নিজস্ব প্রতিবেদক
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ঢাকার চাঁনখারপুলে শিার্থী আনাসসহ ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় স্যা দিয়েছেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারী ও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। গতকাল বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) বিচারপতি মো: গোলাম মর্তুজা মজুমদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ তিনি স্যা প্রদান করেন। স্যা শেষে আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘চাঁনখারপুলে যে হত্যাযজ্ঞ হয়েছিল, তার সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া জরুরি। এটি ছিল পরিকল্পিত গণহত্যা।’
মামলার পটভূমি : ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের দিন চাঁনখারপুল এলাকায় পুলিশের গুলিতে শিার্থী শহীদ আনাসসহ ছয়জন নিহত হন। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা চলতি বছরের ১১ এপ্রিল মামলার তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনে জমা দেয়। এরপর প্রধান কৌঁসুলি মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ২৫ মে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন। অভিযোগ আমলে নিয়ে ট্রাইব্যুনাল সে দিনই সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, চানখারপুল এলাকায় আসামিরা নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ল্য করে ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র’ ব্যবহার করে আনাস, শেখ মেহেদী হাসান জুনায়েদ, মো: ইয়াকুব, মো: রাকিব হাওলাদার, মো: ইসমামুল হক এবং মানিক মিয়াকে হত্যা করে।
এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদনটি ৯০ পৃষ্ঠার, যেখানে ৭৯ সাীর জবানবন্দী, ১৯টি ভিডিও, ১১টি সংবাদ প্রতিবেদন, দু’টি অডিও, ১১টি বই ও রিপোর্ট এবং ছয়টি ডেথ সার্টিফিকেট সংযুক্ত করা হয়েছে। তদন্তে সময় লেগেছে ছয় মাস ১৩ দিন। গত ১৪ জুলাই ট্রাইব্যুনাল সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন।
আসিফ মাহমুদের জবানবন্দী : ‘হত্যার নির্দেশ ছিল, দয়া করে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছি’
আসিফ মাহমুদ প্রথম স্যা দেন গত ৯ অক্টোবর। তার ভাষায়- ‘আন্দোলন প্রত্যাহারে আমাদের ওপর চাপ ও হুমকি প্রদান করতে থাকে তৎকালীন ডিবি প্রধান হারুনুর রশীদ (ডিবি হারুন) এবং রমনা জোনের ডিসি হুমায়ুন কবীর। তারা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশেই আমাদের তুলে আনা হয়েছে এবং আন্দোলন প্রত্যাহার না করলে হত্যা করা হবে। এমনকি তারা বলে, ‘দয়া করে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছি’।
বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনাল-১ এর আরো দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি মো: শফিউল আলম মাহমুদ ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো: মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। জবানবন্দীতে আসিফ মাহমুদ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে তাকে গুম করা, আন্দোলন প্রত্যাহারের জন্য চাপ প্রয়োগ এবং আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোর অভিযোগ তোলেন।
কোটা আন্দোলন থেকে গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত : ২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলনের সাথে আসিফ মাহমুদের সম্পৃক্ততা ছিল সক্রিয়। তিনি বলেন,
‘২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্ট কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন অবৈধ ঘোষণা করলে আমরা প্রতিবাদে তাৎণিক মিছিল করি। ঈদের ছুটির পর ১ জুলাই থেকে সারা দেশে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চলতে থাকে। ১৪ জুলাই শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যে (‘রাজাকারের নাতি-নাতনী’) আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়।’
১৫ জুলাই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ‘ছাত্রলীগই যথেষ্ট’ মন্তব্যের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলায় বহু শিার্থী আহত হন। ১৬ জুলাই সারা দেশে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে পুলিশের গুলিতে রংপুর ও চট্টগ্রামে ছয়জন নিহত হন।
১৭ জুলাই শহীদ মিনারে গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিলের সময়ও পুলিশ হামলা চালায়। এরপর সরকার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে।
কমপ্লিট শাটডাউন ও গুম : ১৮ জুলাই সারা দেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে কমপে ২৯ জন নিহত হন। সরকারের প থেকে নাশকতার দায় আন্দোলনকারীদের ওপর চাপিয়ে মিথ্যা মামলা ও গণগ্রেফতার শুরু হয়। রাতেই ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়।
১৯ জুলাই সারা দেশে শতাধিক নিহতের খবর পাওয়া যায়। সেদিন রাতে ঢাকার গুলশান নিকেতন এলাকা থেকে ডিবি পরিচয়ে সাদা পোশাকধারীরা আসিফ মাহমুদকে তুলে নিয়ে যায়। পরে তিনি জানান, তাকে একটি অজানা স্থানে রেখে আন্দোলন প্রত্যাহারের ভিডিও বার্তা দিতে চাপ দেয়া হয়; রাজি না হলে তাকে ইনজেকশন পুশ করে অজ্ঞান করা হয়। ২৪ জুলাই সকালে মুক্তি দেয়ার পর তিনি বুঝতে পারেন, তাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ‘আয়না ঘরে’ আটকে রাখা হয়েছিল।
এরপর তাকে ও অন্যান্য সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আবু বাকের মজুমদার, হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম, নুসরাত তাবাসুমকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হয়। সেখানে জোরপূর্বক লিখিত বক্তব্যে স্বার করিয়ে ভিডিও রেকর্ড করা হয়।
৩২ ঘণ্টা আমরণ অনশন শেষে ১ আগস্ট তাদের মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তির পর তারা প্রকাশ্যে জানান, ডিবি অফিসে জোরপূর্বক ভিডিও বার্তা নেয়া হয়েছিল।
অসহযোগ আন্দোলন ও ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান : ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে এক দফা ‘সরকার পতন ও ফ্যাসিবাদ বিলোপে’ অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেয়া হয়। ৪ আগস্ট শাহবাগে পুলিশের গুলিতে চারজন নিহত হন। পরদিন ৫ আগস্টের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি দুই ঘণ্টা এগিয়ে এনে ঘোষণা দেন আসিফ মাহমুদ। ৫ আগস্ট সকাল থেকে সারা দেশের মানুষ ঢাকায় প্রবেশ করতে থাকেন। তিনি জানান, ‘চাঁনখারপুল এলাকায় আমরা ৪০০-৫০০ আন্দোলনকারী ছিলাম। বেলা ১১টার দিকে পুলিশ ও এপিবিএন সদস্যরা গুলি চালায়। আমার সামনে দুইজন নিহত হন। পরে জানতে পারি, আনাস, ইসমামুল ও ইয়াকুবসহ ছয়জন শহীদ হয়েছেন।’ বেলা ১টা ৩০ মিনিটে শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়লে তারা মিছিল নিয়ে গণভবনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন এবং বিকেল ৪টার দিকে সংসদ ভবন এলাকায় পৌঁছান।
হত্যাযজ্ঞের দায়ভার ও ন্যায়বিচারের দাবি : আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের হামলায় প্রায় দেড় সহস্রাধিক মানুষ নিহত এবং ৩০ হাজারেরও বেশি আহত হন। অনেকেই স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়েছেন।’
তিনি এ হত্যাযজ্ঞের জন্য সরাসরি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ সংশ্লিষ্ট কমান্ডিং কর্তৃপ ও গুলি চালানো সদস্যদের দায়ী করেন।
তার ভাষায়, ‘আমাদের গুম করে রাখার সময় ডিবি কর্মকর্তারা বারবার বলেছিল, তারা শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে আমাদের তুলে এনেছে এবং আন্দোলন দমন করছে। তাই এই হত্যাকাণ্ডের দায় তাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলের ওপরেই বর্তায়।’


