নবীজি সা: সব যুগ ও সমাজের জন্য নেতৃত্বের পূর্ণাঙ্গ মডেল

Printed Edition

ডা: মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

নেতৃত্ব মানবসমাজের একটি মৌলিক প্রয়োজন। একজন সৎ, বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নেতা একটি জাতিকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারেন, আবার দুর্নীতিগ্রস্ত ও অন্যায়পরায়ণ নেতা জাতিকে ধ্বংসের অতলে ঠেলে দেয়। মানবসভ্যতার ইতিহাসে বহু নেতা, সম্রাট ও শাসকের আবির্ভাব ঘটেছে। কেউ সামরিক জয়ে, কেউ রাজনীতিতে, কেউবা প্রশাসনিক দক্ষতায় খ্যাতি অর্জন করেছেন; কিন্তু তাদের নেতৃত্ব ছিল সময়সাপেক্ষ, আঞ্চলিক ও সীমাবদ্ধ। কেবল একজন নেতার নেতৃত্ব সর্বজনীন, কালজয়ী ও সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য- তিনি হলেন আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা:। তাঁর নেতৃত্ব আধ্যাত্মিক উন্নয়ন, সামাজিক সংস্কার, ন্যায়বিচার, মানবিকতা ও রাষ্ট্র পরিচালনার এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব : নবীজি সা:-এর নেতৃত্বের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব। তিনি মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদতে আহ্বান করেছেন, শিরক ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত করেছেন। কুরআনে আল্লাহ বলেন- ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।’ (সূরা আল-আহজাব-২১) নবীজি সা: মানুষকে আত্মশুদ্ধি, তাকওয়া ও আল্লাহভীতির শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি হৃদয়ের বিপ্লব ঘটিয়ে নৈতিক ভিত্তির ওপর একটি সমাজ গড়ে তুলেছেন।

ন্যায়বিচার ও সমতা : নবীজি সা: ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে ছিলেন আপসহীন। তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তী জাতি ধ্বংস হয়েছিল এ জন্য যে, তারা ক্ষমতাশালী অপরাধীকে শাস্তি দিত না, আর দুর্বলকে দিত।’ (বুখারি-৬৭৮৮)

মদিনার সমাজে তিনি আরব-অনারব, কালো-সাদা, ধনী-গরিব সবার জন্য সমান বিচার নিশ্চিত করেছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘সব মানুষ আদমের সন্তান, আর আদম সৃষ্টি হয়েছেন মাটি থেকে।’ (আবু দাউদ-৫১১৬)

পরামর্শমূলক নেতৃত্ব : নবীজি সা: ছিলেন শূরার (পরামর্শ) অনুসারী। তিনি যুদ্ধ, প্রশাসন ও সমাজ সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো সাহাবিদের সাথে আলোচনা করতেন। উহুদ যুদ্ধের আগে যুবকদের পরামর্শ মেনে তিনি মদিনার বাইরে যুদ্ধক্ষেত্র বেছে নিয়েছিলেন। কুরআনে আল্লাহ বলেন- ‘আর তারা তাদের কাজ পরিচালনা করে পরস্পরের পরামর্শের মাধ্যমে।’ (সূরা আশ-শূরা-৩৮) এটি প্রমাণ করে, নবীজি সা: গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নেতৃত্বের প্রতীক ছিলেন।

মানবিকতা ও দয়ার নেতৃত্ব : নবীজি সা: ছিলেন দয়া ও করুণার প্রতিমূর্তি। আল্লাহ তাঁকে সম্বোধন করে বলেছেন- ‘আমি তো আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি।’ (সূরা আম্বিয়া-২১: ১০৭) তিনি অনাথ, বিধবা, দরিদ্র ও দাসদের অধিকার রক্ষায় সদা সচেষ্ট ছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘যে অনাথের দায়িত্ব নেবে, আমি ও সে জান্নাতে এভাবে একসাথে থাকব।’ (বুখারি-৫৩০৪) তিনি শিশুদের সাথে খেলতেন, নারীদের সম্মান দিতেন, শত্রুকেও ক্ষমা করতেন। তায়েফবাসী তাঁকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করলেও তিনি তাদের জন্য অভিশাপ নয়; বরং হিদায়াতের দোয়া করেছিলেন।

দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক : মদিনায় নবীজি সা: ইসলামের প্রথম রাষ্ট্র গঠন করেন। ‘মদিনা সনদ’ মানব ইতিহাসের প্রথম লিখিত সংবিধান হিসেবে স্বীকৃত। এখানে ধর্মীয় স্বাধীনতা, বিচারব্যবস্থা, পারস্পরিক সহযোগিতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিমালা নির্ধারিত হয়েছিল। মুসলিম ও অমুসলিম সবাই সেই সনদের অধীনে সমান অধিকার ভোগ করত। নবীজি সা: প্রশাসন, অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সুসংগঠিত করেন। তিনি কর ব্যবস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি স্থিতিশীল করেন, যুদ্ধবন্দীদের সাথে মানবিক আচরণ করেন, দাসপ্রথা বিলোপের উদ্যোগ নেন। নবীজি সা:-এর নেতৃত্ব থেকে আধুনিক শিক্ষা। আর আজকের পৃথিবী রাজনৈতিক সঙ্কট, দুর্নীতি, বৈষম্য ও যুদ্ধবিগ্রহে জর্জরিত। এই অশান্ত পৃথিবীতে নবীজি সা:-এর নেতৃত্ব থেকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেতে পারি।

আধুনিক পৃথিবীর জন্য শিক্ষা : ১. নৈতিকতা ও জবাবদিহিতা : নেতাকে হতে হবে সৎ, নৈতিক ও দায়িত্বশীল। ক্ষমতা কোনো ভোগের বস্তু নয়; বরং জনগণের সেবার মাধ্যম। ২. পরামর্শ ও অংশগ্রহণ : জনগণের মতামত গ্রহণ করে শাসন পরিচালনা করতে হবে। একক সিদ্ধান্তে নয়; বরং দলীয় পরামর্শে উত্তম পথ বের হয়। ৩. ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার : ধর্ম, বর্ণ বা শ্রেণী নির্বিশেষে সবার জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ৪. মানবিকতা ও দয়া : শাসন শুধু আইন দিয়ে নয়, দয়া ও সহমর্মিতার মাধ্যমেও পরিচালিত হতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, নবীজি হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নেতা। তাঁর নেতৃত্ব কেবল মুসলমানদের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য পথপ্রদর্শক। তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক, সমাজ সংস্কারক, রাষ্ট্রনায়ক ও মানবতার জন্য অফুরন্ত রহমত। বর্তমান দুনিয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা দূর করতে হলে নবীজি সা:-এর নেতৃত্ব থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা অপরিহার্য। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর আদর্শে চলার তাওফিক দান করুন।