০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ২ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে-’

-

আমি তখন জেলা সদরের একটি হাইস্কুলের ছাত্র। আমাদের পাড়ায় তখন ১২ মাসে ১৩ পার্বণের মতো অনুষ্ঠান লেগেই থাকত। মুকুল ফৌজ, মহিলা শিক্ষা সমিতি, আমরা ক’জনা, নববিচিত্রা সাংস্কৃতিক একাডেমির নামে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের শেষ নেই। এগুলোতে প্রায়ই অধ্যাপক ইউসুফ আলী, জেলা প্রশাসক, জেলা সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা, বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকমণ্ডলী অতিথি থাকতেন। আমাদের বাড়ির পাশেই এক আঞ্চলিক পাসপোর্ট কর্মকর্তা থাকতেন। এসব আয়োজনে, পাড়ার কোনো বিয়ে বা অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে তাকে কখনোই আমন্ত্রিত হতে দেখিনি। তিনি রোজ সকালে মাথা নিচু করে হেঁটে অফিসে যেতেন, সন্ধ্যায় একইভাবে বাসায় ফিরতেন। যাওয়া-আসার সময় কেউই তার সাথে কোনো কথা বলতেন না। সামাজিকভাবে তিনি ছিলেন পরিত্যাজ্য। এর কারণ ঘুষখোর হিসেবে তার সুখ্যাতি? এখন সময় পাল্টেছে। এখন ঘুষ নেই। ঘুষের জায়গায় শোনা যায় উপরি বা স্পিড মানির কথা। এই উপরি বা স্পিড মানির বদৌলতে অফিসের গাড়িচালক হয়ে যান কোটি কোটি টাকার মালিক। যারা ওপরের তলায় অভিজাত (?) ক্ষমতাধর (?) চাকরি করেন, তাদের অনেকেই আরব্য উপন্যাসকে হার মানিয়ে অজানা তেলেসমাতিতে হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে যান। চাকরি নামক সোনার হরিণের ছোঁয়ায় তাদের সব কিছুই স্বর্র্ণময় হয়ে ওঠে। সম্পদ ও ক্ষমতার অধিকারী হয়ে তারা বুক ফুলিয়ে সবার সামনে থেকে বারবার রাষ্ট্রীয় পুরস্কার নিয়ে জানান দেন- জয়তু দুর্নীতি।
চাকরির সোনার হরিণের সুবাদে অনেকে বিদেশে ঠিকানা তৈরি করেন, বিত্ত বাড়ান বিদেশের ব্যাংকে। দুর্নীতিতে যিনি যত সিদ্ধহস্ত তিনি তত বেশি সম্মানিত-প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান। এভাবে অর্থনীতিতে অবৈধ সম্পদের দাপট সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের পথকে প্রশস্ত করেছে। জাতীয় পর্যায়ে দুর্নীতিকে না বলা সত্ত্বেও প্রকারান্তরে এটি বৈধতা পেয়ে গেছে। জাতীয় বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুবিধা দুর্নীতিকে আরো উসকে দিতে পারে- এ আশঙ্কা সিআইডির প্রধান, অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়ার (দৈনিক বণিক বার্তা, ১ জুলাই-২০২৪)। এ ব্যাপারে মুখ খুলেছেন, প্রতিবাদী হয়েছেন জাতীয় সংসদের সদস্যরা। দুর্নীতি দেশে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে বলেও কোনো কোনো সংসদ সদস্য মন্তব্য করেছেন। মহামান্য হাইকোর্ট মন্তব্য করেছেন- দুর্নীতি সুশাসনের অন্তরায়। দুর্নীতি ও সুশাসন একসাথে চলতে পারে না।
বাংলাদেশে সমাজের প্রতিটি স্তরে আজ দুর্নীতির চাষাবাদ। লোভ, রাজনৈতিক প্রশ্রয়, বিচারহীনতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, শাসন কাঠামোর অস্বচ্ছতা ও অব্যবস্থা, বিচারিক ব্যবস্থার দুর্বলতা- সর্বোপরি সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দায়বদ্ধতার অভাবে আজ এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এসবের অভাবে বা দুর্বলতার কারণে ক্ষমতার অপব্যবহার, অর্থ আত্মসাৎ, সরকারি কোষাগার থেকে চুরি এবং বিশ^াসভঙ্গের মতো ঘটনাগুলো ঘটছে। বাড়ছে ঘুষবাণিজ্য, চাঁদাবাজি, অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ পাচার এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের মতো ঘটনাগুলো। আবার দুর্নীতিবাজদের দাপটে স্বাভাবিক জীবন যাপন হয়ে উঠছে কষ্টকর। সক্রেটিসের অমোঘ উচ্চারণ- ‘যখন ধনসম্পদ এবং ধনীরা সম্মানিত হয়, তখন ভালো মানুষদের জায়গা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। নৈতিকতা ও সামাজিকতা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।’ আমাদের দেশে বর্তমানে যেন এরই প্রতিচ্ছবি। পবিত্র কুরআনের ভাষায়- ‘খবরদার, পৃথিবীতে বিভ্রান্তি ও দুর্নীতি ছড়িয়ো না।’ (২-৬০) আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ- ‘তোমরা অন্যায়ভাবে অপরের সম্পদ গ্রাস করো না।’ (২-৪২) বস্তুত শুধু ইসলাম নয়, কোনো ধর্মবিশ^াসই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় না। নবী করিম সা: ঘুষ প্রদানকারী, ঘুষ গ্রহণকারী এবং মধ্যস্থতাকারীকে অভিশাপ দিয়েছেন। ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক দুর্নীতি সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলকেই ধ্বংস করে দেয় যা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও আমরা মহান সৃষ্টিকর্তার এ সাবধান বাণীকে থোড়াই গুরুত্ব দিচ্ছি।
দুর্নীতির মাত্রা কেবল অর্থনীতিকেন্দ্রিক সীমিত নয়। রাজনৈতিক দুর্নীতি বা দুর্নীতির রাজনীতি কলুষিত করে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের। রাষ্ট্রকে বিশ^ পরিসরে কালিমা লিপ্ত করে। অপরদিকে, অপরের সাথে নিজেদের দুর্নীতির তুলনা প্রকারান্তরে দুর্নীতির বৈধতা দেয়ার আরেক নাম। এ তুলনা করার সময় সংশ্লিষ্টরা একটি আপ্তবাক্য ভুলে যান- ‘তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?’ এটি ভুলে গিয়ে যখন অপরের দুর্নীতির সাথে নিজের দুর্নীতির তুলনা করে যৌক্তিকতা দেয়া হয় নিজের দুর্নীতির; তখন অজান্তেই দুর্নীতির সিংহ দুয়ার খুলে যায়। সমাজ থেকে নৈতিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের মৌলিক মানবিক গুণাবলির অনুপস্থিতি দুর্নীতিকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। রাজনৈতিক দুর্নীতি দেশের প্রতিটি অনাচে-কানাচে তৃণমূল পর্যায়ে দুর্নীতিকে ছড়িয়ে দেয়। রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে দুর্নীতিবাজরা হয়ে ওঠে হিংস্র্র হায়েনার মতো। এর ওপর দুর্নীতিবাজরা যখন পুরস্কৃত হয় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তখন শুরু হয় দুর্নীতির প্রতিযোগিতা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়ালের দৃষ্টিতে আজ দুর্নীতি সে পর্যায়ে নেই। বহুগুণে বর্ধিত হয়ে সদম্ভে বিরাজ করছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতার তর্জন গর্জন প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রীরা ছাড়াও দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিতরাও হররোজ করে যাচ্ছেন (বিচার ও প্রশাসন, ভেতর থেকে দেখা)। দুর্নীতি দমনের সরিষার ভূতের ব্যাপারে এর চেয়ে প্রাঞ্জল বক্তব্য আর কী হতে পারে? সাবেক সচিব ও এনবিআরের চেয়ারম্যান বদিউর রহমানের মতে, এখন দুর্নীতিবাজরা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে অনেক বেশি ক্ষমতাবান। এর প্রকাশ- দুর্নীতিবাজদের রক্ষার জন্য বিভিন্ন ধরনের চেষ্টা। বস্তুত, দু’-চারজনের দুর্নীতির খবর ঞরঢ় ড়ভ ঃযব রপবনবৎম মাত্র। প্রকৃতপক্ষে এর বিস্তৃতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ব্যবসায়, রাজনীতি, শিক্ষা, কৃষ্টি-পরিবহন, আমলাতন্ত্র, আইনি প্রশাসন- সর্বত্রই আজ দুর্নীতি ফণা তুলে দাঁড়িয়েছে। দু’-চারজন দুর্নীতিবাজকে শাস্তি দিলেই এটি রোধ করা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন সামাজিক সম্পৃক্ততা। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে আগে দরকার সরকারের দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে প্রথমেই আইনের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছাড়া দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন অলীক কল্পনা মাত্র। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে দায়বদ্ধতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা দরকার। জবাবদিহিতার অভাব মানুষকে বেপরোয়া করে তোলে। মানবাধিকারের পরিপূর্ণ চেতনা এবং প্রতিষ্ঠা ছাড়া দুর্নীতিকে উৎখাত করা সম্ভব নয়। সর্বোপরি প্রয়োজন জবাবদিহিতামূলক গণতান্ত্রিক পরিবেশ। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এ ক্ষেত্রে একটি বড় শর্ত। প্রচণ্ড রকমের সমাজ-সচেতনতা, জনগণের সম্পৃক্ততা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, সর্বোপরি সরকারের কঠোর সদিচ্ছা ছাড়া দুর্নীতিকে ঠেকানো অসম্ভব। এ ব্যাপারে নৈতিক চেতনা সৃষ্টির বিকল্প নেই। সবার ভেতর সঞ্চারিত হোক- ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে- তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে’-এই প্রত্যাশায়।
হলেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement