১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

উপজেলা নির্বাচন : সরকারদলীয় নিরঙ্কুশ ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া

-


উপজেলা নির্বাচনের পয়লা পর্ব শেষ। যেমন হওয়ার ছিল তেমনই হয়েছে। সামনে আছে আরো তিন পর্ব। প্রথম দফায় ১৫২টি উপজেলার তফসিল ঘোষণা করা হয়। নির্বাচন হয়েছে ১৩৯টি উপজেলায়। ভোটের আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন ২৮ জন প্রার্থী। ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনেও ভোটার উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। আবারো ভোটারহীন একটি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। অনেক এলাকায় সারা দিনই কেন্দ্র ছিল ফাঁকা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও ভোটারের দেখা মেলেনি। তবে ভোট শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে দাবি করেছেন। যদিও ভোটের আগে নির্বাচনে বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতার আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেছিলেন, এই নির্বাচনে ব্যর্থ হলে বিগত সংসদ নির্বাচনে যে ‘গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা’ প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তা ‘ক্ষুণœ’ হতে পারে। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ‘প্রমাণ’ করতে হবে বাংলাদেশে গণতন্ত্র আছে ।
এদিকে বিএনপি গত সংসদ নির্বাচনের মতো ঘোষণা দিয়েই তারা এ নির্বাচনও বর্জন করেছে। বিএনপি বলছে, আওয়ামী লীগের প্রতারণার ফাঁদে পা না দিয়ে দেশের ভোটাররা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো উপজেলা নির্বাচনও প্রত্যাখ্যান করেছেন। এখন আর ভোটের প্রয়োজন হয় না। ফলাফল নির্ধারিত থাকে, সেটিই ঘোষিত হয়। তাই ভোট নিয়ে মানুষের আগ্রহ নেই।

উপজেলার কথায় প্রাসঙ্গিকভাবে নাম আসে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের উদ্দেশ্যে এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল তার সরকার। উপজেলা করে এরশাদ দেশ ধ্বংস করে দিচ্ছেন, এমন অভিযোগে তখন হরতালসহ নানা কর্মসূচি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অনেকেই। ট্র্যাজেডি হচ্ছে, উপজেলার প্রবর্তকের দল এরশাদের জাতীয় পার্টিও এবারের উপজেলা নির্বাচনে তেমন নেই। গেল সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় তাদের এ সিদ্ধান্ত।
নির্বাচনটি মূলত আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের মধ্যেই। পাস-ফেল তাদের মধ্যেই হয়েছে এবং হবে। ফলে নিজেদের নির্বাচনেও নিজেরা সঙ্ঘাত করেছে। জাল ভোটে বাধা দেয়ায় নির্বাচনী কর্মকর্তাদের মেরে সিধা করেছে। জাল ভোট ছাড়াও জোরজবরদস্তি এবং ভোট কিনতে টাকা বিলানো, পাশাপাশি মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের প্রভাব বিস্তার তো চলছেই।
মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ, গুলি, টিয়ার শেল, জাল ভোটের মহোৎসবসহ বিভিন্ন ঘটনায় নির্বাচন কমিশনও তেমন গুরুতর কিছু মনে করছে না। কোথাও কোথাও সঙ্ঘাত আর কোথাও কোথাও কেন্দ্রগুলো দিনভর প্রায় ফাঁকার মধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা অলস সময় কাটানোকে স্বাভাবিক মনে করেছেন। ফেনীর পরশুরাম উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে প্রার্থীদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ভোটের আগেই সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। শুধু ফুলগাজী উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে দু’-একটি কেন্দ্র ছাড়া বাকি সব কেন্দ্রই ফাঁকা ছিল।

তার পরও সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশন ভোট কাস্টিংয়ের যে হার দেখিয়েছে তা যথেষ্ট মনে করেছেন। কারণ আমাদের নির্বাচনী আইনে ১ শতাংশ ভোট পড়লেও চলে। তা না হলেও হয়। বিনাভোটে জিতে যাওয়াও অবৈধ নয়। তাও আইনে অনুমোদিত। তাই সব মিলিয়ে ধারণা করাই যায় সামনে উপজেলা নির্বাচনের বাকি তিন এপিসোডে কী হবে বা হতে পারে!
ভোটার উপস্থিতি এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়াতে আওয়ামী লীগ এবার কৌশল পরিবর্তন করে তাদের কোনো প্রার্থীকে দলীয় প্রতীক দেয়নি। এরও কী সুফল প্রথম ধাপে ১৩৯টি উপজেলায় দেখা গেছে। এতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বেদম খুশি। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনও বেশ সন্তুষ্ট হয়েছে। ভোটারের কম উপস্থিতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সিইসি বলেছেন, ‘আমাদের বলা হয়েছে, অনেকেই ধান কাটতে থাকায় ওরা ভোট দিতে আসেননি। এছাড়া, সকালে বেশ কিছু জায়গায় ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে, এটি একটি কারণ হতে পারে।’
২০১৯ সালে প্রথমবার দলীয় প্রতীকে উপজেলা নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল ৪০ দশমিক ২২ শতাংশ। সেবার পাঁচ ধাপে উপজেলার ভোট হয়। এর আগে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬১ শতাংশের মতো। সে বছর ভোট হয় ছয় ধাপে। দেড় দশক আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি তৃতীয় উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। এবার কেবল বিএনপি, জাতীয় পার্টি নয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিকরাও বেশ জেনে বুঝে উপজেলা নির্বাচনে অনুপস্থিত। ১৪ দলীয় নেতারা আগেভাগেই বলেছেন, অর্থ, প্রভাব, পেশিশক্তি ও লোকবল- এসব বিবেচনায় আওয়ামী লীগের সাথে ভোটযুদ্ধে নামার মতো শক্তি তাদের নেই।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি গোসসা করে বলেছেন, উপজেলা নির্বাচন তো করবেন বিত্তবানরা। যাদের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আছে। উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীদের জামানতের টাকা বাড়ানোর বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে দলটির নেতারা বলেছেন, কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কেবল বিত্তবান বা ধনীরাই নির্বাচন করতে পারবেন, সাধারণ মানুষ নয়। উল্লেখ্য, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে জামানতের পরিমাণ ১০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে এক লাখ টাকা এবং ভাইস চেয়ারম্যান পদে জামানত পাঁচ হাজার টাকার জায়গায় ৭৫ হাজার টাকা করা হয়েছে এবার। যেখানে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীর জামানত ২০ হাজার টাকা। এটি প্রকারান্তরে নির্বাচনে আলীবাবাদের প্রতিই এক ধরনের আমন্ত্রণ। উপজেলাগুলোতে এখন এমন এক রূপ নিয়েছে, যেখানে কেবল টাকা, পরিবারতন্ত্রের খেলা। এখানে রাজনীতি, জনগণ, তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ অবান্তর। ভোটের খরচপাতি, আয়-ব্যয় ও সম্পদের গোঁজামিলে একে আবার বৈধতা দেয়ার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। তা আলাদিন, চেরাগ আলী, মাফিয়া-দুর্বৃত্তদের জন্য রাষ্ট্রীয় আশীর্বাদ।
বলার অপেক্ষা রাখে না, উপজেলায় নির্বাচন মূল বিষয় নয়। নির্বাচন বা ভোট কেবলই নিয়ম রক্ষার বিষয়। আসল কথা স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় ক্ষমতায়ন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সেখানেও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চায়। নিয়ম রক্ষার্থে উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থীদেরও আয়-ব্যয় ও সম্পদের হলফনামা দিতে হয়। নির্বাচনী বিধিতে একে বলে প্রদর্শন। মানে লামসাম দেখানো। এ হলফনামা মোটেই আমলনামা নয়। দেখানোর জন্যই দেখানো। এই বিবরণীতেই উপজেলার কোনো কোনো প্রার্থীর সম্পদ-সম্পত্তি ও আয় উন্নতির যে ঝলক, চোখ কপালে না উঠে পারে না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এ বিষয়ে একটি জরিপ দিয়েছে। জাতীয় সংসদের মতো এ নির্বাচনেও ধনাঢ্য ও ব্যবসায়ীদের দাপট। বুধবার হয়ে যাওয়া প্রথম ধাপের নির্বাচনে ১১৭ প্রার্থী ছিলেন যাদের প্রত্যেকের কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে। কমপক্ষে এক একর পরিমাণ জমি রয়েছে- এমন প্রার্থী ৫৫০ জন। আইনি সীমা অনুযায়ী একজনের ১০০ বিঘা বা ৩৩ একর বেশি জমি থাকার নিয়ম নেই। অথচ ওই সীমা অতিক্রম করা জমি রয়েছে অন্তত আট চেয়ারম্যানপ্রার্থীর। তাদের একজনের সর্বোচ্চ ৭৪.২৭ একর জমি আছে।

গত পাঁচ বছরে অস্থাবর সম্পদ অর্জনে সংসদ-সদস্যদেরও ছাড়িয়ে গেছেন উপজেলা চেয়ারম্যানরা। ওই সময়ে সংসদ-সদস্যদের সম্পদ বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ৩০৬৫ শতাংশ। পক্ষান্তরে একজন উপজেলা চেয়ারম্যানের সম্পদ বেড়েছে ৪২০০ শতাংশের বেশি। উপজেলা চেয়ারম্যানদের স্ত্রী-সন্তানদের সম্পদও সংসদ-সদস্যদের তুলনায় বেড়েছে। সংসদ-সদস্যদের স্ত্রী-সন্তানদের সম্পদ বাড়ার সর্বোচ্চ হার ৯৯০৭ শতাংশ। সেখানে একজন চেয়ারম্যানের পরিবারের সম্পদ বেড়েছে সর্বোচ্চ ১২৪০০ শতাংশ। প্রথম ধাপের ১৪৪ উপজেলার প্রার্থীদের হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ করে টিআইবি এসব তথ্য দিয়েছে। কেবল কেন্দ্রে নয়, স্থানীয় পর্যায়েও রাজনীতির সক্ষমতা বা হেডমের জোরে বহু আলাদিন, বহু চেরাগ, আলীবাবার জন্ম হয়েছে। চল্লিশ চোরও বাদ নেই। ইসির কাজই মূলত এই আলাদিনদের প্রদর্শিত হিসাব বিবরণী গ্রহণ করা। সেখানে প্রার্থীদের প্রদর্শিত হাঁস-মুরগি পালন, পুকুরের মাছ, বউয়ের গয়নার গাঁজাখুরি হিসাব দেখার গরজ তাদের নেই। ‘গৃহীত বলিয়া গণ্য হইল’ বা ‘বুঝিয়া পাইলাম’ পর্যন্তই কর্মসারা তাদের। এই আলাদিন, চেরাগ আলী কারা? কোথায় কিভাবে তাদের এত কামাই, এত বিত্ত তা ওপেন সিক্রেট।

কিন্তু, পরিচয়ে তারা জনগণের সেবক-খাদেম। এই সেবক-খাদেমরা এবার পিউর একদলীয় এবং ক্ষমতাসীন। আওয়ামী লীগ না হলে অন্য কোনো লীগ। নইলে এমপি-মন্ত্রী লীগ, ভাই লীগ, ভাবী লীগ, শ্যালক লীগ। নিদেনপক্ষে চাচাতো-মামাতো, ফুফাতো ধরনের এই আলাদিনরা যার যার এলাকায় মহাবীর-পরাক্রমশালী। চেরাগ তাদের ঘষার আগেই জ্বলে ওঠে। তাদের আত্মীয়-স্বজন বলা যাবে না। ক্ষমতাসীন দল থেকে আত্মীয়ের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। অন্যের নয়, একদম নিজের স্ত্রী-সন্তানই আত্মীয়। বাদবাকি ভাইবোন শ্যালক, বোন জামাইরা অন্য কারো স্ত্রী-সন্তান নন, অতএব তারা মন্ত্রী-এমপির স্বজন নন। তামাশা কাকে বলে! বাঙালির সাথে কত মশকরাই তো সম্ভব। অথচ কদিন এ নিয়ে কী নাচানোই না হয়েছে গণমাধ্যমসহ গোটা বাঙালকে। এবারের উপজেলা নির্বাচনে মশকরা-তামাশা হবে তার নমুনা ছিল আগে থেকেই। এর কিছুটা রাজনৈতিক, বাকিটা অর্থের কারণে। এ নিয়ে সমালোচনা কম হয়নি। কিন্তু, গা মাখার গরজ নেই সরকারের দিক থেকে। গত কয়েকটি নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামায় সম্পদের বিনোদিত-হাস্যকর হিসাব নিয়ে সমালোচনা নিরর্থক বিবেচিত হয়েছে।

এমনকি হলফনামার তথ্য খতিয়ে দেখার দরকারও মনে করা হয়নি। গেল সংসদ নির্বাচনে অনেক প্রার্থীর দেয়া সম্পদের পরিমাণ গত পাঁচ বছরে কয়েক শ’ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধির তথ্য গণমাধ্যমে এসেছে। কারো কারো নিজের নামে সম্পদ মামুলি দেড়-দুইগুণ বাড়লেও তাদের স্ত্রীদের নামে সম্পদের পরিমাণ ৫০-৬০ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। যা মানুষকে বিনোদিত করেছে মাত্র। শুধু বিনোদনের জন্য এ ধরনের বিধান রাখার কী দরকার? মনোনয়নপত্রের সাথে প্রার্থীর হলফনামা জমা দেয়ার নিয়ম কার্যকর হয় ২০০৮ সাল থেকে। যার মধ্যে প্রার্থীর আয়-ব্যয়, সম্পদের হিসাব, তার ওপর নির্ভরশীলদের আয়-ব্যয়, সম্পদের হিসাব সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকে। এ নিয়ে শুরু থেকেই একটি তামাশা। এখন সেটি আনলিমিটেড পর্যায়ে। বিচার বা বিহিতের বিষয় তামাদি। পগারপার হয়ে দিব্যি সিনা টান করে ঘুরছেন মাননীয়রা। তাদের এ নিয়ে প্রশ্ন করার সাহসও আছে কারো? বরং অবারিত সুযোগ এই সার্কাস দেখা, আহা বেশ বেশ বলা। নইলে মুখ বুজে হজম করা। সেই সাথে পরবর্তী এপিসোড দেখার অপেক্ষা করা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement