আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গত রাতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। রাত সাড়ে ৮টা থেকে প্রায় আড়াই ঘণ্টা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় এই বৈঠক চলে। বৈঠক শেষে পরিষদের সিদ্ধান্তের কথা জানান আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। তিনি আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত সম্পর্কিত উপদেষ্টা পরিষদের লিখিত বিবৃতি পড়ে শোনান।
এতে বলা হয়েছে, সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে। সংশোধনী অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থকগোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবে।
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাদি ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরিপত্র পরবর্তী কর্মদিবসে জারি করা হবে। এর পাশাপাশি, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জুলাই ঘোষণাপত্র আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে চূড়ান্ত করে প্রকাশ করার সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়েছে।
যমুনার সামনে অনুষ্ঠিত ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন- গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও তথ্য উপদেষ্টা মো: মাহফুজ আলম।
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ায় বাংলাদেশে আর রাজনীতি করতে পারবে না। এ বিষয়ে আজ রোববার প্রজ্ঞাপন জারি হবে বলে জানা যায়।
এর আগে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ফের উত্তাল হয়ে উঠে দেশ। গত ৭ মে রাত ১০টার পর এই আন্দোলনের সূচনা হয়। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর ডাকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে জড়ো হতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। ধীরে ধীরে আসতে থাকেন এনসিপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী ছাত্রশিবির, গণ অধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের নেতাকর্মীরা। মাঠে নামে শাপলা চত্বর ও পিলখানা হত্যাকাণ্ডের শিকার পরিবারের সদস্যসহ আহত জুলাই যোদ্ধারাও। বৃহস্পতিবার রাতভর বিক্ষোভ চলার পর শুক্রবার বাদ জুমা যমুনার পাশে ফোয়ারার সামনে বড় জমায়েত হয়। ডাক আসে শাহবাগ ব্লকডের। এ দিন রাজধানীর উত্তরাসহ ঢাকার কিছু প্রবেশমুখে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। বিভাগীয় শহর কিংবা জেলা-উপজেলায়ও ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে তারাও সমানতালে নামেন সড়কে। সিদ্ধান্ত না এলে এরই মধ্যে ফের ‘মার্চ টু ঢাকা’র হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। একইসাথে তিন দফা দাবিতে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়।
বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিয়েছে জানিয়ে বিবৃতি দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, ‘রাজনৈতিক সব দলের সাথে এরই মধ্যে যোগাযোগ করেছে সরকার। তাদের সাথে আলোচনা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতা-সমর্থকদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিষয়ে জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদন সরকার বিবেচনায় রাখছে।’ তবে পুরোপুরি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত ময়দান না ছাড়ার ঘোষণা দেয় বিক্ষোভাকারীরা।
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০০৯ সাল থেকে ১৬ বছরের শাসনামলে অনিয়ম-গণহত্যা, গুম-খুন, নির্যাতন, অর্থ বাণিজ্যসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অপরাধ করেছে আওয়ামী লীগ। দলটির সভানেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়েছে এ রিপোর্টে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে তিনটি জাতীয় নির্বাচন জালিয়াতি করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল টিকিয়ে রাখেন শেখ হাসিনা। আর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে এমন কোনো অপরাধ নেই, যা করেননি তিনি। বেপরোয়া অপরাধ ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে দেশের মানুষ। এরপর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান হাসিনা। এ সময়ে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয় তার দল আওয়ামী লীগ। এরপর আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। তবে জাতিসঙ্ঘের রিপোর্টে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ না করার সুপারিশ করা হয়েছে।
এ দিকে যমুনায় যখন উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক চলছিল তখন শাহবাগ থেকে বাংলামোটর মোড় পর্যন্ত রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকে। পুরো এলাকায় জোরদার করা হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও জুলাই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত সব সংগঠন রাস্তায় নামে। তারা ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত তারা ঘরে ফিরবেন না।