ক্যালিগ্রাফির কিংবদন্তি আবদুর রহীম

Printed Edition
ক্যালিগ্রাফির কিংবদন্তি আবদুর রহীম
ক্যালিগ্রাফির কিংবদন্তি আবদুর রহীম

চল্লিশ বছর ধরে বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফির বিকাশে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন আবদুর রহীম। ক্যালিগ্রাফি ফাউন্ডেশন, ক্যালিগ্রাফি ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান তিনি। বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে তার ক্যালিগ্রাফি গেছে। দেশী-বিদেশী মিলিয়ে সাড়ে চার হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী তার কাছে ক্যালিগ্রাফি শিখেছে। ক্যালিগ্রাফির ওপর পিএইচডি তার অনন্য অর্জন। কিংবদন্তি এই ক্যালিগ্রাফারের নাম শাহ মোহাম্মদ আবদুর রহীম। লিখেছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান-

খুলনার ডুমুরিয়া থানার শাহপুরে তার জন্ম। সেখানেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। তবে আবদুর রহীম ১৯৯০ সাল থেকে পরিবার নিয়ে রাজধানীর মগবাজারে বসবাস করেন। পরিবারে স্ত্রী ছাড়া আছে দুই মেয়ে, এক ছেলে। তিনি ফুলটাইম ক্যালিগ্রাফার, শিল্পী, মুদ্রা, শিলালিপি ও প্রতœতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে বিশেষায়িত কোর্সে লেকচারার হিসেবে কাজ করছেন এখন। রহীম ঢাকা আলিয়া মাদরাসা থেকে কামিল (মাস্টার্স) পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ইসলামিক স্টাডিজ, আরবি চারুকলা অনুষদের শিল্পকলার ইতিহাসের ছাত্রদের ক্যালিগ্রাফির ব্যবহারিক ক্লাস নিয়েছেন অনেক দিন।

মাদরাসায় পড়াশোনা করার কারণে ছোটবেলা থেকে আরবি লেখার প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় প্রথম কলম-কালিতে ক্যালিগ্রাফি শুরু তার। তখন খুলনায় ছোটদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পাওয়া ছিল তার জন্য নিয়মিত ঘটনা। এভাবে চলতে চলতে একপর্যায়ে ঢাকায় পাড়ি জমান। তখন ঢাকায় সৌদি দূতাবাসে কর্মরত উস্তাদ শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী ছিলেন। বারীর কাছে ‘আল-আকলাম আস-সিত্তাহ’ বা আরবি ক্যালিগ্রাফার হতে যে শর্ত রয়েছে, ছয়টি ভিন্ন ক্যালিগ্রাফিতে পারদর্শী হতে হয়, সেটিতে বাংলাদেশে প্রথম তিনি সনদ গ্রহণ করেন। এরপর কেটে গেছে ক্যালিগ্রাফির সাথে তার কয়েক যুগ। আবদুর রহীম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগ থেকে ক্যালিগ্রাফির ওপর এমফিল ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। তিনি জানান, ক্ল্যাসিক্যাল ক্যালিগ্রাফির ব্যবহারিক দিক নিয়ে তার আগে বাংলাদেশে আর কেউ পিএইচডি করেননি।

উস্তাদ ছাড়া গতি নেই : আরবি ক্যালিগ্রাফি বা যেকোনো ভাষার ক্যালিগ্রাফি নিজে নিজে শেখা সম্ভব না, এটি সম্পূর্ণ শিক্ষকনির্ভর শিক্ষা। তাই ক্যালিগ্রাফি শেখার জন্য একজন শিক্ষক বা উস্তাদ থাকা চাই। উস্তাদ শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী ছাড়াও সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরাক, সিরিয়া, তুরস্ক, আলজেরিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ৫০ জন প্রবীণ ক্যালিগ্রাফার আবদুর রহীমের উস্তাদ। একদম সরাসরি তাদের কাছে ক্যালিগ্রাফির নানা দিক শিখেছেন তিনি। রহীম মনে করেন, শিক্ষকমুখী না হয়ে ক্যালিগ্রাফির মতো এত বড় ব্যাপ্তির শিক্ষাকে আয়ত্ত করে ব্যবহারযোগ্য পর্যায়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

আয়ের গল্প : তখন তার বয়স মাত্র পাঁচ। ১৯৮০ সাল। পড়েন খুলনা আলিয়া মাদরাসায়। ওই সময়ে একটা অনুষ্ঠানের জন্য ‘বিসমিল্লাহ’ আর ‘কালিমা তয়্যিবাহ’ লিখে হাদিয়া পেয়েছিলেন এক হাজার টাকা। যা তাকে ভীষণ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল তখন। শিশুকালেই তার নানা অর্জন ভবিষ্যতে বড় কিছু হওয়ার আভাস দিয়েছিল। বড় হওয়ার পর তার একটি ক্যালিগ্রাফি সর্বোচ্চ এক লাখ টাকায় বিক্রি হয়, যেটি বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী নিয়েছিল। বর্তমানে মাসে ক্যালিগ্রাফি থেকে তার আয় ৫০ হাজার টাকার মতো। অবশ্য কাজ কমবেশি হওয়ার উপর আয় নির্ভর করে।

দেশ-বিদেশে রহীমের ক্যালিগ্রাফি : আবদুর রহীমের কাজ সবচেয়ে বেশি যেসব দেশে গেছে সেগুলো হলো- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান, আলজেরিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ভারত। এ ছাড়া আরব বিশ্বের ২২টি দেশ ও ইউরোপের বিভিন্ন জাদুঘর, গবেষণাকেন্দ্র ও গ্যালারি তার ক্যালিগ্রাফি নিয়েছে। ‘ক্যালিগ্রাফি শপ’ নামে একটি কমার্শিয়াল ফেসবুক প্ল্যাটফর্ম করেছেন রহীম, যেখানে তার ফেসবুক প্রোফাইলে নক দিয়ে কাজের অর্ডার করার সুযোগ রয়েছে।

শেখাতেই তার আনন্দ : রহীম যখন বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি শুরু করেন, তখন ক্যালিগ্রাফি শেখার কোনো ভিত্তি ছিল না। এ জন্য তিনি সাথে আরো কয়েকজনকে নিয়ে ক্যালিগ্রাফি ফাউন্ডেশন এবং বিশেষায়িত ক্যালিগ্রাফির শিক্ষাদানের জন্য বাংলাদেশ ক্যালিগ্রাফি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ ক্যালিগ্রাফি ফাউন্ডেশন (২০০৪ সাল) ও বাংলাদেশ ক্যালিগ্রাফি ইনস্টিটিউট (২০২০ সাল) উভয়ের তিনি প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। ব্যক্তিগত ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চার হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থীকে হাতে-কলমে ক্যালিগ্রাফি শিখিয়েছেন তিনি।

ক্যালিগ্রাফির সাথে সম্পৃক্ত প্রবীণ, তরুণ বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ক্যালিগ্রাফিকে বাংলাদেশে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য সক্রিয়ভাবে আবদুর রহীমের মতো এত দীর্ঘ সময় আর কেউ কাজ করেনি। আরবি ক্যালিগ্রাফিবোদ্ধা মহলে আবদুর রহীম অত্যন্ত পরিচিত এক মুখ। ক্যালিগ্রাফির প্রচারে যার অবদানের কথা নিন্দুকেরাও স্বীকার করেন একবাক্যে।

বই লিখেছেন : ২০০২ সালে তার প্রথম ক্যালিগ্রাফির বই প্রকাশিত হয়, ‘ইসলামী ক্যালিগ্রাফি’ যা মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলা ভাষায় বাংলাদেশে প্রথম ক্যালিগ্রাফির বই। এরপর ২০০৬ সালে ‘নাসখি লিপিকলা’ বই প্রকাশ করেন, যা রকমারি থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব। ক্যালিগ্রাফি নিয়ে কম জানাশোনার কারণে বই প্রকাশকরা এই বিষয়ে তেমন আগ্রহ দেখাতেন না। এই সমস্যার সমাধান হয় যখন তিনি বাংলাদেশ ক্যালিগ্রাফি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে সেখান থেকেই বই প্রকাশ শুরু করেন।

৪০০টি ভাষায় ক্যালিগ্রাফি : ৪০০টি ভাষার একটি করে হলেও আলাদাভাবে ক্যালিগ্রাফি করেছেন রহীম, যার ভেতর তার আরবি, বাংলা ও ইংরেজি ক্যালিগ্রাফি সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে হাতেগোনা কয়েকজন মুদ্রা ও শিলালিপির আরবি ও ফার্সি লেখা পাঠোদ্ধার করে থাকেন, রহীম তাদের মধ্যে অন্যতম। এই কঠিন কাজটিতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্যালিগ্রাফির জ্ঞান ও গবেষণালব্ধ তথ্যের দরকার হয়।

বদলে যাওয়া জীবনের গল্প: ২০০২ সালে শ্বেতবর্ণের ও পরনে স্লিভলেস গেঞ্জি ও জিন্সের প্যান্ট পরিধান করা এক মহিলা তার একটি প্রদর্শনী থেকে একটি ক্যালিগ্রাফি কিনে নেন। ক্যালিগ্রাফিটি বাসায় লাগানোর সময় ওই মহিলার স্বামী বাসায় অন্য ফিগারের ছবি নামিয়ে ফেলতে বলেন, কারণ ওগুলো থাকলে আরবি ক্যালিগ্রাফির মান ক্ষুণœ হয়। ক্যালিগ্রাফিটি দেখতে দেখতে কেমন জানি বদলে যেতে থাকেন ওই মহিলা। পোশাক-আশাকেও পরিবর্তন হয় তার। ২০০৬ সালে আরেক প্রদর্শনীতে ওই মহিলার সাথে রহীমের দেখা হয়। তখন ওই মহিলা জানান, ‘ক্যালিগ্রাফিটি যত দেখি তত ধীরে ধীরে আল্লাহভীতি বাড়তে থাকে, একসময় সম্পূর্ণ আল্লাহমুখী হয়ে যাই।’ রহীম বলেন, সেদিনই আমার জীবনের সবচেয়ে খুশির দিন ছিল, এটি আমার সবচেয়ে বড় অর্জন, দুনিয়াবি স্বার্থের ঊর্ধ্বে ক্যালিগ্রাফির এই আত্মিক কারিশমা অবশ্যই বিস্ময়কর।

ঘরভর্তি পুরস্কার : আবদুর রহীমের সারা জীবনের সাধনা ক্যালিগ্রাফি, বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি শিল্পের প্রসার ঘটানো। এসব কাজ করতে গিয়ে অসংখ্য পুরস্কার বা স্বীকৃতি তার ভাগ্যে জুটেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ২০০৪ সালে জাতীয় শিল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান, ২০০৬ সালের মাইজভাণ্ডার আয়োজিত ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান, ২০০৯ সালে ইরানের তেহরানে ‘বাসমালাহ’ প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান ও জুরিবোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হয়ে সরকারি সফরে ইরানে ভ্রমণ, ২০১০ সালে আলজিয়ার্সে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বিশ্বের সেরা পাঁচজন ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিংয়ের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন, মোয়াল্লা ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান, ভারতে মোট তিনবার ফেস্টিভ্যাল ও ওয়ার্কশপ এবং দেশ-বিদেশে ৫০টির অধিক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের সনদ ইত্যাদি। ২০১৩ সালে তুরস্কের ইরসিকা থেকে কুফি ক্যালিগ্রাফির ওপর বিশেষ পুরস্কার অর্জন করেন রহীম। যেটিকে তিনি তার ক্যালিগ্রাফির শিক্ষক হিসেবে অনন্য স্বীকৃতি বলে মনে করেন।

ক্যালেন্ডারে ক্যালিগ্রাফি : ক্যালেন্ডারে ক্যালিগ্রাফি করা শুরু হয় ১৯৯৫ সালে ইসলামী ব্যাংকের ক্যালেন্ডার দিয়ে। এ পর্যন্ত ২০টির মতো সরকারি, সামরিক ও প্রাইভেট কোম্পানির বার্ষিক ও রমজানের ক্যালেন্ডারে তার ক্যালিগ্রাফি ছাপা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ইসলামী ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ইউনাইটেড ব্যাংক, আমান গ্রুপ, সাত্তার গ্রুপ, মোহাম্মদি স্টিল ইত্যাদি।