০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ৩০ জিলহজ ১৪৪৫
`

‘সে কথা না হয় নাই বললাম’

-

মাত্র কিছুকাল আগে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান মুখপাত্র ড. আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতোই ঘনিষ্ঠ। আমরা একে শ্লীলতা-অশ্লীলতার দিক নিয়ে কোনো কথা না হয় নাই বললাম। কিন্তু তার পরও এ থেকে কী বার্তা দেশবাসী পেল এবং আমাদের বিদেশী সুহৃদরা কী বার্তা গ্রহণ করল? বিশেষ করে সরকারের সাথে চীনের যে দহরম-মহরম তারাইবা বিষয়টি কিভাবে গ্রহণ করেছে; তাও ভেবে দেখা জরুরি। আমরা জানি, ভারত আর চীনের সম্পর্কটা সাপে-নেউলের মতো। এখানে ভারসাম্য বজায় রাখা খুব সহজ নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্য আমাদের বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো চিড় ধরবে কি না, সেটাইবা বলবে কে? ভারসাম্য থাকবে কি? রাষ্ট্রের খুব গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কথা বলতে হাজারবার ভেবে নেয়াটাই উচিত বলে বিজ্ঞজন মনে করেন। তার বক্তব্যটি অবশ্য দেশের মানুষ যে ভালোভাবে নেয়নি, বলাই বাহুল্য। ভারত বাংলাদেশের বন্ধুত্ব কামনা করে বটে কিন্তু একতরফা ভালোবাসা সবসময়ই ক্ষণস্থায়ী হয়ে থাকে। স্থায়ী হয় না।

এরপর কিছু দিন যেতে না যেতেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্দেশ করে বললেন, আপনারা অনেক পরামর্শ দেন, আমাদের কাজে বাধা সৃষ্টি করেন। কিন্তু আপনাদের কথা তখনই শুনব যখন চীনের মতো আপনারা টাকা নিয়ে আসবেন। তার এমন স্পর্শকাতর দুই বক্তব্যকে পাশাপাশি রেখে বিবেচনায় নিলে খুব সহজভাবে বলা যায়, এ চৌকস কোনো কূটনীতিকের কৌশলী কথা বলে মনে করার কারণ নেই। অথচ তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কূটনীতিক। কূটনীতিকদের কথাবার্তা ইদানীং দেশের মানুষ হরহামেশাই শুনছে। ভিন্ন দেশের দ্বিতীয় স্তরের কূটনীতিকদের কথা যে কৌশলনির্ভর এবং কত টক তির্যক বক্তব্যও যে যেভাবে সুগার কোটিং মাখিয়ে বলেন, তা থেকেও কি আমরা বুঝতে ও শিখতে পারছি! মাঠে বক্তব্য আর কূটনীতির ভাষার মধ্যে কত আকাশ পাতাল ফারাক হবার, সেটাও আমাদের মন্ত্রী মহোদয় হয়তো বুঝতেই পারছেন না। মাঠে ঘাটে মন্ত্রীরা বলে বেড়াচ্ছেন এটি মাথায় ঢেলে দেয়া, ওটা হজম করে ফেলব, বুড়িগঙ্গায় ডুবাব। এমন মাঠের বক্তব্যের সাথে দেশের প্রধান কূটনীতিকের তফাত এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যাক কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে শেষ কথাটা এভাবে শেষ করতে চাই। সরকারের সব পর্যায়ে সক্ষমতা, যোগ্য ব্যক্তিদের ঘাটতির যে কথা শুনি, তা হয়তো একেবারেই অমূলক নয়। তা ছাড়া সাম্প্রতিককালে সেটা আরো প্রকটভাবে সর্বত্র সমালোচিত হচ্ছে। বাংলাদেশ শুধু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয় নয়, অন্যান্য বিষয়ে যে দেউলিয়াত্বের স্তরে পৌঁছে, তার সাথে যুক্ত রয়েছে আমাদের পররাষ্ট্রবিষয়ক যত অক্ষমতা।

তবে এটি ঠিক ড. মোমেন অবশ্যই খুব সত্য একটা কথা বলে ফেলেছেন। সেটি হলো, চীন বাংলাদেশকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিচ্ছে। কেউ যেন আবার ভুল বুঝবেন না যে, চীন এ দেশে প্রচুর টাকা অনুদান হিসেবে দিচ্ছে। না, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। চীন বাংলাদেশকে যে অর্থ দিচ্ছে, তার ষোলোআনাই কঠিন শর্তে ও উচ্চ হারের সুদে। ভাবটা এমন, ফেলো টাকা নেও কড়ি, আমি কি তোমার পর গো? মনে রাখা দরকার, এমন ঋণ দেয়ার পর বাংলাদেশকে চীন না আবার আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। তাহলে কিন্তু বড় বিপদ হতে পারে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, স্বাধীনতার পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের কয়েকটি গণতান্ত্রিক দেশ বাংলাদেশকে এ পর্যন্ত বিপুল পরিমাণের অর্থ অনুদান দিয়েছে। চীন রাশিয়া এই দুই দেশ থেকে উল্লেখ করার মতো কোনো অনুদান একেবারেই আসেনি। তারা কেবলই উচ্চ সুদসহ কঠিন শর্তে ঋণ দিয়েছে। শুধু উচ্চ মাত্রার সুদ নেয়া নয়, সেই সাথে কঠিন শর্ত দিয়ে থাকে। এসব শর্ত মাঝে মধ্যেই অনেক দেশের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্দেশ করে যে কথা বলেছেন, আপনারা চীনের মতো অর্থ নিয়ে আসুন, তাহলে আপনাদের কথা শুনব, এমন উক্তি পূর্বেই স্মরণ করা হয়েছে। তবে তার কথার সুরটা এমন যে, চীনই শুধু আমাদের প্রচুর অর্থ অনুদান হিসেবে দিয়েছে, এটি ঠিক নয়। চীন ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ২১৯১ মিলিয়ন ডলার কেবল ঋণ দিয়েছে। এ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের উইলিয়াম অ্যান্ড ম্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক গবেষণা ল্যাব এইডডাটার সর্বশেষ গবেষণায় বাংলাদেশে চীনা ঋণের একটি চিত্র তুলে ধরেছে। প্রতিষ্ঠান হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকারের চলতি মেয়াদে গ্রহণকৃত ঋণের পরিমাণ আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।

বাংলাদেশে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে চীনের কয়েকটি ব্যাংক থেকে সবচেয়ে বড় ঋণ সহায়তা প্রকল্পের জন্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ২০২১ সালে ডলারের দর অনুযায়ী, পরিবহন ও সংরক্ষণাগার খাতের প্রকল্পের জন্য ২ দশমিক ৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ গ্রহণ করেছে। এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ঋণ নিয়েছে ২ দশমিক ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় সক্ষমতা বৃদ্ধি ও শক্তিশালীকরণের জন্য চীনের উপরোল্লিখিত ব্যাংক থেকে ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ের জন্য চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ঋণ নিয়েছে ১ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট পুটখালী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বাংলাদেশ চীনের এক্সিম ব্যাংক ও চীনা ডেভেলপমেন্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ০ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার ঋণ গ্রহণ করেছে।

উচ্চ সুদে চীন থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে চলেছে সরকার। এই ঋণ দেশের ‘উন্নয়নে’ ব্যয় হবে। তবে অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, চীনের ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশের বড় বিপদ সৃষ্টি হতে পারে। কারণ চীন থেকে নেয়া ঋণের সুদ শোধ করতে হয় সার্ভিস চার্জসহ ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ হারে। পাশাপাশি প্রকল্পের যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য পণ্য চীন থেকেই আমদানি করতে হবে। এ ছাড়া চুক্তি কার্যকরের এক মাসের মাথায় পরিশোধ করতে হবে সুদ আসল। চুক্তির ব্যবস্থাপনা ও প্রতিশ্রুতি ‘ফি’সহ এ অবস্থায় ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি যথাসময়ে প্রকল্পগুলো শেষ হওয়া নিয়েও সংশয় থাকবে। এতে করে বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাড়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। প্রতিটি চীনা ঋণে থাকে এ ধরনের বাধ্যবাধকতা। চীনা ঋণের যে মুদ্রাটার কথা বলা হলো, সেটা একটা পিঠ। সে মুদ্রার আরো একটা পিঠ রয়েছে। সেই পিঠ নিয়ে আলোচনা করা এ মুহূর্তে বিপজ্জনক ও স্পর্শকাতর। কখনো সময় এলে কেউ না কেউ সে কথা তুলবেই। তখন কিন্তু ঋণদাতা ও ঋণ গ্রহণকারীদের কেউ আর স্বস্তি অনুভব করতে নাও পারেন। এখন না হয়, এতটুকুতেই ক্ষ্যান্ত থাকি। তাকিয়ে থাকি ভবিষ্যতের দিকে।

সর্বশেষে ঢাকায় দায়িত্ব পালনরত চীনা রাষ্ট্রদূতের একটি বক্তব্য সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়। তাতে দুটো বিষয় কিন্তু খুব পরিষ্কার ও স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে। চীনা রাষ্ট্রদূত বলেছেন, বাংলাদেশ যে মারাত্মক রিজার্ভ সঙ্কটে পড়েছে, সে সঙ্কট উত্তরণে চীন বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করতে প্রস্তুত। প্রথম কথা হচ্ছে, সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে বলা হচ্ছে, রিজার্ভ নিয়ে সঙ্কট নেই। ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত অবশ্যই এটি নিশ্চিতভাবে জেনেই রিজার্ভ নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্কটের কথা বলেছেন। তাহলে রিজার্ভ পরিস্থিতি দিবালোকের মতো স্বচ্ছ নয়। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ সরকার রিজার্ভ সহায়তা দেয়ার অর্থ, কয়েক শ’ কোটি টাকা নয়, হাজার কোটি বিলিয়ন ডলারের নিচে হবার নয়। এটি কি চীনের নিছক বন্ধুকে সহায়তা দেয়া? সেটা কোনোক্রমেই নয়। কঠিন শর্ত ও উচ্চ সুদেই তারা রিজার্ভ সহায়তা দেবে। চীনারা ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে ঋণদানের ষোলো মজাটা পেয়ে গেছে। চীন বুঝেছে, বাংলাদেশের মানুষের রক্তের স্বাদ খুবই সুমিষ্ট।

যাই হোক, চীনা ঋণ তো আছেই। এখন নানা দেশ ও সংস্থা থেকে ঋণ নেয়ার যে হিড়িক পড়েছে, সেটি কার অভাব পূরণ করবে, রাষ্ট্রের না সরকারের, সে প্রশ্ন না হয় নাই করি। এ নিয়ে কোনো বিতর্ক করার দরকার নেই যে, জাতীয় অর্থনীতি এখন মারাত্মক বিপদে নিপতিত। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ কিংবা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে এখনো ‘সফট লোন পাওয়া গেলেও আমরা আগ-পাছ বিচার না করে নিতে উৎসাহ-আগ্রহের শেষ থাকে না। কিন্তু আমাদের বৈদেশিক ঋণের বেশির ভাগটা সাপ্লায়র্স ক্রেডিটের। এ ঋণের অসুবিধা হলো, জোগানদাতারা প্রকল্পের প্লান্ট, যন্ত্রপাতি ও সব সরঞ্জাম ঋণ হিসেবে দেয়া হয়; প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে অনেক বেশি দাম ধরে ঋণের পরিণাম বাড়িয়ে থাকে। সবাই জানেন, দেশের অর্থনীতি ভয়াবহ সঙ্কটের দিকে দ্রুত বেগে ছুটেছে। কোথাও কোনো আলোর সন্ধান নেই। অবস্থাটা আরো খারাপের দিকে যে চলছে, মাত্র দুই লাইন আগেই বলা হয়েছে। এর অন্যতম কারণ সরকারের একগুঁয়েমি।
সরকার বলছে, তারা আমজনতার কল্যাণে সব কিছুই করতে চায়। জনগণের উন্নয়নের জন্য তারা নিবেদিত। তবে কেন এ জিনিসটা তারা চাইছে না, যেটা এ মুহূর্তে সারা দেশের মানুষ চায়। সেটা হলো একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান। এ দাবিতে সমগ্র দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ একাট্টা। তবে কেন এ দাবির প্রতি তাদের এত অনীহা? তারা যদি ভালো কাজ করেই থাকেন, তবে ভয় পাওয়ার প্রশ্ন আসে না। সরকার এমন সাহস দেখায় না কেন। একবার তারা দূর থেকে দেখুক না, নিজেদের জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটার কোন পর্যায়ে আছে।
ndigantababar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement