম্বুলেন্স ও সিভিল ডিফেন্স কর্মীরা সেখানে পৌঁছাতে পারছেন না।

পশ্চিমতীরে জমি দখল করছে ইসরাইল : এ দিকে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও পশ্চিমতীরে হামলা ও ফিলিস্তিনিদের জমি দখল অব্যাহত রেখেছে দখলদার ইসরাইল। পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনিদের জমি দখলের জন্য গত বুধবার দু’টি সামরিক আদেশ জারি করেছে ইসরাইলি কর্তৃপ। ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা ওয়াফার তথ্যমতে, পশ্চিমতীরের কালকিলিয়া গভর্নরেটের কাছে বসতি সম্প্রসারণ ও অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ২ দশমিক ৫ হেক্টর ফিলিস্তিনি জমি দখলের ডিক্রি জারি করা হয়েছে। কালকিলিয়ায় ইসরাইলি বসতি কার্যক্রম পর্যবেক মুনিফ নাজ্জাল জানিয়েছেন, ইসরাইলি সেনাবাহিনী কালকিলিয়ার পূর্বে আজজুন শহরের ২.৫ হেক্টর জমি বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দিয়েছে। দখল করা এ জমিতে একটি সড়ক নির্মাণ করা হবে, যা আলফি মেনাশে বসতিকে কালকিলিয়া–নাবলুস সড়কের সাথে যুক্ত করবে। দ্বিতীয় আদেশে আজজুন ও জাইয়ুস শহরে প্রায় ২ দশমিক ১ হেক্টর জমি দখলের অনুমোদন দেয়া হয়েছে, যেখানে তজুফিম বসতির চারপাশে নিরাপত্তা প্রাচীর নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। আলফি মেনাশে ও তজুফিম- উভয় বসতিই আজজুন, জাইয়ুস ও কাফর থুলথ শহরের ফিলিস্তিনি মালিকানাধীন জমির ওপর নির্মিত।

ওয়াফা জানিয়েছে, এসব এলাকায় ক্রমাগত বসতি সম্প্রসারণের ফলে কৃষিজমি হারাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা, যাদের জীবিকা মূলত কৃষিনির্ভর। ফলে তাদের অর্থনৈতিক টিকে থাকা সরাসরি হুমকির মুখে পড়ছে। উল্লেখ্য, ১৯৬৭ সালে দখলকৃত অঞ্চলে নির্মিত ইসরাইলি বসতি আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ এবং এগুলো একটি কার্যকর ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনে প্রধান বাধা হিসেবে বিবেচিত।

আরো ২ ইসরাইলি বন্দির লাশ ফেরত : ইসরাইলি সেনাবাহিনী বলেছে, গত বুধবার আন্তর্জাতিক সংস্থা রেডক্রস গাজা উপত্যকা থেকে হামাসের ফেরত দেয়া আরো দুই বন্দীর লাশ তাদের কাছে হস্তান্তর করেছে। ইসরাইলি বন্দী হিসেবে চিহ্নিত করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ওই লাশগুলো হস্তান্তর করেছে। খবর আলজাজিরার। এর আগে গত সোমবার চার ইসরাইলি বন্দীর লাশ এবং গত মঙ্গলবার তিন ইসরাইলি বন্দীর লাশ বুঝে পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে ইসরাইল। তবে বুধবার রাতে হস্তান্তর করা দু’টি লাশের পরিচয় সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ডিএনএ পরীার জন্য ওই দুই লাশ ইসরাইলের মধ্যাঞ্চলে ফরেনসিক ইনস্টিটিউটে পাঠানো হচ্ছে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরাইলের সাথে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছায়। ইসরাইল থেকে ফিলিস্তিনি কারাবন্দীদের মুক্তির বিনিময়ে গাজা থেকে ইসরাইলি বন্দিদের মুক্তি দিতে সম্মত হয় তারা। এর অংশ হিসেবে সোমবার থেকে বন্দীদের মুক্তি দিচ্ছে তারা। হামাস বলেছে, তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা শান্তি পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করেছে। সব জীবিত ইসরাইলি বন্দীকে ফেরত দেয়া হয়েছে। মৃত বন্দীদের মধ্যে যাদের লাশ খুঁজে পাওয়া গেছে, সেগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে। ফিলিস্তিনি এই সংগঠন এবং রেডক্রস বলেছে, গাজার ধ্বংসাবশেষ থেকে বন্দীদের লাশ উদ্ধার করাটা চ্যালেঞ্জিং। আবার কিছু লাশ ইসরাইলি বাহিনী নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় রয়েছে। এক জ্যেষ্ঠ মার্কিন উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেছেন, লাশ খুঁজে ফেরত দেয়ার জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের চেষ্টা করবে বলে হামাস তাদের আশ্বাস দিয়েছে। ওই মার্কিন উপদেষ্টা মনে করেন, গাজার নাগরিকদের লাশ খুঁজে দেয়ার জন্য প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে। এতে তারা লাশ দেখলে তথ্য জানানোর ব্যাপারে উৎসুক হতে পারে। হামাস জানিয়েছে, তারা ইসরাইলি বন্দীদের যেসব লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, সেগুলোর সবই ফেরত দিয়েছে। সংগঠনটির সামরিক শাখা ‘আল-কাসসাম ব্রিগেড’ বলেছে, বাকি লাশগুলো উদ্ধারে ‘বিশেষ সরঞ্জাম ও ব্যাপক প্রচেষ্টা’ প্রয়োজন। সিএনএন, দ্য গার্ডিয়ান জানায়, আল-কাসসাম ব্রিগেড এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘আমরা চুক্তি অনুযায়ী কাজ করেছি। আমাদের হেফাজতে থাকা সব জীবিত বন্দী এবং যেসব লাশ পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে, সেগুলো হস্তান্তর করেছি।’ সিএনএন সূত্রে জানা গেছে, ইসরাইল আগেই জানত যে, সব লাশ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাওয়া না-ও যেতে পারে। তবুও ইসরাইলি নেতৃত্ব এখন এ বিলম্বে ক্রমেই বিরক্ত হয়ে উঠছে এবং পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে বিকল্প পদপে বিবেচনা করছে।

হামাসের বিরুদ্ধে চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র : হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতির শর্ত ভঙ্গের অভিযোগ গুরুত্ব দিচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র। বন্দীদের লাশ ফেরত দেয়া ঘিরে ইসরাইলের তরফ থেকে এমন অভিযোগ উঠলে তার জবাবে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে মার্কিন প্রশাসন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে। চুক্তি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ২৯ জন বন্দীর মধ্যে ৯ জনের লাশ ফেরত দিয়েছে হামাস। ইসরাইলি সেনাবাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, গত বুধবার ফেরত আসা দুই লাশের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। তারা ছিলেন ২৭ বছর বয়সী ইনবার হায়মান এবং ৩৯ বছর বয়সী সার্জেন্ট মেজর মুহাম্মদ আল-আত্রেশ। হায়মান ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর নোভা উৎসবে হামাসের হামলায় নিহত হন এবং তার লাশ গাজায় নেয়া হয়। একই দিনে যুদ্ধে নিহত হন আল-আত্রেশ। মৃত বন্দীদের লাশ ফেরত না দেওয়াকে কেন্দ্র করে ইসরাইল গাজায় প্রতিশ্রুত সাহায্যসামগ্রী সীমিত করেছে। তাদের অভিযোগ, লাশ ফেরত দেয়া নিয়ে গড়িমসি করে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করছে হামাস। তবে ট্রাম্প প্রশাসন বলেছে, হামাস চুক্তি ভঙ্গ করেছে বলে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে না। বরং তারা সব জীবিত বন্দী ফেরত দিয়েছে এবং নিহতদের লাশ উদ্ধারে বিভিন্ন পরে সাথে কাজ করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দুই জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা জানিয়েছেন, গাজায় বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীকে নিরস্ত্রীকরণ ও নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরিকল্পনা এগিয়ে চলছে।

রাফাহ সীমান্ত খুলতে প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরাইল : ইসরাইলের প্রতিরা মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, গাজার দেিণ মিসরের সাথে রাফাহ সীমান্ত খুলে দেয়ার প্রস্তুতি চলছে, যাতে মানুষ চলাচল করতে পারে। তবে সীমান্ত খুলবে কবে, তা পরে জানানো হবে। মানবিক সহায়তা এই পথ দিয়ে যাবে না, এমনটাই স্পষ্ট করেছে ইসরাইল। টাইমস অব ইসরাইল জানায়, ইসরাইল আগেই সতর্ক করেছিল, রাফাহ সীমান্ত বন্ধ রাখা হতে পারে এবং গাজায় সহায়তা কমিয়ে দেওয়া হতে পারে। কারণ, হামাস বন্দীদের লাশ ফিরিয়ে দিতে অত্যন্ত ধীরগতিতে কাজ করছে। এই পরিস্থিতি যেকোনো সময় যুদ্ধবিরতির ঝুঁকি বাড়াতে পারে, যা দুই বছরের ভয়াবহ যুদ্ধ থামিয়েছে এবং হামাসের হাতে থাকা জীবিত সব বন্দীকে মুক্তি দিয়েছে। ইসরাইলের প্রতিরা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সিওজিএটি (কোঅরডিনেটর অফ গভারমেন্ট এক্টিভিটিসিন দ্য টেরিটরিস) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘ইসরাইল ও মিসর যৌথভাবে রাফাহ সীমান্ত খুলে দেয়ার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পরই পথচারীদের জন্য সময়সূচি ঘোষণা করা হবে।’ সিওজিএটি আরো জানিয়েছে, *মানবিক সহায়তা এখনো কেরেম শালোম সীমান্ত দিয়ে গাজায় প্রবেশ করছে, এবং অন্যান্য সীমান্ত দিয়েও যাচ্ছে। সিওজিএটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘জোর দিয়ে বলা হচ্ছে, রাফাহ সীমান্ত দিয়ে কোনো মানবিক সহায়তা যাবে না। এই বিষয়ে কখনোই কোনো চুক্তি হয়নি।’ গাজা থেকে মিসরের মাধ্যমে আসা সহায়তা সাধারণত রাফাহ সীমান্তে অপো করে, পরে তা নিৎসানা বা কেরেম শালোম সীমান্তে পাঠানো হয়, কারণ রাফাহ সীমান্ত যুদ্ধের কারণে ব্যাপকভাবে তিগ্রস্ত। মঙ্গলবার ইসরাইল সিদ্ধান্ত নেয়, পরদিন রাফাহ সীমান্ত খুলবে না, যদিও যুদ্ধবিরতির চুক্তি অনুযায়ী তা খোলার কথা ছিল। ইসরাইল অভিযোগ করে, হামাস এখনো সব বন্দীর লাশ ফেরত দেয়নি, যা তাদের প্রতিশ্রুতির লঙ্ঘন।