বাংলাদেশের আর্থিক খাতের অতি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলামের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার আপত্তিকর ভিডিও ছড়িয়ে পড়া এবং দায়িত্ব পালনে নানা অনিয়ম ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করে তার নিয়োগের অবশিষ্ট মেয়াদ বাতিল করে। জনস্বার্থে গৃহীত এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হয়।
প্রজ্ঞাপন ও আইনি ভিত্তি : অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকারের সাথে সম্পাদিত চুক্তিপত্রের অনুচ্ছেদ-৭ অনুযায়ী এএফএম শাহীনুল ইসলামের নিয়োগের অবশিষ্ট মেয়াদ বাতিল করা হলো। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে এ ধারা অনুসারে সরকার চাইলে জনস্বার্থে অবশিষ্ট মেয়াদ বাতিল করার ক্ষমতা রাখে। এ ক্ষমতাই প্রয়োগ করা হয়েছে তার ক্ষেত্রে।
তদন্ত কমিটি গঠন : আপত্তিকর ভিডিও প্রকাশের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুরোধে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ দ্রুত চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয় বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সাঈদ কুতুবকে, সদস্যসচিব ছিলেন যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম। সদস্য হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম এবং আইসিটি বিভাগের পরিচালক মো: মতিউর রহমান। কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতেই নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্ত আসে বলে জানা গেছে।
বিতর্কিত উপস্থিতি ও পেছনের দরজা দিয়ে প্রস্থান : ভিডিও ফাঁস হওয়ার পর গভর্নরের নির্দেশে গত ১৯ আগস্ট তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হলেও তিনি ২০ আগস্ট কথিত ‘হাই কমান্ডের নির্দেশে’ অফিসে আসেন। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি এড়াতে তাকে বিকেলের দিকে ব্যাংকের পেছনের দরজা দিয়ে প্রাঙ্গণ ত্যাগ করতে হয়। অনেকে এটিকে গত বছরের ৫ আগস্ট পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের কিছু ডেপুটি গভর্নরের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তি হিসেবে উল্লেখ করেন।
নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন : শাহীনুল ইসলামের নিয়োগ শুরু থেকেই বিতর্কিত ছিল। বিএফআইইউ প্রধান নিয়োগে গঠিত সার্চ কমিটির পরীক্ষায় তিনি শেষের দিকে ছিলেন। শীর্ষে ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক একে এম এহসান। চূড়ান্ত তালিকায়ও শাহীনুলের নাম ছিল না। তবে বিশেষ তদবির এবং প্রভাবশালী মহলের সুপারিশে শেষ পর্যন্ত তাকে নিয়োগ দেয়া হয় বলে অভিযোগ আছে। এ কারণে ব্যাংকের ভেতরে একাংশের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল।
দায়িত্ব গ্রহণের পর কার্যক্রমে ভাটা : দায়িত্ব নেয়ার পর শাহীনুল ইসলাম বিএফআইইউতে সক্রিয় তদন্ত কার্যক্রম নিরুৎসাহিত করেন। কর্মকর্তাদের তিনি নির্দেশ দেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সংশ্লিষ্ট সংস্থা থেকে নির্দেশ না আসা পর্যন্ত স্ব-উদ্যোগে কোনো তদন্ত করা যাবে না।’ এর ফলে অর্থপাচারবিরোধী কার্যক্রমে ভাটা পড়ে। বিশেষ করে ব্যাংক খাতের মাফিয়া আলোচিত এস আলম গ্রুপসহ বেশ কয়েকটি বড় শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যক্রম ব্যাহত হয়। একাধিক চৌকষ কর্মকর্তা হঠাৎ বদলি করে দেন। বিশেষ করে মাত্র সাত বছরে দেশের ব্যাংকিংখাত থেকে ব্যাংক-ডাকাত এস আলম গ্রুপ প্রায় সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা লুট করে। তার বিষয়ে গঠিত তদন্ত টিমের প্রধানকে সরিয়ে দেয় শাহীনুল। একই সাথে একজন চৌকষ পরিচালককেও সরিয়ে দেয়া হয়।
বড় অঙ্কের অর্থ উত্তোলনে সুযোগ করে দেয়া : অভিযোগ রয়েছে, সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহর ফ্রিজ করা ব্যাংক হিসাব থেকে ১৯ কোটি টাকা অবৈধভাবে উত্তোলনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি। দুদক এ বিষয়ে তদন্ত করছে। প্রাথমিকভাবে ১২০ কোটি টাকা ফ্রিজ থাকলেও পরে দেখা যায় হিসাবগুলোতে আসলে মাত্র ১০১ কোটি টাকা রয়েছে। অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে বাকি অর্থ তুলে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভিডিও কেলেঙ্কারি ও চূড়ান্ত পতন : এরই মধ্যে তার আপত্তিকর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভিডিও ফাঁসের পর আর্থিক খাতের ভেতর-বাইরে প্রবল সমালোচনা শুরু হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গভর্নরের কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান। ভিডিও যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগকে নির্দেশ দেয়া হয়। এর সাথে মিলিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে আগের অভিযোগ ও দায়িত্ব পালনে অনিয়ম সামনে চলে আসে।
কর্মকর্তাদের প্রতিক্রিয়া : বাংলাদেশ ব্যাংকের সচেতন ও দেশপ্রেমী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দাবি করেন, একজন নৈতিকভাবে বিতর্কিত ও অযোগ্য ব্যক্তিকে কিভাবে দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান হিসেবে বসানো হলো তা পুনর্বিবেচনা করা জরুরি। তারা বলেন, বিএফআইইউর মতো প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্বে আসতে হলে যোগ্যতা, সততা এবং স্বচ্ছতা থাকা আবশ্যক; কিন্তু শাহীনুল ইসলাম দায়িত্ব নিয়ে তদন্ত কার্যক্রমে ভাটা দেন এবং দুর্নীতিবাজ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় সক্রিয় ছিলেন।
আর্থিক খাতের ভাবমূর্তিতে আঘাত : বিএফআইইউ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ। সংস্থাটি দুর্বল হলে বিদেশী অংশীদার এবং বৈশ্বিক আর্থিক গোয়েন্দা নেটওয়ার্কে দেশের অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শাহীনুল ইসলামের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো কেবল তার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিই নয়; বরং বাংলাদেশের আর্থিক খাতের বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, শাহীনুল ইসলামের নিয়োগ ছিল প্রভাবশালী মহলের তদবিরের ফল। দায়িত্বে এসে তিনি দুর্নীতিবাজ চক্রের স্বার্থ রক্ষা করেছেন। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আপত্তিকর ভিডিও কেলেঙ্কারি, যা তার অবস্থানকে আরো দুর্বল করেছে। তদন্ত কমিটির সুপারিশে সরকারের পক্ষ থেকে নিয়োগ বাতিলের পদক্ষেপ তাই স্বাভাবিক ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। এ ঘটনা ভবিষ্যতের জন্য একটি শিক্ষা যে, আর্থিক খাতের মতো সংবেদনশীল জায়গায় নিয়োগে রাজনৈতিক তদবির নয়; বরং যোগ্যতা ও সততাই হতে হবে প্রধান মানদণ্ড। একই সাথে এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আর্থিক খাতে জবাবদিহি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হলো।



