‘খরার সাথে চলে গেল’ ফিলিস্তিনের অনাহারে নগুগির প্রতিধ্বনি

Printed Edition

মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন

নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও, কেনিয়ার একজন কিংবদন্তি সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ, তার রচনার মাধ্যমে উপনিবেশবাদ, সাংস্কৃতিক অবদমন এবং সামাজিক অবিচারের মতো গভীর বিষয়গুলোকে দক্ষতার সাথে তুলে ধরেছেন। ১৯৩৮ সালে কেনিয়ার কামিরিথুতে এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণকারী নগুগি শৈশব থেকেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের নির্মম বাস্তবতা এবং মাউ মাউ বিদ্রোহের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন। এই অভিজ্ঞতাগুলো তার সাহিত্যকর্মকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। নগুগি তার যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘ডিকোলোনাইজিং দ্য মাইন্ড’-এর জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত, যেখানে তিনি আফ্রিকান লেখকদের ঔপনিবেশিক ভাষা ত্যাগ করে তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় সাহিত্য রচনার আহ্বান জানান। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘উইপ নট, চাইল্ড’, ‘দ্য রিভার বিটুইন’, এবং ‘এ গ্রেইন অফ হুইট’ উল্লেখযোগ্য। নগুগির কাজ শুধু কেনিয়ার ভৌগোলিক সীমানায় আবদ্ধ নয়, বরং এটি বিশ্বজুড়ে সব নিপীড়িত মানুষের সংগ্রামের এক শক্তিশালী প্রতিচ্ছবি।

নগুগি’র প্রতিটি লেখা ঔপনিবেশিক শাসন তথা পশ্চিমা পুঁজিবাদী সংস্কৃতির যে কালো দিক যা আধুনিকতা ও সভ্যতার আড়ালে অ-পশ্চিমাদের নগ্ন অমানবিক আচরণের চিত্র তুলে ধরেছেন। তার সবচেয়ে বড় দু’টি তাত্ত্বিক কথা হলো: এক. মানুষের মনকে অ-উপনিবেশায়ন কর, অর্থাৎ গত শতাব্দীতে পৃথিবীর প্রায় দেশগুলো ভৌগোলিক উপনিবেশ মুক্ত হলেও মনস্তাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, ভাষিক ও অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদের নতুন জালে আটকে নতুন-উপনিবেশবাদ বা নিও-কলোনিয়ালিজম তৈরি করে আবারও দাসত্বের শিকলে আটকে ফেলে। দুই, সাবেক উপনিবেশিত দেশগুলো বিশ্বায়নের নামের পশ্চিমাদের ফাঁদের আটকে ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষাকে গ্রহণ করে, যা রি-কলোনিয়ালিজম তৈরি করে। ফলে, তিনি প্রতিটি মানুষকে তার মাতৃভাষা দিয়ে সাহিত্য রচনা করার আহ্বান করেছেন। ফলে, তিনি সাবেক উপনিবেশিত দেশগুলোর দেশপ্রেমিকদের আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠেন।

নগুগির ‘খরার সাথে চলে গেল’ গল্পটি লেখার সময়ে কেনিয়া ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে সদ্য স্বাধীনতা লাভ করেছে। ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভূমি অধিগ্রহণ এবং ঐতিহ্যবাহী কৃষিব্যবস্থার পরিবর্তনের ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে কিকুয়ু সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক প্রভাব পড়ে। এর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সামাজিক অস্থিরতা গল্পে প্রতিফলিত হয়েছে।

কেনিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে খরা একটি পুনরাবৃত্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা প্রায়শই মারাত্মক দুর্ভিক্ষ এবং মানবিক সঙ্কটের সৃষ্টি করে। গল্পে বর্ণিত পরিস্থিতি, যেমন- ফসল নষ্ট হওয়া, গবাদি পশুর মৃত্যু এবং খাদ্যাভাব, এই অঞ্চলের মানুষের বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি।

গল্পটিতে ঐতিহ্যবাহী বিশ্বাস এবং আধুনিকতার মধ্যকার দ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছে। গ্রামের মানুষেরা একদিকে যেমন বৃষ্টির জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছে, তেমনি অন্যদিকে রেডিওতে আবহাওয়ার পূর্বাভাসের উপর নির্ভর করছে। এই দুইয়ের মধ্যবর্তী টানাপড়েন তাদের অসহায়ত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

খরা এবং দুর্ভিক্ষের ফলে সৃষ্ট দারিদ্র্য মানুষের মানবিক সম্পর্কগুলোকে এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করে। গল্পে দেখা যায়, খাদ্যের অভাবে মানুষ কতটা মরিয়া হয়ে উঠতে পারে এবং প্রতিবেশীদের মধ্যকার সম্পর্কগুলোও কিভাবে বদলে যায়।

সংক্ষেপে, ‘খরার সাথে চলে গেল’ গল্পটি একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলের মানুষের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরলেও, এর আবেদন সার্বজনীন। এটি প্রকৃতি, সমাজ এবং মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্বের এক মর্মস্পর্শী আখ্যান। এই গল্পটি বর্তমানে আফ্রিকা অঞ্চলে ঔপনিবেশিক তথা পশ্চিমা নির্মমতাকে ছাড়িয়ে ফিলিস্তিনি জনগণের বর্তমান প্রেক্ষাপটকেও মনে করিয়ে দেয়।

নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ওর ‘খরার সাথে চলে গেল’ গল্পটি কেবল কেনিয়ার একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের দুর্ভিক্ষের চিত্রায়ণ নয়, এটি মানবসৃষ্ট ক্ষুধার এক সর্বজনীন ট্র্যাজেডি। আজ যখন আমরা ফিলিস্তিনের দিকে তাকাই, যেখানে জাতিসঙ্ঘের মানবিকবিষয়ক সমন্বয় অফিসের (ইউএনওসিএইচএ) মতে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ অনাহারের দ্বারপ্রান্তে, তখন নগুগির গল্পের প্রতিটি চরিত্র- অসহায় মা, ক্ষুধার্ত শিশু, এবং উদাসীন কর্তৃপক্ষ- গাজার ধ্বংসস্তূপের মাঝে এক ভয়াবহ বাস্তবতায় জীবন্ত হয়ে ওঠে। ফিলিস্তিনিদের প্রতি এই উদাসীনতা নিছক উদাসীনতা নয়। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের কৌশল। এই কৌশল একটি মানবিক সঙ্কট তৈরির মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিমদের আগামী দিনে জায়ানিজমের ভবিষ্যৎ বার্তা ফুটে ওঠে, যা ঘুমন্ত জাতির পক্ষে বুঝে ওঠা কঠিন। কিন্তু নগুগি এই সঙ্কট আগেই উপলব্ধি করেছেন। নগুগির গল্পের সেই লাইন, ‘পুরো দেশটাই সাদা মনে হচ্ছিল- মৃত্যুর শুভ্রতা’, আজকের গাজার ধূসর, প্রাণহীন বাস্তবতার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, যেখানে মৃত্যু যেন জীবনের চেয়েও বেশি স্পষ্ট।

নগুগির গল্পের কেনিয়া এবং আজকের ফিলিস্তিনের মধ্যে এক অদ্ভুত সমান্তরাল বাস্তবতা চোখে পড়ে। গল্পে যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ খরাকে ঔপনিবেশিক অবহেলা আরও ভয়াবহ করে তুলেছিল, তেমনি ফিলিস্তিনে ইসরাইলি অবরোধ এক মানবসৃষ্ট খাদ্যসঙ্কট তৈরি করেছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) কর্তৃক স্বীকৃত। গল্পে যেমন ‘ডি.ও.-র অফিসে’ রেশনের জন্য দীর্ঘ লাইন দেখা যায়, তেমনি গাজায় জাতিসঙ্ঘের ত্রাণ ও কর্মসংস্থান সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ) পরিবেশিত ত্রাণের জন্য অসহায় মানুষের দীর্ঘ অপেক্ষা করতে দেখা যায়। সবচেয়ে মর্মান্তিক মিল খুঁজে পাওয়া যায় ক্ষুধার্ত শিশুর আর্তনাদে। নগুগির গল্পের ছেলেটি যখন তার মাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আমি কি মরে যাব?’, তার সেই আর্তি প্রতিধ্বনিত হয় গাজার শিশুদের কণ্ঠে, যারা প্রতিনিয়ত জানতে চায়, ‘আমরা কবে খাব?’ আল জাজিরার বিভিন্ন প্রতিবেদনে এই করুণ চিত্র উঠে এসেছে। এই দুটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট আসলে একই মানবসৃষ্ট সঙ্কটের ভিন্ন ভিন্ন রূপ, যেখানে ক্ষমতা ও রাজনীতির নির্মম খেলায় সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শিশুরা, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও তার গল্পে কেবল দুর্ভিক্ষের একটি সরল বর্ণনা দেননি; তিনি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে দেখিয়েছেন কিভাবে ক্ষুধাকে একটি রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই একই কৌশল আজকের ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে আরও স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। নগুগির গল্পে খরা-বিধ্বস্ত জমিতেও নারীরা গাছ লাগিয়ে আশায় বুক বাঁধে, এই চিত্রটি ফিলিস্তিনি কৃষকদের কথা মনে করিয়ে দেয়, যারা ইসরাইলি বুলডোজারে ধ্বংস হওয়া জমিতে বারবার চাষের চেষ্টা করে জীবনের স্বপ্ন বুনতে চায়। গল্পের বৃদ্ধার মতো ফিলিস্তিনি মায়েরাও হয়তো তাদের সন্তানদের অপুষ্টিতে শীর্ণ হয়ে যাওয়া শরীর ছেঁড়া কাপড়ে ঢেকে রাখেন, যা ইউএন উইমেনের বিভিন্ন প্রতিবেদনে ওঠে আসা নারী ও শিশুদের দুর্দশার প্রতিচ্ছবি। গল্পের শেষে নিভে যাওয়া লণ্ঠন যেমন চরম হতাশার প্রতীক, তেমনি গাজার অন্ধকার ধ্বংসস্তূপের মাঝে জ্বলে থাকা মোমবাতির আলো প্রতিরোধের এক অদম্য মানবিক শিখা। এই দু’টি চিত্রই দেখায় যে, চরম প্রতিকূলতার মাঝেও মানুষ কিভাবে বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে নেয় এবং প্রতিবাদ জানায়।

‘খরার সাথে চলে গেল’ গল্পে বৃদ্ধার জন্য নিয়ে আসা খাবারগুলো যেভাবে অস্পৃশ্য থেকে যায়, তা আজকের ফিলিস্তিনে প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত সাহায্যবাহী ট্রাকগুলোর এক শক্তিশালী প্রতীক।(৫) গল্পে কথক বলছেন, ‘আমি এক কোণে আমার দেওয়া সব উপহার দেখতে পেলাম; খাবারগুলো ছোঁয়া হয়নি।’ এই দৃশ্যটি গাজার বর্তমান পরিস্থিতির কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে অক্সফামের ২০২৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রেরিত সাহায্যের ৮০ শতাংশই মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে না। এটি নিছক খাদ্যাভাব নয়, বরং এটি একটি পরিকল্পিত অনাহার, যা একটি জনগোষ্ঠীকে সমষ্টিগতভাবে শাস্তি দেয়ার এক নির্মম কৌশল। ফিলিস্তিনিদের জন্য এই ‘অন্নহীন ভোজ’ একটি বাস্তবতা, যেখানে খাবার চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও তা তাদের নাগালের বাইরে।

নগুঙ্গি ওয়া থিয়োঙ্গ’র গল্পটি আমাদের এক মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি করে : খরা কি কেবলই প্রকৃতির রোষ, নাকি মানুষের তৈরি এক বিপর্যয়? ফিলিস্তিনের চলমান সঙ্কট এই প্রশ্নের এক নির্মম উত্তর দেয়। ‘খরা চলে গেল, কিন্তু ক্ষুধা রয়ে গেল, রয়ে গেল সেই ব্যবস্থা যে ক্ষুধাকে অস্ত্র বানায়।’ গাজার অনাহার প্রমাণ করে, নগুগির গল্পের সেই ‘সাদা মৃত্যু’ কোনো অতীতকালের ঘটনা নয়; এটি আজও বিশ্বের কোনো না কোনো প্রান্তে এক জীবন্ত বাস্তবতা। ফিলিস্তিনের প্রেক্ষাপটে এই ‘খরা’ কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যা একটি জাতিকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। নগুগির গল্প এবং ফিলিস্তিনের বাস্তবতা উভয়ই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ক্ষুধা প্রায়শই প্রকৃতির চেয়ে রাজনীতিরই নির্মম সৃষ্টি।

ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশ যেমনটা বলেছিলেন, ‘ক্ষুধার্ত শিশুকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় ‘তোমার কী চাও?’, তার উত্তর হয় ‘রুটি’... কিন্তু আসলে সে চায় জীবন।’ এই একটি বাক্যেই নগুগির গল্পের গভীরতা এবং ফিলিস্তিনের বর্তমান আর্তনাদ এক বিন্দুতে এসে মিলিত হয়। এটি কেবল খাদ্যের অভাব নয়, এটি জীবন, সম্মান এবং ভবিষ্যতের এক নিরন্তর সংগ্রাম।