অর্থনৈতিক উন্নয়নে আধুনিক কারিগরি শিক্ষা
- আবুল কালাম আজাদ
- ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০৫
প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্ব এখন নতুন ধারায় ধাবমান। সারা বিশ্বের সব মানুষ পরিবেশ পরিস্থিতি ও বাস্তবতার কারণে একটুু ভিন্নমাত্রায় অন্য আমেজে দিনাতীত করছে। প্রতিযোগিতা এখন যোগ্যতা ও দক্ষতার। বুদ্ধিভিত্তিক সমাজ এখন বোরাকের গতিতে উন্নয়নের স্বপ্নে বিভোর। যে দেশ ও সমাজ যত প্রযুক্তির উন্নয়ন ও দক্ষতার পরিচয় দিতে পারছে, তারা তত বেশি উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছাতে সক্ষম। বিশেষ করে দেশের জনশক্তিকে কাজে লাগানোর নিরিখে যারা যত কৌশলী ও মানবসম্পদকে কর্মের খাতে পরিণত করতে পেরেছে, সে দেশ ও জাতি তত সার্থক।
বলা দরকার যে, কোনো দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান শর্ত হচ্ছে তার জনগণের দক্ষতা। সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির প্রধান শর্ত হচ্ছে দেশের জনগণকে গুণগত, পরিমাণগত, যথাযথ জ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার আওতায় নিয়ে এসে বিশ্ববাজারনির্ভর টেকসই দক্ষতা প্রদান করা ও অর্জনের আওতায় নিয়ে আসা। মূলতপক্ষে যুগোপযোগী, জীবনমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে বিশাল জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদে পরিণত করা ও তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলা সময়ের দাবি।
দেশের সব ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিজ্ঞানপ্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানো ও দক্ষ মানবসম্পদ রফতানি এবং কারিগরি বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আত্ম-কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথা বর্তমান শিক্ষানীতিতে সঠিকভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু তার আলোকে বাস্তব ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে দক্ষতা উন্নয়নে কর্মক্ষম করে যে ধারা থাকা দরকার, তার পরিকল্পনার আলোকে প্রয়োগ অনেকটাই কম।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি নিম্ন-মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল এবং স্থিতিশীল অর্থনীতি। এই অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে মধ্যম হারের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি (৬.২ শতাংশ), পরিব্যাপ্ত দারিদ্র্য, আয় বণ্টনের অসমতা, শ্রমশক্তির উল্লেখযোগ্য বেকারত্ব, জ্বালানি, খাদ্যশস্য এবং মূলধনী যন্ত্রপাতির জন্য আমদানিনির্ভরতা, জাতীয় অসমতার নি¤œহার, বৈদেশিক সাহায্যের ওপর ক্রমত্রাসমাননির্ভরতা এবং কৃষি খাতের সঙ্কোচনের ( ১৭.৫ শতাংশ) সাথে সাথে পরিষেবা খাতের দ্রুত প্রবৃদ্ধি (৫৩.৯ শতাংশ)। মূলত বাংলাদেশের শিক্ষা কাঠামো দুর্বল হলেও এখানে অদক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা অঢেল এবং মজুরিও সস্তা।
বিশ^ব্যাংক তাদের এক সমীক্ষায় বলেছে- ‘বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক উন্নয়নে আধুনিক কারিগরি ও প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাতে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অন্যতম বড় শক্তি-সম্ভাবনা হচ্ছে তার জনগণ।’ ইউএনডিপি, ইউনেস্কো প্রভৃতি বিশ^ সংস্থা সবাই একই সুরে বলেছে- ‘বাংলাদেশ বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করে কাজে না লাগালে জাতীয় উন্নয়নের গতিতে উৎক্রান্তি ঘটানো সম্ভব নয়। বাংলাদেশকে তার জনগণ ও শ্রমশক্তির গুণগতমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে শ্রমবাজারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আধুনিক পেশাগত কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। বস্তুত জনসংখ্যাকে অনেক দেশের জন্য জীবন্ত সম্পদ বলা হয়। এ সম্পদকে কাজে লাগিয়ে অনেক দেশ উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছে। প্রাকৃতিক সম্পদের পাশাপাশি জনসংখ্যাকে জনসম্পদে, অন্যকথায় মানব পুঁজিতে পরিণত করার মহাপরিকল্পনা নিয়ে জনবহুল দেশগুলো এগিয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে একটি ইতিবাচক ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যে দেশ এ কাজটি সফলতার সাথে সুসম্পন্ন করতে পারে সে দেশ তত দ্রুত উন্নতির দিকে ধাবিত হয়। জনসংখ্যার তত্ত্বে ন্যূনতম নির্ভরশীলতার অনুপাত বা lest dependency ratio বলতে একটি কথা আছে। যখন কোনো দেশ এই ন্যূনতম নির্ভরতার অনুপাতে চলে যায়, তখন ওই দেশটির জনসংখ্যাতে কর্মক্ষম জনসংখ্যার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকে। এই কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে কাজে লাগানোর উপায় হলো তাদের শিক্ষা ও দক্ষতায় সমৃদ্ধ করে তোলা। ফলে দেশের উন্নয়নের সব কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়ার মতো দক্ষ মানুষের অভাব হয় না।
কর্মমুখী শিক্ষার অভাবে শ্রমশক্তির কর্মদক্ষতা কম উৎপাদনশীলতার ফাঁদ থেকে বাংলাদেশকে বের হতে হলে গতিশীল ও পরিবর্তনশীল শ্রমবাজারের কথা চিন্তা করে চাকরিদাতা ও সরকারকে আগে শিক্ষা বিভাগের দিকে নজর দিতে হবে।
ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) ইউকে ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্ট্যারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ও নরওয়ে সরকারের সহযোগিতায় সাম্প্রতিক এক গবেষণার তথ্যনুযায়ী দেশে ৫০ হাজার অতি ছোট এবং ১০ হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি আয়তনের হালকা প্রকৌশল শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ। বাংলাদেশে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অন্য এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী এই শিল্প কারখানার সংখ্যা ৪০ হাজার আর কর্মরত শ্রমিক আট লাখ। এসব শিল্পে প্রায় তিন হাজার ৮০০ রকমের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ে তিতাস বাখরাবাদ, জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানি, চিনি ও খাদ্যশিল্প সংস্থা, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ, বন্দর কর্তৃপক্ষ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর, সিভিল-এভিয়েশন, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন, বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি ছাড়াও মেরামতের ৮০ শতাংশ কাজই করছেন এ শিল্পের উদ্যোক্তারা। অথচ অদক্ষ অর্ধশিক্ষিত কারিগর দ্বারা তৈরি হচ্ছে এসব মূল্যবান যন্ত্রাংশ। এ ক্ষেত্রে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। নতুন যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে গড়ে ৮০ শতাংশের ওপর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মূল্য সংযোজন হাজার হাজার গুণেরও বেশি। উৎপাদন ও মেরামত যোগ করলে এ খাতের বার্ষিক টার্নওভারের পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট এসব ক্ষেত্রে যেসব প্রতিষ্ঠানে রয়েছে শিল্প ও মাঝারি খাত। তার মধ্যে সমাজসেবা অধিদফতর, যুব উন্নয়ন অধিদফতর, মহিলাবিষয়ক অধিদফতর, জাতীয় মহিলা সংস্থা, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন, পল্লীকর্ম সহায়ক, কর্মসংস্থান ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড, বন অধিদফতরসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতে উৎপাদন বিপণন বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সত্যি বলতে এ সেক্টরে দক্ষ জনবল সৃষ্টির গুরুত্ব না থাকায় এসএমই খাতে দক্ষ জনবলের অভাব থেকেই যায়। মূলত দরকার ছিল সংশ্লিষ্ট সেক্টরে কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি ও দক্ষতাসম্পন্ন জনশক্তি তৈরির সে উদ্যোগ থাকা দরকার ছিল। এটিই হলো আমাদের দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ব্যক্তিদের অবস্থা।
অন্য দিকে, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ পোশাক তৈরি ও রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমাদের দেশে এ শিল্পে ২২ লাখেরও বেশি শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। যার মধ্যে ৮০ শতাংশ নারীশ্রমিক। আমাদের সবার জানা তৈরী পোশাক থেকে রফতানি আয় আমাদের মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৭৬ শতাংশ এবং প্রতি বছর এ থেকে আয় প্রায় ৩০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ শিল্পের শ্রমিকদের বিদেশেও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে এ সেক্টরে শ্রমিক তৈরির জন্য কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের উদ্যোগ সামান্যই। সুতরাং হালকা প্রকৌশল ও এসএমই খাতে কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ জনবল সরবরাহ করার নিমিত্তে আনুষ্ঠানিক কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা বা কর্মমুখী শিক্ষা-প্রশিক্ষণের পাশাপাশি উপানুষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে বিস্তৃত করার প্রয়োজনটা অতি বেশি। সে জায়গায় বাংলাদেশ শুধু পিছিয়ে নয় অনেকদূর পিছিয়ে। যার ফলে এ দেশের তরুণদের নানামুখী সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশের দক্ষ শ্রমিকদের বেশি টাকা পারিশ্রমিক দিয়ে বাংলাদেশের কলকারখানা পরিচালনার জন্য তাদের সহযোগিতা নেয়া ও কর্মস্থলের সুবিধা দিতে হচ্ছে। তাতে এ দেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে।
আমাদের দেশের যোগাযোগ, অবকাঠামো বা উন্নয়নের কথা বলে অসংখ্য বিদেশী এখন নিজেদের কর্মক্ষেত্র তৈরি করে গিয়েছেন, ইদানীং কিছু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে সাদা চামড়ার শিক্ষকদের নিয়োগ দিয়ে অভিভাবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ ও নিজেদের ব্র্যান্ডিং করছে কর্তৃপক্ষ।
বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সময়োপযোগী ও চাহিদার বিপরীতে শিক্ষা কারিকুলাম চলমান থাকায় মেধাবী তরুণরা লক্ষ্যচ্যুত হচ্ছে। এ ব্যাপারে টেকসই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেয়া দরকার। সম্ভাবনাময় বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার যে গতিশীলতা লক্ষ করা যাচ্ছে, তা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হওয়া এবং তুলনামূলকভাবে আরো আধুনিকীকরণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও কারিগরি বোর্ডের বিশেষ ভূমিকা থাকা দরকার।
লেখক : কলেজ অধ্যক্ষ, গবেষক ও কলামিস্ট
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা