১৫০ হলেই কেন কাঁপাকাঁপি

Printed Edition

জসিম উদ্দিন রানা

মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ব্যাটে যেন ঘুণে ধরেছে। এক সময় যেখানে লড়াইয়ের প্রতীক ছিল টাইগাররা, এখন তাদের ব্যাটে ভয়, বিভ্রান্তি আর আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি। টার্গেট যদি দেড়শ’র বেশি হয়, সেটিই যেন পাহাড়সম মনে হয়। প্রতিপক্ষ রান তুললেই মাথায় বাজপড়ার মতো অবস্থা, কাঁপতে থাকে হাঁটু, কাঁপে হাত। শুরুতেই উইকেট হারিয়ে দল পড়ে চাপে, তারপর ধসে পড়ে পুরো ইনিংস। বারবার একই চিত্র, একই পরিণতি। যেন প্রতিটি ব্যাটার জানেন না কিভাবে ইনিংস গড়তে হয়, কিভাবে দায়িত্ব নিতে হয়।

বোলাররা প্রাণপণ চেষ্টা করেও দলের জয় এনে দিতে পারছে না, কারণ রানই তো যথেষ্ট নয়। এমন ব্যাটিং ব্যর্থতা এখন নিয়মিত দৃশ্য। বিদেশের মাঠে তো বটেই, ঘরের মাঠেও আত্মবিশ্বাস খুঁজে পাওয়া যায় না। দর্শকরা হতাশ, বিশ্লেষকরা চিন্তিত। বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে আসবে কবে আলোর ঝলক? সময় এসেছে নিজেদের আয়নায় দেখার, ভয় ঝেড়ে ফেলে নতুন করে মানসিকতা গড়ে তোলার। নইলে ‘দেড় শ’ টার্গেট সিনড্রোম’-ই হয়তো ক্রিকেটের চিরচেনা দুঃস্বপ্ন হয়ে থাকবে।

প্রথম টি-২০তে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে লক্ষ্যটা ছিল নাগালে। সেই লক্ষ্য পেরুতে গিয়েও ১৬ রানে হেরে সিরিজে পিছিয়ে পড়েছিল লিটন দাসের দল। তবে বৈশ্বিক টি-২০ বিচারে ১৬৬ রান নাগালের হলেও বাংলাদেশের বাস্তবতা যেন ভিন্ন। চলতি বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায় লক্ষ্য যখনই দেড় শ’ ছাড়িয়েছে, তখনি কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেছে। বেশির ভাগ সময়ই পেরে উঠেনি বাংলাদেশ।

দ্বিতীয় ম্যাচে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্টেডিয়ামে সিরিজ বাঁচানোই একমাত্র লক্ষ্য ছিল না লিটন দাসের দলের। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চে টি-২০ বিশ্বকাপ সামনে রেখে, টানা পঞ্চম টি-২০ সিরিজ জয়ের পথে থাকতে হলে দলটিকে আরো গভীর কিছু ভাবতে হবে। সে ভাবনায়ও পড়েছে ছেদ। ক্যারিবীয়দের ১৪৯ রানের জবাবে ৮ উইকেটে ১৩৫ রানে শেষ হয়েছে টাইগারদের ইনিংস। হার ১৪ রানের।

লিটন বলেন, ‘গত ২-৩ সিরিজে বোলাররা সত্যিই ভালো করেছে। আমি আমাদের বোলারদের জন্য সত্যিই দুঃখিত, তারা ভালো বোলিং করেছে; কিন্তু আমরা ব্যাটসম্যানরা ম্যাচ শেষ করতে পারিনি। লক্ষ্য তাড়ায় ব্যর্থ হই। ১৫০ রানের লক্ষ্য চট্টগ্রামে বড় কিছু নয়, সমস্যা ছিল শুরু থেকেই। আমার ১৩ থেকে ১৪ ওভার পর্যন্ত উইকেটে থাকতে হতো। আমার নিজেরও উন্নতি করতে হবে, আমি উইকেটে থাকলে খেলা আগেই শেষ হতে পারত।’

২০২৫ সালে বাংলাদেশ মোট ২৬টি টি-২০ খেলেছে, যার মধ্যে ১৩টিতে জয় পেয়েছে, একটি ম্যাচ হয়েছিল পরিত্যক্ত। মানসিক তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার কোনো সুযোগ নেই। কারণ বিশেষ করে যখন দেখা যায়, দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং করে ১৫ ম্যাচের মধ্যে ৯টিতে জয় পেয়েছে। ৬০ শতাংশ সাফল্যের হার। যদিও এরমধ্যে খেলা বহুজাতিক আসর এশিয়া কাপে ব্যর্থ হয়েছে দল। কিন্তু পরিসংখ্যানের এই বাহ্যিক সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে উদ্বেগজনক প্রবণতা, যা আগামী টি-২০ বিশ্বকাপে টাইগারদের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এই সময়ে বাংলাদেশ সাতটি ম্যাচে ১৫০ রানের বেশি লক্ষ্য তাড়া করেছে, এবং জিতেছে মাত্র দুইটিতে। মজার বিষয় হলো, এর একটি জয় এসেছিল মাত্র ১৫১ রানের লক্ষ্য তাড়া করে, গত অক্টোবরে শারজায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে।

অর্থাৎ, যখনই লক্ষ্য ১৫০ ছাড়িয়েছে, বাংলাদেশ হিমশিম খেয়েছে। এমনকি তারা এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৩৬ রানের সাধারণ লক্ষ্যও তাড়া করতে পারেনি। যে ম্যাচে জয় পেলে তারা উঠত টুর্নামেন্টের ফাইনালে। সেই হারটি স্পষ্ট করে দিয়েছিল, গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে মাঝারি লক্ষ্যও বাংলাদেশের কাছে কখনো কখনো পাহাড়সম।

মিরপুরের ধীর ও টার্নিং কালো উইকেটে নিজের দলের শক্তির জায়গায় খেলে ওয়ানডে সিরিজ জয়ের পর লিটন চট্টগ্রামের ভিন্ন ধরনের উইকেটে খেলার চ্যালেঞ্জের কথা বলেছিলেন। প্রথম টি-২০র পর লিটন কূটনৈতিক ভদ্রতায় আবদ্ধ থাকেননি। প্রথম ওয়ানডেতে শামীম হোসেনের দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিং নিয়ে তিনি প্রকাশ্যেই সমালোচনা করেন। পুরস্কার বিতরণীতে লিটনের স্পষ্ট বক্তব্য, ‘আমি শামীমের ব্যাটিংয়ে হতাশ। শুধু ব্যাটিং উপভোগ করতে মাঠে নামা যাবে না, দায়িত্ব নিতে হবে।’

প্রতিপক্ষকে ১৫০ রানের নিচে আটকে রাখার জন্য বোলারদের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমাতে হবে। যখন শীর্ষ দলগুলো টি-২০তেও ২৫০ থেকে ৩০০ রানের ইনিংস পর্যন্ত খেলে ফেলছে, সেখানে বাংলাদেশের ১৫০-এর গণ্ডি পেরোতে হিমশিম খাওয়াটা যেমন হাস্যকর, অন্য দিকে এটি এক নির্মম বাস্তবতা। যা পরিবর্তন না করলে আসন্ন বিশ্বকাপে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হবে।