মঈন উদ্দিন খান নিউ ইয়র্ক থেকে
ইতিহাস গড়ে বিশ্বের বাণিজ্যিক রাজধানী নিউ ইয়র্ক সিটির প্রথম মুসলিম মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন জোহরান মামদানি। ৩৪ বছর বয়সী এই ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট ভোটারদের উজ্জীবিত করে এবং দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে এই ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করেছেন তিনি। মামদানি হবেন প্রথম দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত এবং আফ্রিকায় জন্মগ্রহণকারী নিউ ইয়র্কের প্রথম মেয়র। শুধু তাই নয় এক শতাব্দীর মধ্যে মামদানি হবেন সবচেয়ে কনিষ্ঠ মেয়র।
নির্বাচনে প্রাথমিক ফলাফলে (৯৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ) নিউ ইয়র্ক সিটির পাঁচ বরোতে জোহরান মামদানি পেয়েছেন ১০ লাখ ৩৬ হাজার ৫১ ভোট, যা মোট ভোটের ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্র্রু ক্যুমো পেয়েছেন আট লাখ ৫৪ হাজার ৯৯৫ ভোট। রিপাবলিকান কার্টিস স্লিওয়া পেয়েছেন এক লাখ ৪৬ হাজার ১৩৭ ভোট।
নিউ ইয়র্ক সিটির ডাকনাম ‘বিগ অ্যাপল’। মেয়র নির্বাচনে ঐতিহাসিক জয়ের পর সেই ‘বিগ অ্যাপল’ এখন মামদানির। আগামী ১ জানুয়ারি তিনি নিউ ইয়র্ক সিটির ১১১তম মেয়রের দায়িত্ব নেবেন।
রিপাবলিকানদের পরাজয়ের দিন : এদিন কেবল নিউ ইয়র্কেই নয়, আরো দু’টি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে হেরে গেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থীরা। নিউ জার্সি ও ভার্জিনিয়া রাজ্যের গভর্নর পদে জয়ী হয়েছেন ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বড় কোনো নির্বাচনে জয় ছিনিয়ে নিলেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা।
নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম ভাষণে মামদানি বলেছেন, নিউ ইয়র্কের মানুষ পরিবর্তনের পক্ষে রায় দিয়েছে, সামর্থ্যরে মধ্যে থাকা একটি শহরের পক্ষে রায় দিয়েছে। সমর্থকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘বন্ধুরা, আমরা একটি রাজনৈতিক রাজবংশকে উৎখাত করেছি। নিউ ইয়র্ক শহরের নতুন জন্ম হয়েছে।’
৪ নভেম্বর মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জোহরান মামদানি সহজ ব্যবধানে পরাজিত করেন সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু ক্যুমো ও রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়াকে। ক্যুমো ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারিতে পরাজয়ের পর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়েন। আর বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস গত সেপ্টেম্বরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়িয়ে ক্যুমোকে সমর্থন জানান। নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী কার্টিস স্লিওয়া এরই মধ্যে মামদানিকে শুভেচ্ছাও জানিয়েছেন। মঙ্গলবার রাতে সমর্থকদের একটি দলকে স্লিওয়া বলেন, ‘আমাদের একজন মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। অবশ্যই আমি তাকে শুভকামনা জানাই, কারণ তিনি যদি ভালো করেন, তাহলে আমরাও ভালো করব।’
প্রায় এক বছর আগে রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করা জোহরান মামদানির জন্য এটি এক অবিস্মরণীয় উত্থান। স্টেট অ্যাসেম্বলিম্যান থেকে আমেরিকার সবচেয়ে বড় শহরের নেতৃত্বে পৌঁছে গেলেন তিনি। মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে তিনি নিউ ইয়র্কের প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরসূরিকে দুই-দুইবার হারিয়ে দেন।
এখন জাতীয়ভাবে পরিচিত এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে জোহরান মামদানিকে সামলাতে হবে বিশাল প্রশাসনিক কাঠামো, বাস্তবায়ন করতে হবে তার উচ্চাভিলাষী নীতিমালা এবং প্রগতিশীল রাজনীতির জাতীয় ধারায় প্রভাব বিস্তার করতে হবে। তার ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- ভাড়া নিয়ন্ত্রিত ফ্ল্যাটে ভাড়া বৃদ্ধিতে স্থগিতাদেশ, সার্বজনীন শিশুসেবা, বিনামূল্যে বাস চলাচল ব্যবস্থা ও সিটি করপোরেশন পরিচালিত মুদিদোকান চালু করা।
মামদানির এই জয়ের প্রভাব শুধু নিউ ইয়র্কেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; তা সারা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে আলোচনার জন্ম দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এনবিসি নিউজের এক্সিট পোল অনুযায়ী, মামদানি নিউ ইয়র্কের প্রায় সব জাতিগত গোষ্ঠীর ভোট পেয়েছেন, শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, লাতিনো, এশীয় ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর ভোটারদের বড় অংশই তাকে বেছে নিয়েছেন। ৪৫ বছরের নিচের ভোটারদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ছিল বিপুল; ক্যুমোর চেয়ে ৪৩ পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন তিনি। অন্যদিকে ৪৫ বছরের ঊর্ধ্বে ভোটারদের মধ্যে ক্যুমো ১০ পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন।
মামদানির ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থান নির্বাচনজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। তার মুসলিম পরিচয় ও ইসরাইলবিরোধী অবস্থান নিয়ে বিরূপ প্রচারণা চললেও শেষ পর্যন্ত ভোটাররা তাকেই সমর্থন দেন। এক্সিট পোল অনুযায়ী, ইহুদি ভোটারদের মধ্যে ক্যুমো এগিয়ে ছিলেন ৬০ শতাংশ ভোটে, যেখানে মামদানি পান ৩১ শতাংশ ভোট।
নির্বাচনের শেষ সপ্তাহগুলোতে মামদানি ও ক্যুমোর মধ্যে তীব্র বাকযুদ্ধ হয়। ক্যুমো তাকে ‘নিউ ইয়র্কে বিভাজন সৃষ্টিকারী’ বলে আখ্যা দেন। অন্যদিকে মামদানি ক্যুমোকে ট্রাম্পের ‘কাঠপুতলি’ বলে সমালোচনা করেন। নির্বাচনের আগের রাতেই ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্যুমোকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, স্লিওয়াকে ভোট দেয়া মানে মামদানিকে ভোট দেয়া।
নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে ৪ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আনুমানিক ১৭ লাখ মানুষ ভোট দিয়েছেন বলে জানিয়েছে শহরের নির্বাচন বোর্ড। গত ৩০ বছরের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতি।
১৯৯৩ সালের নির্বাচনে প্রায় ১৯ লাখ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। সেই নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী রুডি জুলিয়ানি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী ডেভিড ডিনকিনসকে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এবারের নির্বাচনে প্রায় সাত লাখ ৩৫ হাজার ৩১৭ জন আগাম ভোট দিয়েছেন, যা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো নির্বাচনে নিউ ইয়র্ক শহরে এটিই সর্বোচ্চ আগাম ভোট পড়ার ঘটনা। নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শুরু হয় সকাল ৬টায়। শেষ হয় রাত ৯টায়। এর পরপরই শুরু হয় ভোট গণনা। কুইন্সের অ্যাস্টোরিয়া এলাকায় একটি কেন্দ্রে ভোট দেন মামদানি।
প্রবাসী বাংলাদেশীদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস : জোহরান মামদানির বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর প্রবাসী বাংলাদেশীরা বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠেন। রাত ১০টার পর সিটির ব্যস্ততম জ্যাকসন হাইটস, জ্যামাইকা, ব্রঙ্কস ও ব্রুকলিনে আনন্দ সমাবেশ করেছেন তারা। রাতেই মামদানির প্রধান ক্যাম্পেইন অফিস ম্যানহাটনে ছুটে গেছেন বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী। নিউ ইয়র্ক সিটি নির্বাচনে অধিকাংশ বাংলাদেশী শুরু থেকে জোহরান মামদানির পক্ষে ছিলেন। গত ২৪ জুন মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত প্রাইমারিতে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী আমেরিকান তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলেও একাধিক সূত্র বলছে- এবার নির্বাচনে বাংলাদেশীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। এমনকি বহু বাংলাদেশী আগাম ভোট দিয়েছেন। নির্বাচনে সিটির বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে বাংলাদেশীদের অংশগ্রহণ ছিল লক্ষণীয়। তাদের প্রচারণার কেন্দ্রে ছিলেন জোহরান মামদানি। বাংলাদেশী তরুণ প্রজন্ম বেছে নিয়েছেন মামদানিকে।
কেন মামদানিকে ভোট দিয়েছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রবাসী বাংলাদেশী মুহাম্মদ সাদ্দাম হোসাইন বলেন, ইমিগ্র্যান্ট ইস্যুতে মামদানি সরাসরি অবস্থান নিয়েছেন। তিনি রেন্ট কন্ট্রোল, সাশ্রয়ী বাসস্থান, পাবলিক ট্রানজিট ও স্বাস্থ্যসেবার মতো ইস্যুতে তার স্পষ্ট অবস্থান কমিউনিটির মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর হৃদয় ছুঁয়েছে। মুসলিম পরিচয়ের সাহসী উপস্থাপন অনেকের নজর কেড়েছে।
নিউ জার্সির ডেমোক্র্যাটপ্রার্থী মিকি শেরিল গভর্নর নির্বাচিত
আবু সাবেত নিউ ইয়র্ক থেকে জানান, নিউ জার্সির গভর্নর নির্বাচনে প্রতিনিধি মিকি শেরিল (ডিএনজে) রিপাবলিকান প্রার্থী ও সাবেক রাজ্য পরিষদ সদস্য জ্যাক সিয়াতারেলিকে পরাজিত করেছেন।
শেরিল উত্তর নিউ জার্সির একটি জেলা থেকে চতুর্থ মেয়াদে কংগ্রেস সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, সিয়াতারেলি ২০২১ সালে তৎকালীন গভর্নর ফিল মারফির (ডি) কাছে অল্প ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে নির্বাচনটি ক্রমেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে ওঠে। ডেমোক্র্যাটদের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল ১৯৬১ সালের পর প্রথমবারের মতো টানা তিনবার একই দলের প্রার্থীকে গভর্নর হিসেবে নির্বাচিত করা। এ ছাড়া রাজ্যে বসবাস ব্যয়ের সঙ্কটে ক্ষুব্ধ ভোটারদের মন জয় করাও ছিল কঠিন। কারণ গভর্নর পদ ও রাজ্য আইনসভা উভয়ই ডেমোক্র্যাটদের নিয়ন্ত্রণে।
ভার্জিনিয়ায় ডেমোক্র্যাটপ্রার্থী গভর্নর নির্বাচিত : সাবেক প্রতিনিধি অ্যাবিগেইল স্প্যানবার্গার (ডি-ভা.) মঙ্গলবার ভার্জিনিয়ার গভর্নর নির্বাচনে লেফটেন্যান্ট গভর্নর উইনসোম আর্ল-সিয়ার্সকে (আর) পরাজিত করেছেন বলে সিদ্ধান্ত ডেস্ক এইচকিউ জানিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তিনি ভার্জিনিয়ার ইতিহাসে প্রথম নারী গভর্নর হিসেবে নির্বাচিত হলেন।
প্রচুর আলোচিত এই ‘বেলওয়েদার’ অঙ্গরাজ্যে তার এই জয়কে ডেমোক্র্যাট দলের মধ্যপন্থী অংশ বিশেষভাবে তুলে ধরবে, কারণ দলটি আগামী বছরের মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে নিজেদের পরিচয় ও নীতি পুনঃসংজ্ঞায়ন নিয়ে লড়ছে।



