টরন্টো চলচ্চিত্র উৎসবের ৫০ বছর

দীপা মেহতার চোখে কানাডিয়ান হয়ে ওঠার গল্প

Printed Edition
দীপা মেহতার চোখে কানাডিয়ান হয়ে ওঠার গল্প
দীপা মেহতার চোখে কানাডিয়ান হয়ে ওঠার গল্প

আলমগীর কবির

টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের (টিআইএফএফ) ৫০ বছর পূর্তিতে নিজের পথচলার কথা বলতে গিয়ে ইন্দো-কানাডীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা দীপা মেহতা ফিরে গেলেন সেই প্রথম দিনের স্মৃতিতে, যেদিন তিনি প্রথমবারের মতো নিজেকে সত্যিকারের ‘কানাডীয়’ বলে অনুভব করেছিলেন।

ভারতে জন্ম নেয়া, পরে কানাডায় অভিবাসিত দীপা মেহতা তার নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর মাধ্যমে ভারতীয় সমাজের নানা অন্ধকার দিক সাহসিকতার সাথে তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে তার তিনটি চলচ্চিত্র নিয়ে গঠিত ‘এলিমেন্টস ট্রিলজি’ ‘ফায়ার’, ‘আর্থ’ ‘ওয়াটার’ বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে, আবার একই সাথে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুও হয়েছে।

এছাড়াও, সাহিত্যে নোবেলজয়ী লেখক সালমান রুশদির উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত মধ্যরাত্রির সন্তান চলচ্চিত্রটিও টিআইএফএফে প্রদর্শিত হয়েছে। সর্বশেষ, ২০২৩ সালে তার নির্মিত আমি সিরাত নামের তথ্যচিত্রটিও টিআইএফএফে প্রদর্শিত হয়।

১৯৯১ সালে দীপা মেহতার প্রথম চলচ্চিত্র স্যাম অ্যান্ড মি টিআইএফএফে প্রদর্শিত হয়। যদিও ছবিটি প্রথম আমন্ত্রণ পেয়েছিল আন্তর্জাতিক কান চলচ্চিত্র উৎসব থেকে, কিন্তু টিআইএফএফের প্রদর্শনী ছিল তার কাছে আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, তখনো পর্যন্ত তিনি নিজেকে কানাডার অংশ বলে মনে করেননি।

‘আমি ভারত থেকে অভিবাসন নিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু কখনো মনে হয়নি কানাডার অংশ হয়ে উঠেছি’, স্মৃতিচারণ করলেন মেহতা। সরকারি অনুদান পাইনি, নিজস্ব তহবিল এবং আন্তর্জাতিক উৎস থেকে অর্থ জোগাড় করে ছবিটি বানিয়েছিলাম। কিন্তু টিআইএফএফ যখন আমাকে ‘পার্সপেকটিভস কানাডা’ বিভাগে আমন্ত্রণ জানাল, তখন মনে হলো, হ্যাঁ, আমিও এ দেশেরই একজন। ওই মুহূর্তটাই ছিল প্রথমবার নিজেকে কানাডিয়ান মনে হওয়া।

২০০৫ সালে দীপা মেহতার ছবি ‘ওয়াটার’ ছিল টিআইএফফের উদ্বোধনী চলচ্চিত্র। এটিই ছিল প্রথমবারের মতো হিন্দি ভাষায় নির্মিত কোনো ছবি এই মর্যাদা পাওয়া। ছবিটির বিষয় ছিল ভারতে বিধবাদের প্রতি সমাজের নির্মম আচরণ নিয়ে। বিষয়বস্তুর কারণে ভারতে এই ছবির শুটিংকালে তীব্র প্রতিবাদ হয় এবং ২০০০ সালে বারানসীতে এর শুটিং বন্ধ করে দেয়া হয়।

পাঁচ বছর পর শ্রীলঙ্কায় নতুন করে শুটিং হয়, তবে কানাডীয় অনুদান সংস্থা টেলিফিল্ম এক শর্তে অর্থ সাহায্য দেয়- ছবিটি হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজিতেও নির্মাণ করতে হবে। মেহতা সেই শর্ত মানেন। এর পর যুক্তরাষ্ট্রে ছবিটি মুক্তি পায় ২০০৬ সালে, কানাডায় ২০০৫ সালেই মুক্তি দেয় মংগ্রেল মিডিয়া।

কিন্তু টিআইএফএফের মতো উৎসবে এমন একটি ছবিকে উদ্বোধনী ছবি বানানো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল- ‘এটি কি আদৌ কানাডিয়ান চলচ্চিত্র?’ অনেকেই এমন মন্তব্য করেছিলেন।

এই বিতর্কই শুরু করে বৃহত্তর এক প্রশ্ন-একটি চলচ্চিত্রকে ঠিক কীভাবে ‘কানাডিয়ান’ বলা যায়? এবং এর মাধ্যমেই শুরু হয় আলোচনা ‘আসলে কানাডা কী দিয়ে গঠিত?’ মেহতা বলেন, ‘আজ সবাই মেনে নিচ্ছে কানাডা একটি বহু-সাংস্কৃতিক দেশ। টিআইএফএফেই এই কথোপকথনের সূচনা করেছিল। এ কাজটি খুবই জরুরি ছিল।’

২০১২ সালে টিআইএফএফে দীপা মেহতা নিয়ে আসেন তার আরেকটি বিশেষ চলচ্চিত্র ‘মিডনাইট চিলড্রেন’। এটি নির্মিত হয়েছিল বিখ্যাত লেখক সালমান রুশদির একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে। এই ছবির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয়েছিল টেলিউরাইড উৎসবে, এরপর টিআইএফএফে কানাডীয় প্রদর্শনী হয়।

সালমান রুশদি ছিলেন টিআইএফএফে নিজেও। দীপা বলেন, ‘সালমান আমার খুব কাছের বন্ধু। টিআইএফএফে তার উপস্থিতি ছবিটির জন্য দারুণ ছিল।’

টিআইএফএফের নেতৃত্ব ও রূপান্তরের গল্পটিও দীপা মেহতার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে যখন হেলগা স্টেফেনসন উৎসবের পরিচালক ছিলেন, তখন টিআইএফএফ হয়ে উঠেছিল একই সাথে বিশ্বমুখী এবং টরন্টোকেন্দ্রিক। পরে পিয়ার্স হ্যান্ডলিং আসেন, তার অধীনে টিআইএফএফ আরো বড় হয়, আন্তর্জাতিক প্রভাব বেড়ে যায়।’

একসময় টিআইএফএফে ‘পার্সপেকটিভস কানাডা’ নামে একটি বিভাগ ছিল, যেখানে কানাডার নির্মাতাদের ছবি প্রদর্শিত হতো। কিন্তু পরে পিয়ার্স সিদ্ধান্ত নেন, ‘আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের শুধু নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার দরকার নেই; বরং তাদের আন্তর্জাতিক দৃশ্যপটে তুলে ধরতে হবে।’ দীপার মতে, সেটিই ছিল কানাডিয়ান সিনেমাকে বিশ্বদরবারে পৌঁছে দেয়ার পথ।

বর্তমানে টিআইএফএফের প্রধান নির্বাহী ক্যামেরন বেইলির নেতৃত্বে উৎসবটি আরও বেশি বৈশ্বিক হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন তিনি।

২০১৭ সালে টিআইএফএফ শুরু করে ‘শেয়ার হার জার্নি’ নামের একটি বিশেষ উদ্যোগ, যার লক্ষ্য ছিল নারী নির্মাতাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা ও তাদের ক্ষমতায়ন। দীপা মেহতা এই কর্মসূচির একজন শুভেচ্ছাদূত ছিলেন।

‘আজ টিআইএফএফ শুধু অভিজ্ঞ নির্মাতাদের মঞ্চ নয়’ বলেন তিনি, ‘বরং উৎসবটি এখন তরুণ, নতুন ও নানা পটভূমির নির্মাতাদেরও সমানভাবে জায়গা দিচ্ছে। এটিই আসল শক্তি। বিশেষ করে যখন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন উদ্যোগের বিরুদ্ধে চাপ তৈরি হচ্ছে, টিআইএফএফ তখন এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।’

দীপা মেহতার চলচ্চিত্রজীবন যেমন সাহসিকতার প্রতীক, তেমনি তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও বহু অভিবাসী শিল্পীর কানাডীয় পরিচয় পাওয়া বা না-পাওয়ার মধ্যেকার টানাপড়েনকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

টিআইএফএফ শুধু চলচ্চিত্রের উৎসব নয় এটি হয়ে উঠেছে পরিচয়ের, প্রতিবাদের ও পরিবর্তনের মঞ্চ। দীপা মেহতার যাত্রা সেই পরিবর্তনেরই একটি জীবন্ত দলিল।