২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ছিন্নমূল বিএনপির আত্মকথা

সমকালীন প্রসঙ্গ
-


আমি এখনো পৃথিবীতে আসিনি, তবে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ সুবে বাংলার এক মহা ধুরন্ধরের মস্তিষ্কে আমার জন্ম হয়ে গেছে এবং তার মস্তিষ্কের ঘিলু খেয়ে আমি সেভাবে বেড়ে উঠছি তার কিছু চমকপ্রদ কাহিনী আজ আপনাদের শোনাব। আমার চিন্তা-চেতনা-স্বভাব-চরিত্র-ইচ্ছা-অনিচ্ছা ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের জন্য আমার জন্মের সূতিকাগার মস্তিষ্কের মানুষটি সম্পর্কে কিছু বলা আবশ্যক। যদিও আমি তাকে মানসপিতা হিসেবে মান্যগণ্য করি কিন্তু বাহ্যত লোকটির স্বভাব- শয়তানি বুদ্ধি এবং লোভ-লালসার বহর দেখে বারবার চিন্তা করি- ইস! যদি আমার মৃত্যু মস্তিষ্কের মধ্যেই হতো এবং কোনোমতে যদি আমার মানসপিতা-মাতার সম্ভাব্য প্রসব ঠেকানো যেত তাহলে এই পৃথিবীর আলো-বাতাসে আমার জন্মের কলঙ্কজনক অধ্যায়ের কম্পন সৃষ্টি হতো না।

উল্লিখিত বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে আমার মানসপিতা-মাতা সম্পর্কে কিছু বলে নেই। আমি যার মস্তিষ্কে বেড়ে উঠছি সে মূলত মৎস্য চরিত্রের মানুষ। অর্র্থাৎ উভয় লিঙ্গের প্রাণী। সুতরাং গর্ভ ধারণ ও প্রসবের জন্য তার কর্মকাণ্ড মাছদের মতোই স্বাধীন, অর্থাৎ তাকে বিপরীত লিঙ্গের কোনো সাহায্য নিতে হয় না বরং এই কারণেই সে একই সাথে আমার পিতা ও মাতাও বটে। আপনারা যারা জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, পিতা-মাতার স্বভাব-চরিত্র অনুযায়ী সন্তানরা বেড়ে ওঠে এবং দুনিয়ার বুকে ভালো-মন্দ কাজ কর্ম করে বেড়ায়। আমার পিতা-মাতা যেহেতু বদের হাড্ডি সেহেতু আমার চরিত্র কেমন হবে তা নিয়ে নিশ্চয়ই আপনাদের বিস্তারিত বলার দরকার নেই। আমার পিতা-মাতার মনে আমাকে জন্ম দেয়ার লোভ কিভাবে এলো এবং আমাকে প্রসব করার জন্য লোকটি যে ফন্দি-ফিকির করছে তা শুনলে আপনাদের কাছে আরব্য রজনীর কাহিনীর মতোই রোমাঞ্চকর বলে মনে হবে।

আমি যার কথা বলছি সে বাংলাদেশের রাজনীতির একজন পাকা খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিত। অতিরিক্ত লোভ-চরিত্রহীনতা এবং শয়তানি বুদ্ধির কারণে লোকটি কোনো দিন কাক্সিক্ষত মাকামে পৌঁছতে পারেনি। অথচ রাজনীতির হোমরা-চোমরা এবং মন্ত্রী-এমপি হওয়ার জন্য সে করেনি এমন কুকর্ম নেই। কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতি কোনো কালেই তাকে সহযোগিতা করেনি। ফলে এক বস্তা শয়তানি বুদ্ধি, অসুরের মতো শক্তিসম্পন্ন একটি দেহ এবং অঢেল অর্থ-কড়ি ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও লোকটি বারবার হেরে গেছে। অথচ তার নিকট সব সময়ই মনে হয় যে- বুদ্ধিশুদ্ধিতে সে হাসিনা-খালেদার চেয়েও চালাক। আর মির্জা ফখরুল-ওবায়দুল কাদেরের যোগ্যতাকে সে কোনো কালেই পাত্তা দেয়নি। একরাশ অহঙ্কার-সীমাহীন লোভ এবং শয়তানি বুদ্ধির বিরাট এক বোঝা মাথায় চাপিয়ে সে কেবল অপেক্ষা করছিল কবে নাগাদ তার জীবনে একটি সুযোগ আসবে।
বাংলাদেশে যেদিন তৃণমূল বিএনপির নতুন অভিষেক হলো সেই রাতে আমার মানসপিতা মনের আনন্দে একটুও ঘুমালেন না। তিনি চিন্তা করতে থাকলেন এবং হঠাৎ আবিষ্কার করে বসলেন যেহেতু সরকারি মদদে তৃণমূল বিএনপি নামক একটি রাজকীয় বিরোধী দলের জন্ম হয়েছে, সেহেতু অনাগত দিনে ছিন্নমূল বিএনপি, কাঙাল বিএনপি, বাঙাল বিএনপি, খোকা বাবুর বিএনপি, বুজি বুয়ার বিএনপি, মামা-ভাগিনার বিএনপি ইত্যাদি নামে সরকারি বর্জ্য ভোগী অনেক নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। সুতরাং সময় ও সুযোগ কাজে লাগিয়ে যদি ছিন্নমূল বিএনপি নামক একটি দল অবিলম্বে তৈরি করা যায় তাহলে উন্নয়নের রাজভোগ, লুটপাটের মোহন ভোগ এবং অর্থ পাচারের রসমালাই খেয়ে বাকি জীবন দেশ-বিদেশে আনন্দ ফুর্তি করে কাটানো যাবে। সুতরাং তিনি কালবিলম্ব না করে তার মস্তিষ্কে আমার জন্ম দিয়ে ফেললেন এবং চিন্তা-চেতনা দ্বারা আমাকে কিভাবে তিনি লালনপালন করে চলেছেন তার কিছু নমুনা আপনাদের না বলে পারছি না। ছিন্নমূল বিএনপিকে একটি অতি উৎকৃষ্ট মানের গৃহপালিত বিরোধী দল হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আমার মানসপিতা নিজের ঘুম হারাম করে বাংলাদেশের সকল সফল ও অসফল গৃহপালিত বিরোধী দলের হোমরা-চোমরা, সরকারি দালাল-তাঁবেদার বুদ্ধিজীবী, ধড়িবাজ ও ভণ্ড রাজনীতিবিদদের জীবনী পাঠ আরম্ভ করে দিয়েছেন এবং এ যাবৎকালে অন্তত হাজার খানেক লোকের জীবনী মুখস্থ করে ফেলেছেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে তিনি সেই এক হাজার জন গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতাদের মধ্য থেকে অশ্বমেধযজ্ঞের মাধ্যমে ১০ জন শীর্ষ নেতাকে মনোনীত করবেন। এই জন্য ইতোমধ্যে ভারতীয় ঘোড়া, চাইনিজ মহিষ এবং দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিশেষ একটি এলাকা থেকে বিশেষ জাতের ভেড়া সংগ্রহ করেছেন।

অশ্বমেধযজ্ঞের পর তিনি সৌভাগ্যবান ১০ শীর্ষ গৃহপালিত নেতার ভাস্কর্য বানাবেন এবং সেই নেতাদের বাড়িঘর রেকি করবেন। সেই নেতারা কী খায় এবং তাদের বর্জ্যে কী কী উপাদান থাকে তা জানার জন্য তাদের বাবুর্চি এবং তাদের মলমূত্র পরীক্ষা করেছেন এমন ডাক্তারদের সাক্ষাৎকার নেবেন। তাদের পিতা-মাতা জীবিত থাকলে সেইসব গর্বিত পিতা-মাতাকে সালাম করবেন এবং তারা যদি মরে গিয়ে থাকেন তবে তাদের কবর অথবা শ্মশানে গিয়ে আধ্যাত্মিকভাবে ভাববিনিময়ের চেষ্টা করবেন। শীর্ষ দশ গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের ফেলে দেয়া পায়জামা-পাঞ্জাবি, শাড়ি-পেটিকোটসহ অন্তর্বাসগুলো সংগ্রহ করবেন এবং এক সপ্তাহ ধরে সেগুলোর ঘ্রাণ নিয়ে সেইসব প্রাণীর গন্ধ ও দুর্গন্ধ আত্মস্থ করার চেষ্টা করবেন।

আমার মানসপিতা উল্লিখিত শীর্ষ ১০ গৃহপালিত নেতাকে তার মানসপিতারূপে গ্রহণ করার জন্য বিশেষ এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন সেখানে সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর হোমরা-চোমরা-বুদ্ধিদাতা-ঝাড়ুদার-পিয়ন-আর্দালি ও নাপিত বা ক্ষৌরকারকে নিমন্ত্রণ করে সবার সামনে আকাশ বাতাস-চন্দ্র-সূর্যকে সাক্ষী রেখে ওদেরকে পিতা হিসেবে ঘোষণা দিবেন এবং সেই ১০ পিতার চেয়েও অধিকতর সফলতার সাথে গৃহপালিত বিরোধী দল হওয়ার প্রত্যয় নিয়ে শপথ নিবেন। তারপর যার গৃহপালিত হবেন তার বাড়ির সিংহ দরজায় গিয়ে সাক্ষাৎ প্রার্থী হবেন।
ছিন্নমূল বিএনপির ভবিষ্যৎ জনকের চিন্তাচেতনা ও কর্মের যে ফিরিস্তি এতক্ষণ দিলাম তা কেবল তার চরিত্র-লোভ-লালসার ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তার আসল রূপ নিয়ে যদি কিছু বলি তবে দুর্গন্ধে পত্রিকার পাতা নষ্ট হবে, বাতাস ভারী হয়ে যাবে। আকাশ বজ্রপাত শুরু করে দেবে- জমিন ক্রোধান্বিত হয়ে ফেটে যাবে এবং সেই ফাটল দিয়ে ভূ-অভ্যন্তরের গরলগুলো বের হয়ে যাবে। আমার মানসপিতার কুচিন্তার কবলে পড়লে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের কী হবে বলতে পারব না, তবে রাজপথের সত্যিকার লড়াকু বিরোধী দলের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা-গুম খুন যে বেড়ে যাবে তা দিব্যি করে বলতে পারি আর এই জন্যই আশা করছি আমার জন্ম যেন আমার মানসপিতার মস্তিষ্কের মধ্যেই অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যায়।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

 

 


আরো সংবাদ



premium cement