মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড পড়ে পথচারীর মৃত্যু

Printed Edition
মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড পড়ে নিহত আবুল কালাম; ইনসেটে স্ত্রী ও দুই সন্তানের সাথে তার এই ছবি এখন শুধুই স্মৃতি : নয়া দিগন্ত
মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড পড়ে নিহত আবুল কালাম; ইনসেটে স্ত্রী ও দুই সন্তানের সাথে তার এই ছবি এখন শুধুই স্মৃতি : নয়া দিগন্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক

  • তদন্ত কমিটি গঠন ও ক্ষতিপূরণের আশ্বাস
  • বিয়ারিং প্যাডের ওজন ১০০ কেজির বেশি
  • হঠাৎ মেট্রোরেল বন্ধে জনভোগান্তি ও আতঙ্ক
  • মেরামত শেষে মেট্রোরেল সাময়িক চালু

ট্র্যাভেল এজেন্সির কাজে ঢাকায় এসেছিলেন দুই সন্তানের জনক আবুল কালাম (৩৫)। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রো স্টেশন সংলগ্ন ৪৩৩ নম্বর পিলারের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এ সময় উপর থেকে মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড আবুল কালামের মাথার ওপর আঁছড়ে পড়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। পথচারীদের রাস্তা ভিজে যায় রক্তে। প্রায় ১০০ কেজি ওজনের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার সময় বিকট শব্দে আশপাশ কেঁপে উঠে। আতঙ্কে সাধারণ মানুষ দিগি¦দিক ছোটাছুটি শুরু করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এই দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠে। এর পর থেকে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিকেলের দিকে আগারগাঁও থেকে উত্তরা পর্যন্ত রেল চলাচল শুরু হয়। এ ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেট্রোরেলে এই জায়গাতেই একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে। এ কারণে ওই সময় আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১১ ঘণ্টা বন্ধ থাকে ট্রেন চলাচল।

বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ, বিপুল অর্থ ব্যয় করে জাপানের প্রযুক্তিবিদরা বিয়ারিং প্যাড স্থাপন করেন। গুরুতর নিরাপত্তাহীনতার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করে তারা বলেন, নকশায় ভুলের কারণেই দ্বিতীয়বার বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে পথচারীর নির্মম মৃত্যুর ঘটনা ঘটলো।

গতকাল তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বলেন, ফার্মগেট মেট্রো স্টেশনের নিচে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের সামনের ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন নিহত যুবক। এমন সময় ওপর থেকে বিয়ারিং প্যাড তার ওপরে পড়লে ঘটনাস্থলেই লোকটির মৃত্যু হয়। সাথে পাওয়া পাসপোর্ট থেকে তার নাম আবুল কালাম (৩৫) বলে জানা যায়। শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার বাসিন্দা তিনি। পাসপোর্টে মালয়েশিয়ার ভিসা লাগানো ছিল। পাসপোর্টের ছবির সাথে মিলিয়ে তাকে শনাক্ত করা হয়। তিনি বলেন, নিহত আবুল কালামের লাশ নেয়া হয় সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে।

হাসপাতাল মর্গে আসা কালামের স্বজন আরিফ হোসেন বলেন, আবুল কালাম ট্র্যাভেল এজেন্সিতে চাকরি করতেন। পরিবার নিয়ে নারায়ণগঞ্জের পাঠানটুলি এলাকায় থাকতেন। গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায়। আবুল কালামের মা-বাবা নেই। স্ত্রী আর দুটি সন্তান আছে। ঢাকায় ট্র্যাভেল এজেন্সির কাজে এসেছিলেন তিনি।

আরিফ আরো বলেন, দুপুরে আবুল কালামের নম্বর থেকে অপরিচিত একজন ফোন দিয়ে গুরুতর দুর্ঘটনা হয়েছে বলে জানায়। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আসার জন্য বলে। পরে হাসপাতালে এসে তিনি মৃত্যুর খবর পান।

এ দিকে মেট্রোরেলের পিলারের উপর থেকে বিয়ারিং প্যাড পড়ে পথচারীর মৃত্যু ঘটনায় দীর্ঘ সময় মেট্রো চলাচল বন্ধ ছিল। বিকেল ৩টায় উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলাচল শুরু করে। সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে মতিঝিল থেকে শাহবাগ পর্যন্ত মেট্রো রেল চলাচল শুরু হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিয়ারিং প্যাড পড়ে একজন মারা যাওয়ার পাশাপাশি ফুটপাথে একটি চায়ের দোকানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আতিকুর রহমান নামের এক ব্যক্তি বলেন, আমরা কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে ছিলাম। হঠাৎ একটা বিকট শব্দ হয়; ওই শব্দে পুরো বিল্ডিং কেঁপে উঠে। আমরা মনে করেছিলাম কোনো গাড়ির চাকা ফেটেছে হয়তো। পরে দেখি, একটা লোক রাস্তায় পড়ে আছে। কালো একটা ভারী বস্তু তার মাথায় পড়েছে। মাথার একপাশ থেঁতলে গিয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় সে।

জানা গেছে, কম্পন প্রতিরোধের জন্য সেতু বা উড়াল সেতুতে ইলাস্টোমোরিক বিয়ারিং প্যাড বসানো থাকে। এ প্যাড নিওপ্রেন বা প্রাকৃতিক রাবার দিয়ে তৈরি, যা পিলার ও ভায়াডাক্টের সংযোগস্থলে বসানো হয়। কোনোটির ভেতরে কয়েক পরতে থাকে স্টিলের কাঠামো, আর উপরে থাকে রাবার। এগুলো ওজনে অনেক ভারী হয়।

এই প্যাডের ওজন ১০০ কেজির বেশি: মেট্রোরেল লাইন থেকে পড়া বিয়ারিং প্যাডটির ওজন ১০০ কেজির বেশি। সেটি আলমত হিসেবে নিয়ে গেছে তেজগাঁও থানা পুলিশ। ঘটনাস্থলে থাকা এমআরটি পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিয়ারিং প্যাডটির ওজন ১০০ কেজির বেশি হবে। বিয়ারিং প্যাডটি পিলার থেকে ছিটকে সরাসরি ওই পথচারীর মাথায় পড়ে।

তদন্ত কমিটি গঠন ও ক্ষতিপূরণের আশ্বাস : গতকাল দুপুরে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, মেট্রোরেল লাইনের বিয়ারিং প্যাড পড়ে পথচারীর মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নিহতের পরিবারকে প্রাথমিকভাবে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। তার পরিবারে কর্মক্ষম কোনো ব্যক্তি যদি থাকে তাকে মেট্রোরেলে চাকরির ব্যবস্থা করা হবে বলেও জানান উপদেষ্টা।

পাঁচ সদস্যের এই তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক হলেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফ। কমিটিতে কারিগরি ও প্রকৌশলগত পর্যালোচনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং সামরিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট (এমআইএসটি)-এর বিশেষজ্ঞগণকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এ বি এম তৌফিক হাসান, এমআইএসটির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো: জাহিদুল ইসলাম এবং ডিএমটিসিএলের লাইন-৫-এর প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব। উপসচিব আসফিয়া সুলতানা কমিটিতে সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করবেন।

কমিটি গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর সংঘটিত পূর্ববর্তী দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধকল্পে প্রয়োজনীয় সুপারিশমালা প্রস্তুত এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করাও কমিটির কাজের অন্তর্ভুক্ত। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে।

মেরামত শেষে মেট্রোরেল চালু : মেট্রোরেল লাইনের যে পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড পড়েছে সেটি মেরামত করছিল ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) কারিগরি টিম।

সরেজমিনে দেখা যায়, বিকেল সোয়া ৩টার দিকে মেইন লিফট গাড়ি নিয়ে দুর্ঘটনাস্থলে আসে ডিএটিসিএলের কারিগরি টিম। এর পর তারা বিয়ারিং প্যাড ছিটকে পড়া পিলারটি মেরামত শুরু করেন।

ঘটনাস্থলে থাকা এমআরটি পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) আশরাফ সিদ্দিক বলেন, ডিএমটিসিএল থেকে টেকনিক্যাল টিম এসেছে। তারা পিলারটি মেরামত করছেন। আগারগাঁও স্টেশনে ট্রেন ঘুরানোর ব্যবস্থা করা হলে উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও স্টেশন পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল শুরু হয়েছে।

জনভোগান্তি ও আতঙ্ক : ঘটনার পরপরই কাওরান বাজারে উত্তরামুখী একটি ট্রেন যাওয়ার সময় ঘোষণা করে বলা হয়, দ্রুত ট্রেন থেকে যাত্রীরা নেমে পড়েন। এমন বার্তা পাওয়ার পর যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ বলেন, ট্রেনে বোমা থাকতে পারে। মেট্রোরেল লাইন বন্ধ হওয়ায় শহরের বিভিন্ন স্টেশনে যাত্রীদের মধ্যে চরম দুর্ভোগ নেমে আসে। অফিসগামী, শিক্ষার্থী ও জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া যাত্রীরা বিপাকে পড়েন। মতিঝিল, সচিবলায়, শাহবাগ, কাওরান বাজার, ফার্মগেট, আগারগাঁও, মিরপুর-১০ এবং পল্লবী স্টেশনে শত শত অপেক্ষমাণ যাত্রী ভোগান্তিতে পড়েন। হঠাৎ বন্ধ হওয়ায় মেট্রোরেল থেকে বের হয়ে সবাই বিকল্প পরিবহনে গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে যানজট ও বাস সঙ্কটে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীর।

প্যাড খুলে পড়ার কারণ কী হতে পারে : পিলার ও ভায়াডাক্টের সংযোগস্থলে বিয়ারিং প্যাডগুলো বসানোর জন্য বেজ বা ভিত্তি রয়েছে। এটি নাট-বল্টু কিংবা অন্য কিছু দিয়ে আটকানো থাকে না; বরং পিলার ও ভায়াডাক্টের মতো ভারী বস্তুর চাপে এটি টিকে থাকে। একেকটি স্প্যানের ওজন কয়েক শ’ টন হবে। কেন এই দুই ভারী বস্তুর চাপের পরও এভাবে ভিত্তি থেকে ছিটকে বিয়ারিং প্যাড নিচে পড়ে গেল, তা সবার কাছেই বড় প্রশ্ন। কারণ, এ ধরনের ঘটনা মেট্রোরেলের ইতিহাসে বিরল বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

এর পেছনে নকশাগত ত্রুটি থাকতে পারে বলে মনে করেন ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা। মেট্রোরেলের লাইনসহ যাবতীয় নকশা প্রণয়নের দায়িত্বে ছিল জাপানের কয়েকটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের জোট এনকেডিএম অ্যাসোসিয়েশন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, বিয়ারিং প্যাডটি বসানো হয়েছে মেট্রোর নিরাপদ চলাচল ও স্থাপনার স্থায়িত্ব ধরে রাখতে। কিন্তু এই ব্যবস্থায় নিচে পড়ে মানুষ মারা গেলে তো বলতে হবে এর নকশাগত ত্রুটি থাকতে পারে। মেট্রোরেলের জন্য সবচেয়ে দামি জাপানি পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তা হলে তাদের নকশায় কি কোনো ত্রুটি ছিল।

প্রসঙ্গত ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশে প্রথম মেট্রোরেল চালু হয়। শুরুতে চলাচল করত উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত।

পর্যায়ক্রমে স্টেশনের সংখ্যা বাড়ে। মতিঝিল পর্যন্ত সব স্টেশনে যাত্রী ওঠানামা শুরু হয় ২০২৩ সালের শেষ দিনে। এখন কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল সম্প্রসারণের কাজ চলছে।