১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
সময়-অসময়

গাজা সঙ্কট সমাধানে চীন-ফ্রান্সের উদ্যোগ

-

গাজা যুদ্ধের অবসান ও ফিলিস্তিন সঙ্কটের সমাধানে চীন ও ফ্রান্স অভিন্ন অবস্থান নিয়েছে। চীনের এই অবস্থানে তাদের নীতি-কৌশলের ধারাবাহিকতা থাকলেও ফ্রান্সের ক্ষেত্রে এটি ব্যতিক্রম। ফ্রান্স ৭ অক্টোবরের পর ইসরাইলের গাজা যুদ্ধে সরাসরি সমর্থন জানিয়েছে। আবার দেশটি একমাত্র পশ্চিমা স্থায়ী সদস্য যে নিরাপত্তা পরিষদের গাজা যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। সমর্থন জানিয়েছে, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র্রের প্রতি। ফ্রান্সের এই পরিবর্তনে কি কৌশলগত কোনো সংশ্লিষ্টতা রয়েছে? আর ফ্রান্স-চীন এই সঙ্কটের সমাধানে কার্যকর কিছু কি করতে পারবে?
এটি ঠিক যে, যুক্তরাষ্ট্র না চাইলে ফিলিস্তিন সমস্যার কার্যকর সমাধান বেশ কঠিন। তবে ফ্রান্স শুধু পরাশক্তিই নয় একই সাথে দেশটিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিরাপত্তা নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দেশটির প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ ইউরোপের স্বতন্ত্র নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলারও প্রবক্তা। ফলে ফ্রান্সের যেকোনো অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যের জন্য গুরুত্বপূর্র্ণ। এ ছাড়া দেশটি মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান যে রাষ্ট্রিক বিভাজন তারও অন্যতম রূপকার। উপনিবেশ আমলে ফরাসি ভূমিকায় আফ্রিকায় ফ্রান্সবিরোধী তীব্র জনমত তৈরি হলেও ফ্রান্স পশ্চিমের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান নেয়ার জন্য অনেক দিন ধরে কাজ করছে। পশ্চিমের ‘ফাইভ আইজ’ তথা ইংরেজি ভাষাভাষী যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডার সাথে একধরনের দূরত্ব নানা ইস্যুতেই দেখা যায় ফ্রান্সের।

কী আছে চীন-ফ্রান্স যৌথ বিবৃতিতে
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সাম্প্রতিক চীন সফরকালে শি জিনপিংয়ের সাথে দেয়া যৌথ বিবৃতি অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গ্লোবাল টাইমসের মতে, বর্তমান ফিলিস্তিন-ইসরাইল সঙ্ঘাতের অবসান এবং ভবিষ্যতের ফিলিস্তিন-ইসরাইল শান্তি প্রক্রিয়ার পরিকল্পনার জন্য যৌথ বিবৃতিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সাথে এর রয়েছে সুদূরপ্রসারী কৌশলগত তাৎপর্য। এটি যেমন সময়োপযোগী তেমনি বিষয়বস্তুতে এটি ব্যাপক এবং এর দিকনির্দেশনাও পরিষ্কার।
যৌথ বিবৃতিতে ফিলিস্তিন-ইসরাইল সঙ্ঘাতের বর্তমান পর্বে উভয়পক্ষের সাধারণ অবস্থান, ফিলিস্তিন ইস্যু, ইরানের পারমাণবিক ইস্যু, লোহিত সাগর সঙ্কট এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য জরুরি ইস্যু অন্তর্ভুক্ত। ফিলিস্তিন-ইসরাইল বর্তমান সঙ্ঘাতে যুদ্ধবিরতি কার্যকর ও বৈরিতা বন্ধের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে অবিরাম আহ্বান জানানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে চীন-ফ্রান্সের যৌথ বিবৃতি শুধু ইসরাইল ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে দুই দেশের ঐকমত্যকেই প্রতিফলিত করে না; বরং বিশ্বশান্তি ও ন্যায়বিচারের বিষয়েও স্পষ্ট অবস্থানের প্রতিনিধিত্ব করে।
বিবৃতিতে ফিলিস্তিন-ইসরাইল ইস্যু সম্পর্কে, দুই রাষ্ট্রপ্রধান ‘দুই-রাষ্ট্র সমাধান’ দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়নের জন্য একটি নিষ্পত্তিমূলক ও অপরিবর্তনীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পুনঃপ্রবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন। তারা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইসরাইলের বসতি নির্মাণের নিন্দা করেছেন। সেই সাথে গাজা উপত্যকাজুড়ে দ্রুত, নিরাপদ, টেকসই এবং বাধাহীন মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় সব করিডোর ও ক্রসিং পয়েন্টগুলো কার্যকরভাবে খোলার আহ্বান জানিয়েছেন।
ইরানের পারমাণবিক ইস্যু ও লোহিত সাগরের সঙ্কটের বিষয়ে, চীন আর ফ্রান্স উভয়ই একটি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমাধানের বিষয়ে তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। একই সাথে লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরে নৌ চলাচলের স্বাধীনতা রক্ষার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছে।
ফিলিস্তিন-ইসরাইল ইস্যুতে চীন ও ফ্রান্সের যৌথ বিবৃতি ইঙ্গিত দেয় যে, দুই দেশ সেই বহিরাগত শক্তির বিরোধিতা করে, যা বিরোধ বাড়িয়ে দেয় আর একটি বিশেষ পক্ষ নিয়ে বিরোধ দীর্ঘায়িত করে। উভয় দেশই আলোচনার মাধ্যমে বিরোধের সমাধান করার পক্ষে।
মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুটি জটিল ও কুটিল, যার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঐকমত্য গঠন এবং বর্তমান আঞ্চলিক উত্তেজনা কমানো প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে চীন ও ফ্রান্সের রাষ্ট্রপ্রধানদের যৌথ বিবৃতি উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব বহন করে। এটি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐকমত্য প্রকাশ করে। চীন-ফ্রান্স যৌথ বিবৃতি ফিলিস্তিন-ইসরাইল শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে এবং বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে মনে করে গ্লোবাল টাইমস।
অন্য দিকে গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণ অনুসারে, বেইজিং তার কূটনৈতিক চিহ্ন তৈরি করার সর্বশেষ প্রচেষ্টায় রাফাহ আক্রমণের বিরুদ্ধে ইসরাইলকে আহ্বান জানাতে ফ্রান্সের সাথে যোগ দিয়েছে। চীন-ইউরোপীয় সমন্বয়ের বিরল মুহূর্ত এমন এক সময়ে এসেছে যখন বেইজিং এমন একটি অঞ্চলে তার কূটনৈতিক চিহ্ন তৈরি করার সর্বশেষ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে যেখানে তার গভীর অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে বেইজিংয়ের উদ্যোগ
বেইজিংয়ের প্রাথমিক উদ্যোগ হলো দু’টি প্রধান ফিলিস্তিনি উপদল, ধর্মনিরপেক্ষ ফাতাহ ও ইসলামপন্থী হামাসের মধ্যে পুনর্মিলনের চেষ্টা করা। গত সপ্তাহে দু’টি গ্রুপের মধ্যে আলোচনার আয়োজন করা হয়। যে শর্তেই যুদ্ধ শেষ হোক না কেন, চীন গাজা ও পশ্চিমতীরের প্রশাসনের জন্য একটি সুসংহত পরিকল্পনার পূর্বশর্ত হিসেবে ফিলিস্তিনি ঐক্যকে দেখে।
হামাসের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দফতরের প্রধান মুসা আবু মারজুক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি আশা করছেন ফাতাহ ও হামাস শিগগিরই দ্বিতীয় দফা আলোচনার জন্য বেইজিংয়ে ফিরে আসবে। তিনি বলেন যে, হামাস চায় চীন, রাশিয়া ও তুরস্ক হামাস আর ইসরাইলের মধ্যে যেকোনো শান্তিচুক্তির সহ-গ্যারান্টার হিসেবে কাজ করুক। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অক্ষমতা বা অনিচ্ছার প্রতি হামাসের অবিশ্বাসেরই সঙ্কেত।
চীন তার পদক্ষেপকে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে ৯ বছরের কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার অবসানে গত বছর যে ভূমিকা পালন করেছিল তার স্বাভাবিক সম্প্রসারণ হিসেবে দেখে।
সিনিয়র ফিলিস্তিনি নেতারা বেইজিংয়ে গত সপ্তাহের যে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন তাতে মারজুক ছাড়াও, হামাস দলে ছিলেন খলিল আল-হাইয়া ও হোসাম বদরান। অন্য দিকে ফাতাহর কেন্দ্রীয় কমিটির দুই সদস্য, আজম আল-আহমাদ ও সামির আল-রিফাই, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।
অংশত চীনা অর্থনীতিতে সংঘর্ষের প্রভাবের কারণে গাজা সঙ্ঘাত মধ্যপ্রাচ্যে চীনের ফিলিস্তিনপন্থী দৃষ্টিভঙ্গিকে কঠোর হওয়ার দিকে পরিচালিত করেছে। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার এক সপ্তাহের মধ্যেই চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ইসরাইলের বোমাবর্ষণের বর্ণনা দেন। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান আল-সৌদের সাথে একটি কলে চীনা প্রতিপক্ষ গাজায় হামলা ‘আত্মরক্ষার সুযোগের মাত্রার বাইরে চলে গেছে’ এমন পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে চীনকে অনুসরণকারী বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, মহাশক্তি প্রতিযোগিতার জন্য একটি প্রধান ক্ষেত্র হওয়া উচিত কি না অথবা উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা পালন করা উচিত কি না তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে এখন বিতর্ক চলছে। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জন অল্টারম্যান বলেন, চীন মধ্যপ্রাচ্যেই থাকবে। দেশটি ১৯৯৩ সাল থেকে তেলের প্রায় অর্ধেক মধ্যপ্রাচ্য থেকে কেনে। যার অর্থ চীন এমন একটি অঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য অব্যাহত রেখেছে।
এ প্রসঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। তিনি বলেছিলেন, ‘গত ২০ বছর ধরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে লড়াই করছে কিন্তু জিতছে না, আর চীন জিতেছে কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে লড়াই করছে না।’ তিনি যোগ করেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে চীনের বড় সাফল্য হলো বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, এটি মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রের পর রাষ্ট্রকে রাজি করায় যে বেইজিং বিশ্বের সর্ববৃহৎ উদীয়মান শক্তির ভূ-কৌশলগত হিসাব-নিকাশের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করতে পারে।’
অন্য দিকে নিংজিয়া ইউনিভার্সিটির চায়না-আরব রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর নিউ সিনচুন বলেন, উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো এখন তাদের তেলনির্ভরতা থেকে নিজেদের মুক্ত করা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা থেকে মুক্ত করা এবং উদীয়মান দেশ, উদীয়মান শিল্প এবং উদীয়মান বাজারকে আলিঙ্গন করার ইচ্ছা থেকে চীনে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করছে।

ফরাসি নীতির পরিবর্তন
তিন মাসেরও কম সময় আগে, ফরাসি সরকার হামাসের বিরুদ্ধে আইএসআইএস-এর মতো জোট গঠনের আহ্বান জানিয়েছিল। আর এখন সেই ফ্রান্স বলছে, গাজার ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকার ইসরাইলের নেই। ২৪ অক্টোবর ফ্রান্সের প্রাথমিক বিবৃতিতে ইসরাইলের প্রতি সম্পূর্ণ সমর্থন দেখায় আর ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাথরিন কোলোনার সর্বশেষ বিবৃতিতে গাজায় ইসরাইলের পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেন। প্রথম ধারণাটি হলো যে, গাজা উপত্যকায় তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে নির্বিচার ইসরাইলি গণহত্যা ফ্রান্সের জন্য একটি নৈতিক অবস্থান গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট ছিল। এরপর প্যারিস যুদ্ধবিরতির দাবি জানায়।
তবে এটি দু’টি কারণে হওয়ার কথা নয়। প্রথমত, ফরাসি বৈদেশিক নীতিতে নৈতিকতা খুব কমই একটি সমস্যা, যা একচেটিয়াভাবে অর্থনৈতিক স্বার্থ, আঞ্চলিক জোট ও ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের ওপর ভিত্তি করে চালিত হয়। দ্বিতীয়ত, প্যারিস অবশ্যই গাজায় ইসরাইলি গণহত্যার মাত্রা সম্পর্কে জানত। ইসরাইল গাজায় যুদ্ধ ঘোষণার পরপরই হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছিল।
যুদ্ধে ইসরাইল যে বেশির ভাগই নিরীহ বেসামরিকদের লক্ষ্যবস্তু করেছে তা স্পষ্ট হওয়ার পরেও ফ্রান্সের সমর্থন বাধাহীনভাবে অব্যাহত ছিল। ২৪ অক্টোবর, ম্যাক্রোঁ ইসরাইল সফর করেন, তার ইসরাইলি প্রতিপক্ষ, আইজ্যাক হারজোগকে বলেন, তিনি ইসরাইলের সাথে ‘কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে’ দাঁড়িয়েছেন এবং গাজা উপত্যকায় তেল আবিবের বোমাবর্ষণের জন্য ফ্রান্সের ‘পূর্ণ সমর্থন’-এর প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি আরো এগিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, হামাসের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে আইএসআইএসের বিরুদ্ধে গঠিত আন্তর্জাতিক জোটের মতো একটি আন্তর্জাতিক জোটের প্রয়োজন।
এর অর্থ হলো, আঞ্চলিক উত্তেজনা কমাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে, ম্যাক্রোঁ বিশ্বনেতা হিসেবে উপস্থিত হয়ে পশ্চিম আফ্রিকা ও সাহেল অঞ্চলে ফ্রান্সের ভূ-রাজনৈতিক ক্ষতিপূরণের আশায় ঠিক বিপরীত কাজটি করতে চেয়েছিলেন।
এরপর গত ৫ জানুয়ারি, ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলোনা যুদ্ধোত্তর ফ্রান্সের সবচেয়ে শক্ত বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের আন্তর্জাতিক আইনের নীতিতে ফিরে আসতে হবে এবং এটিকে সম্মান করতে হবে। ফিলিস্তিনি ভূমি গাজার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা ইসরাইলের ওপর নির্ভর করে না। তার বিবৃতি এই খবরের সাথে মিলে যায় যে, ফরাসি ও জর্দানের বিমানবাহিনী দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের একটি ফিল্ড হাসপাতালের জন্য সাত টন জরুরি মানবিক ও চিকিৎসা সহায়তা ফেলেছে।
কেন ফরাসি সরকার গাজায় ইসরাইলি গণহত্যায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন সমর্থন থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছে তার বেশ কয়েকটি ব্যাখ্যা হতে পারে। প্রথমত, বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত বাণিজ্যিক জলপথ বাব আল-মান্দাব হয়ে লোহিত সাগরে ট্র্যাফিক বিঘিœত করে ইসরাইলে আসা বা যাওয়া যেকোনো জাহাজকে লক্ষ্য করে ইয়েমেনি আনসরুল্লাহর কৌশলগত পদক্ষেপ। আনসারুল্লাহর সিদ্ধান্ত সরাসরি গাজায় ইসরাইলি গণহত্যার সাথে যুক্ত, এটি এমন একটি যুদ্ধ যা ওয়াশিংটনের মতো ফ্রান্সও আন্তরিকভাবে সমর্থন করেছিল। যদিও ফ্রান্স অনুমিতভাবে লোহিত সাগরের শিপিং রক্ষা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘অপারেশন সমৃদ্ধি গার্ডিয়ান’-এর সাথে সম্মত হয়েছিল। তবে ফ্রান্স জোর দিয়েছিল যে, এটি তার নিজস্ব সামরিক কমান্ডের অধীনে করবে এবং আনসারুল্লাহর বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোনো সামরিক পদক্ষেপে অংশ নেবে না। ইয়েমেনে এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ কারণ যা প্যারিসের অবস্থানের পরিবর্তনের একটি অংশ ব্যাখ্যা করতে পারে। কারণ ফ্রান্স এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অংশের সাথে তার বেশির ভাগ বাণিজ্যের জন্য বাব আল-মান্দাবের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল।

দ্বিতীয়ত, আরব দেশগুলোর সাথে ফ্রান্সের ঘনিষ্ঠ মিত্রতা। ওয়াশিংটনের বিপরীতে, মধ্যপ্রাচ্যে প্যারিসের কূটনীতির পূর্বাভাস দেয়া হয়নি সামরিক পদক্ষেপের ওপর ভিত্তি করে। যদিও এটি বিভিন্ন ক্ষমতায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, আইএসআইএস-বিরোধী জোট এবং আরো অনেক কিছুতে জড়িত ছিল। প্যারিস দৃঢ় রাজনৈতিক সংযোগ তৈরির মাধ্যমে কূটনীতিতে জঙ্গি আমেরিকান পদ্ধতির একটি নরম সংস্করণ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে। এতে তথাকথিত আরব-ইসরাইলি সঙ্ঘাতের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি আরো ভারসাম্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে।
তৃতীয়ত, ফ্রান্সে সামাজিক অস্থিতিশীলতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। তেল আবিবের প্রতি ওয়াশিংটনের সমর্থন এখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বাইডেন প্রশাসনের জন্য একটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। গাজায় ইসরাইলি গণহত্যা ফরাসি সমাজে অভ্যন্তরীণ সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হবে। ফ্রান্সের অনেক প্রগতিশীল শক্তি তাদের ন্যায়বিচার ও সমতার সংগ্রামে প্রায়ই ফিলিস্তিনকে একটি প্রধান ইস্যু হিসেবে দেখে এসেছে। আনুমানিক ৫০ লাখ ফরাসি মুসলমানের সাথে তারাও গাজা যুদ্ধের ব্যাপারে সক্রিয়। ফলে গাজা ফরাসি সমাজের জন্য একটি দৈনন্দিন সমস্যা হয়ে উঠেছে, যারা যুদ্ধের প্রথম দিন থেকে যুদ্ধবিরতির দাবিতে কখনো প্রতিবাদ বন্ধ করেনি।
ম্যাক্রোঁ বোঝেন যে, তার সরকারের রাজনৈতিক ভঙ্গুরতার কারণে এবং নিজের অবস্থানের কারণে, তিনি এই প্রতিবাদগুলোকে দীর্ঘায়িত করতে পারবেন না। এটি অন্যান্য সমস্যার সাথে বিকশিত হলে পরিস্থিতি জটিল করতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ফ্রান্সের রাজনৈতিক পরিবর্তন যে কারণেই আসুক না কেন এটি তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে যদি এর ধারাবাহিকতা থাকে এবং প্রকৃতপক্ষে, একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক অবস্থানে বিকশিত হয়ে কথামালার বাইরে, কর্মে পরিণত হয়। তেমন সম্ভাবনা নানা কারণেই দেখা যাচ্ছে। বিশেষত এই পরিবর্তনের সাথে বৈশ্বিক কৌশলগত পরিবর্তনের একটি সংশ্লিষ্টতা দৃশ্যমান হচ্ছে। ম্যাক্রোঁর বেইজিং সফরের পর শি জিনপিং ফ্রান্স ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সফর করতে যাচ্ছেন। এই সফরকে ইউরোপের নিরাপত্তা ও ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। এ বিবেচনায় মনে হচ্ছে ফ্রান্সের ফিলিস্তিন ইস্যুতে নীতি পরিবর্তন কসমেটিক কোনো কিছু নয়, এর টেকসই তাৎপর্য রয়েছে। আর চীনা প্রচেষ্টার সাথে ফ্রান্সের সংযোগ গাজা যুদ্ধ বন্ধ ও ফিলিস্তিন সমস্যার স্থায়ী সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আর এ উদ্যোগকে আঞ্চলিক শক্তিগুলোও স্বাগত জানাতে পারে। এটি ঘটলে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রাসঙ্গিকতা হারাতে থাকবে।
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র খেয়ালখুশিমতো খরচ হয়েছে জলবায়ু তহবিলের অর্থ গুমে শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততা পেয়েছে কমিশন : র‌্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ আরাকানে সাড়ে ৪ শ’সেনা নিহত, জান্তার নিয়ন্ত্রণ শেষ বিপাকে রোহিঙ্গারা ভারতসহ সাত ‘অসহযোগী’ দেশের তালিকা ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের সিরীয়রা স্বাধীনতা উদযাপনের সময় দামেস্কে ইসরাইলের হামলা আগামীতে সবাইকে নিয়ে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে বেক্সিমকোর জন্য ১৮০ কোটি টাকা ছাড় করছে জনতা ব্যাংক বেকারত্বহীন বাংলাদেশ গঠনে কাজ করছে জামায়াত : ডা: শফিক বিজয় ঘোষণার অপেক্ষা ভারতকে দেয়া সুইজারল্যান্ডের বিশেষ সুবিধা প্রত্যাহার

সকল