১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ভোটাধিকারের প্রতি মর্যাদা

-

বাংলাদেশের ‘গণ’ কিংবা ‘প্রজা’ তথা জনগণ ভোটাধিকার হারিয়েছে। ৭ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে জোরগলায় দাবি উঠেছে, ‘জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিধান করা হলে ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের ১১টি প্রদেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ প্রদেশ বাংলার জনগণও প্রথমবারের মতো তাদের প্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করে আইনসভায় পাঠানোর সুযোগ লাভ করেছিল। সেই নির্বাচনে কৃষক-প্রজা পার্টির প্রধান হিসেবে মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে প্রথমবারের মতো অখণ্ড বাংলার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন বরিশালের সন্তান, বাংলার বাঘ আবুল কাশেম ফজলুল হক। ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত ‘পাকিস্তান দাবির উপর গণভোট’ হিসেবে আখ্যায়িত নির্বাচন থেকেও অনেক চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া গেলেও তা আজকের আলোচ্য বিষয়ের বাইরে; বরং আজকে ক্ষমতাসীন অবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহারের ‘দারুণ সুযোগ’ থাকা সত্ত্বেও যারা নির্বাচনে পরাজয় মেনে নিয়েছিলেন শুধুই জনগণের ভোটাধিকারের প্রতি সম্মানবোধের জায়গা থেকে তাদের কথাই লেখা হলো। তবে, কিছুটা বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্নভাবে!
সময়টা ১৯৫৪ সাল! পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে হারাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক-শ্রমিক পার্টি, মাওলানা আতাহার আলীর নেজামে ইসলাম পার্টি, হাজী মোহাম্মদ দানেশের বামপন্থী গণতন্ত্রী পার্টি ও খেলাফতে রব্বানী পার্টিসহ গঠিত হলো যুক্তফ্রন্ট। ডান-বাম, ইসলামপন্থী-সেক্যুলার, চরমপন্থী-নরমপন্থী, পাকিস্তানপন্থী-পাকিস্তান বিরোধী দলগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে নির্বাচনে অভূতপূর্ব জনসমর্থন ও ভোট আদায়ে সক্ষম হলে ‘নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা’ পূর্ববাংলার মসনদ হারাতে হয় মুসলিম লীগকে।

নির্বাচনের স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তো ছিলই না, উপরন্তু ২৩৭টি আসনের মধ্যে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ স্বতন্ত্রসহ সর্বসাকুল্যে মাত্র ১০টি আসন পেলেও নিয়মমাফিক ও সময়মতো ক্ষমতা হস্তান্তরে কোনো ধরনের টালবাহানাও করেনি। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন তার নিজ আসনে একজন তরুণ ছাত্রলীগ নেতা খালেক নওয়াজ খানের কাছে পরাজিত হলেও রাগে-ক্ষোভে-অপমানে তাকে ‘পাকিস্তান বিরোধী’ কিংবা ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ আখ্যায়িত করে আজকালকার হাজারো তরুণের মতো তার জীবনটা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতে দেননি। অবশ্য, তার সেদিনের সেই উদারতার পুরস্কার তিনি ঠিকই পেয়েছিলেন ’৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ৩০০ আসনবিশিষ্ট পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়লাভ করলেও, বাকি দুটি আসনে স্রোতের প্রতিকূলে বিজয়ী হয়েছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজা ত্রিদিব রায় ও ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট-ঈশ্বরগঞ্জে পিডিপি চেয়ারম্যান নুরুল আমিন। অবশ্য, আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে তিনি এর ঘোর বিরোধী ছিলেন কিংবা তিনি পরে স্বাধীন বাংলাদেশ মেনে না নিয়ে স্থায়ীভাবে পাকিস্তানে চলে গিয়ে সেদেশের প্রধানমন্ত্রী ও উপ-রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত হতে পেরেছিলেন সেগুলো এখানে অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনের সম্মুখসারীর যোদ্ধা ও দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মুখ্যমন্ত্রীও যে ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনে হারতে পারে সেটাই এখানে প্রাসঙ্গিক!
সময়টা ১৯৬৫ সাল! ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মুসলিম লীগ (কনভেনশন) মনোনীত ‘গোলাপ ফুল’ মার্কার প্রার্থী ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানকে হারাতে পূর্ব পাকিস্তানে সকল বিরোধী তাদের প্রার্থী কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর অতি আদরের ছোটবোন ও শেষ জীবনের সাথি মিস ফাতেমা জিন্নাহর ‘হারিকেন’ প্রতীককে জেতাতে আবারো একজোট। মৌলিক গণতন্ত্রের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এ নির্বাচনে সর্বজনীন ভোটাধিকার না থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানের ৪০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী সদস্য ও পশ্চিম পাকিস্তানের ৪০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী সদস্য সর্বমোট ৮০ হাজার ‘বিডি মেম্বার’ ভোটার হওয়ায় সংখ্যাটি নেহাতই কম ছিল না। নির্বাচনে মিস ফাতেমা জিন্নাহ আজকালকার বাংলাদেশী রাজনীতিবিদদের মতো তার আপন বড়ভাই ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আজম জিন্নাহর প্রতি গণমানুষের আকাশচুম্বী শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আবেগকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা হাসিলের কোনো দুরভিসন্ধিও আঁটেননি। তিনি তার নিজস্ব স্বকীয়তায় ও গুণে নির্বাচন করে সম্মানজনকভাবে পরাজিত হলেও নির্বাচনী ব্যবস্থা, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা কিংবা আইয়ুব খানের ওপরেও কোনো ক্ষোভ ঝাড়েননি। এ কথা তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি যে, তার ‘বড়ভাই’-এর সৃষ্টি পাকিস্তানে দেশ শাসনের অধিকার শুধু তারই রয়েছে, বাকিরা সব দুধভাত।
সময়টা ১৯৭০ সাল! ৩০০ আসনবিশিষ্ট পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে ১৬২ আসনের অধিকাংশটিতে আওয়ামী লীগের জয়জয়কার অত্যাসন্ন জেনেও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়ার প্রশাসন জনরায় কিংবা ভোটের ফলাফল পাল্টে দেয়ার কোনো ষড়যন্ত্র করেননি। এমনকি শেখ মুজিবুর রহমানের ‘ছয় দফা’ যা তাদের ভাষায় ছিল ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ ও পাকিস্তান ধ্বংসের অপপ্রয়াস’ তা রুখতেও তারা জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেননি। অথচ শেখ মুজিব আগেই দৃঢ়প্রত্যয়ে ঘোষণা করেছিলেন যে, ‘আসন্ন নির্বাচন হবে ছয় দফার ওপর গণভোট!’
পরিশেষে, একটি কথা না বললেই নয় যে, জনগণের ভোটাধিকারের প্রতি সম্মানবোধ না থাকলে কখনোই জনমনে স্থায়ী আসন গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আর ইতিহাস থেকে শিক্ষালাভ না করলে ইতিহাসের নির্মমতায় তাকে একদিন অবশ্যই মুছে যেতে হয়! শ্রদ্ধা, ঘৃণায় পরিণত হয়। তাই, আজ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন শুধুই এদেশের জনগণের ভোটাধিকার চর্চার জন্যই নয়, বরং ক্ষমতাসীনদের অস্তিত্বের জন্যই জরুরি।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, নবাব সলিমুল্লাহ একাডেমি
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement