মিনায় যাত্রার মাধ্যমে পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু

খালিদ সাইফুল্লাহ
Printed Edition
মিনায় যাত্রার মাধ্যমে পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু
মিনায় যাত্রার মাধ্যমে পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু

মিনায় মুসল্লিদের জড়ো হওয়ার মধ্য দিয়ে পবিত্র হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। হজের অংশ হিসেবে মুসল্লিরা মিনা, আরাফাত ময়দান, মুজদালিফা ও মক্কায় ৮ থেকে ১২ জিলহজ মোট পাঁচদিন অবস্থান করবেন।

হজ পালনের জন্য সৌদি আরবে পৌঁছেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হজযাত্রীরা। গতকাল থেকে সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ হাজীরাও মসজিদুল হারামে পৌঁছাতে শুরু করেন। এরপর তারা তাওয়াফে কুদুম করেছেন। হজের আনুষ্ঠানিকতার সূচনা হিসেবে হজযাত্রীরা আজ ইহরাম বেঁধে মিনায় যাবেন। তাঁবুর শহরে সমবেত হবেন ১৫ লাখেরও বেশি হাজী। এদিন থেকে শুরু হবে ‘ইয়াওমুত তারওইয়াহ’ বা হজের আনুষ্ঠানিকতা।

সৌদি সময়ানুযায়ী আজ ৪ জুন ৮ জিলহজ বুধবার সকাল থেকে হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হচ্ছে। বাইতুল্লাহ থেকে মিনার দূরত্ব প্রায় আট কিলোমিটার। এজন্য হজযাত্রীরা গতকাল মঙ্গলবার রাত থেকেই তাঁবুর শহর মিনায় যাওয়া শুরু করেন। এশার নামাজের পর মক্কার নিজ নিজ আবাসন থেকে ইহরাম বেঁধে মিনার উদ্দেশে রওনা হন হাজীরা। আগামীকাল ৫ জুন পালিত হবে ইয়াওমে আরাফা বা আরাফা দিবস।

মিনা মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে পূর্বে অবস্থিত একটি ছোট উপত্যকা, এটি হজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান। প্রায় ২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই উপত্যকা হজের সময় হাজীদের থাকার জন্য তৈরি করা শ্বেতবর্ণের হাজারো তাঁবুতে পরিপূর্ণ হয়ে থাকে। এই তাঁবুগুলো অগ্নিনির্বাপণযোগ্য এবং হাজীদের নিরাপত্তা ও আরাম নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব সুবিধাসম্পন্ন। সেখানে পুরো সময় ইবাদতে কাটাবেন হাজীরা। হজ পালনকারীদের জন্য ৮ জিলহজ জোহরের নামাজের আগে মিনায় পৌঁছা সুন্নত। মিনায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় ও রাতযাপন সুন্নত। মিনায় অবস্থানে পুরোটা সময় হাজীরা তালবিয়া, জিকির ও কুরআন তিলাওয়াতে মশগুল থাকেন। এখানে অবস্থানের প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। অল্প সময়ও জিকির-আজকার থেকে বিরত থাকা উচিত নয়। তাই জিকির ও ইবাদতে মগ্ন থাকা মিনার অত্যন্ত জরুরি আমল। অনর্থক গল্প-গুজব থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।

মিনায় অবস্থান শেষে আগামীকাল বৃহস্পতিবার (৯ জিলহজ, ৫ জুন) সুবহে সাদিকের সময় আরাফার ময়দানের উদ্দেশে রওনা হবেন হাজীরা। এখানে তারা হজের মূল ফরজ ‘ওকুফে আরাফাত’ বা আরাফায় অবস্থান পালন করবেন।

বিশ্ব মুসলিমের সবচেয়ে বড় এই জনসমাগম চলাকালে তীব্র গরম থাকতে পারে বলে আগেই সতর্ক করেছে সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ। চলমান তাপমাত্রা ৪২ থেকে ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছাতে পারে বলে জানিয়েছে দেশটির আবহাওয়া বিভাগ।

ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে হজ পঞ্চম স্তম্ভ। হিজরি বর্ষপঞ্জির জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ হজ পালনের জন্য নির্ধারিত সময়। ইসলাম ধর্মমতে, শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জীবনে একবার হজ পালন করা ফরজ।

এবার বাংলাদেশ থেকে হজ করতে সৌদি আরবে গিয়েছেন ৮৭ হাজার ১৫৭ জন (ব্যবস্থাপনা সদস্যসহ)। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনার হজযাত্রী পাঁচ হাজার ২০০ জন এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনার হজযাত্রী ৮১ হাজার ৯০০ জন।

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় নিরাপদ ও স্মরণীয় হজযাত্রা : ২০২৫ সালের হজ যাত্রা বাংলাদেশের হাজীদের জন্য একটি বিশেষ ও স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়ে উঠবে। সরকারের পক্ষ থেকে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সার্বিক সেবার উন্নয়নের মাধ্যমে হাজীদের স্বাচ্ছন্দ্য, নিরাপত্তা ও সেবা নিশ্চিত করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ হজ মিশন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একসাথে কাজ করে হাজীদের জন্য সর্বোত্তম পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে নিয়োজিত।

আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার : ২০২৫ সালের হজের জন্য চালু করা হয়েছে হজ অ্যাপস, যেখানে হাজীরা যাত্রার পূর্ব প্রস্তুতি, প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা, সময়সূচি এবং জরুরি যোগাযোগের ব্যবস্থা পাবেন। এই অ্যাপের মাধ্যমে দ্রুত খবর আদান-প্রদান, হজসংক্রান্ত যেকোনো তথ্য সহজে জানা যাবে। পাশাপাশি রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে, যারা ২৪ ঘণ্টা হাজীদের যেকোনো জরুরি সমস্যায় দ্রুত সাড়া দেবে, যেন তারা যাত্রাপথে, মক্কা-মদিনায় বা মিনায় কোনো প্রকার ঝামেলা ছাড়াই হজ পালনে সক্ষম হন।

আর্থিক সুরক্ষা ও যোগাযোগ সুবিধা : হাজীদের নগদ টাকা বহনের ঝুঁকি কমাতে সরকার চালু করেছে হজ প্রিপেইড কার্ড। এই কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন নিরাপদ এবং সুবিধাজনক হবে, যার ফলে টাকা চুরি বা হারানোর আশঙ্কা থাকবে না। এছাড়া, পরিবারের সাথে অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগের জন্য হাজীদের জন্য ফোন রোমিং সুবিধা চালু রয়েছে, যা দূর থেকে হলেও আপনজনদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করবে।

যাতায়াত ও আবাসনের উন্নয়ন : বিমান ভাড়ায় বিশেষ ছাড় দিয়ে হাজীদের যাত্রা ব্যয় কমিয়েছে সরকার। এছাড়া ভবিষ্যতে আরো কমানো হবে বলে আশা করা হচ্ছে। মিনার তাঁবু ও শৌচাগার ব্যবস্থার মান উন্নয়নে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে যাতে হাজীরা সুরক্ষিত ও স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারেন। বিশেষ করে মিনায় প্রতিটি হাজীর জন্য পর্যাপ্ত স্থান নিশ্চিত করা হচ্ছে, যা অতীতের সঙ্কট কাটিয়ে নতুন মানদণ্ড স্থাপন করবে।

স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা : সৌদি আরবের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সাথে সমন্বয় রেখে হাজীদের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। করোনা মহামারীর অভিজ্ঞতা থেকে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানা হচ্ছে, যাতে সবাই নিরাপদে হজ পালন করতে পারে। এছাড়া হাজীদের দ্রুত সাহায্যের জন্য চিকিৎসা কেন্দ্র ও অ্যাম্বুলেন্স সেবা ২৪ ঘণ্টা সচল থাকবে।

প্রশাসনিক ও মনিটরিং : বাংলাদেশ হজ মিশনের মাধ্যমে সৌদি আরবের মক্কা ও মদিনায় নজরদারি রাখা হচ্ছে, যাতে হাজীদের যেকোনো সমস্যা দ্রুত সমাধান করা যায়। মনিটরিং কমিটি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন প্রদান করে থাকেন। এই প্রশাসনিক তৎপরতা হাজীদের জন্য নিরাপত্তা ও সহায়তা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

ধর্ম উপদেষ্টার বক্তব্য : ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, সরকার সর্বাত্মক আন্তরিকতায় কাজ করছে যাতে প্রত্যেক হাজী নিরাপদ ও সহজে হজ পালনের আমল সম্পন্ন করতে পারেন। প্রযুক্তির সমন্বয়ে হজ ব্যবস্থাপনা গতিশীল ও ফলপ্রসূ হচ্ছে। আমরা আশা করি, বাংলাদেশের এই উন্নত সেবা ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানের দৃষ্টান্ত হবে।

২০২৫ সালের হজ ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি, মানবিক সেবা ও প্রশাসনিক দক্ষতার সমন্বয় হাজীদের জন্য নতুন যুগের নিরাপদ, আরামদায়ক ও স্মরণীয় অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করবে। বাংলাদেশের হাজীরা এ বছর অভূতপূর্ব সেবা ও সুরক্ষায় ভাগী হতে চলেছেন, যা তাদের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে।