২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

খেলাপি ঋণ রোধে দরকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার

-

খেলাপি ঋণ এখন ব্যাংকিং খাতের গলার কাঁটা। নানা অনিয়ম জেঁকে বসেছে ব্যাংকিং খাতে এবং এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ এ খাতটির ভিত্তি ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। মূলত অনিয়ম, জালিয়াতি, প্রতারণা, ঋণ মঞ্জুরে রাজনৈতিক প্রভাব, খেলাপিদের রাজনৈতিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, সুশাসনের অভাব, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ শিথিলতা ইত্যাদি বহু কারণে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ কারণে খেলাপি ঋণের স্ফীত আকার দেশের ব্যাংক খাত, ব্যবসায়-বাণিজ্য অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের হুমকি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ সময়ে ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে। আর গত এক বছরে এপ্রিল ২০২২ থেকে মার্চ ২০২৩ পর্যন্ত সময়ে ১৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এ বছরের মার্চের শেষে দেশে ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণ ছিল ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা এবং এর মধ্যে খেলাপি ঋণ এক লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা অর্থাৎ এখন ব্যাংক ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশই খেলাপি। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ, যা দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতের জন্য উদ্বেগজনক।
গণমাধ্যমে প্রকাশ, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হারে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ এবং এ হার ৮.৮০ শতাংশ। শীর্ষে রয়েছে শ্রীলঙ্কা এবং এ হার দেশটির মোট ঋণের প্রায় ১১ শতাংশ। সবচেয়ে কম খেলাপি ঋণের দেশ নেপালে এবং এ হার ২ শতাংশের কম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের আঞ্চলিক অর্থনৈতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চ আমদানি ব্যয়, ঋণগ্রহীতাদের নিয়মিত ঋণ পরিশোধ না করা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বল তদারকি ব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। খেলাপি ঋণের তথ্য বিশ্লেষণ জানা যায়, গত ১৩ বছরে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ছয়গুণের বেশি।
২০০৯ সালে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের আকার প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। তবে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাবে এই পরিমাণ প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। কারণ সন্দেহজনক ঋণ, আদালতের আদেশে খেলাপি স্থগিতাদেশ থাকা ঋণ, পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণকেও তারা খেলাপি হিসেবে বিবেচনা করছে। তা ছাড়া, বর্তমানে দেশের আদালতগুলোতেই খেলাপি ঋণের প্রায় পৌনে এক লাখ মামলা ঝুলে রয়েছে , যাতে এক লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা আটকে রয়েছে।

আসলে যারা বড় বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপি হয়েছে, তাদের কখনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে বলে শোনা যায়নি। যারা এর সাথে জড়িত থাকে, তাদের বিরুদ্ধেও বাংলাদেশ ব্যাংককে খুব কড়া ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। ফলে খেলাপি ঋণ নিয়ে কারো মধ্যে কোনো ভয় বা শঙ্কা কাজ করে না। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ঋণের ২ শতাংশ কিস্তি দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত রাখার সুযোগ করে দেয়া হয়। সেই নিয়মে ঋণ পরিশোধের জন্য ১০ বছর সময় দেয়া হয়, যার প্রথম বছরে কোনো কিস্তি দিতে হবে না। কিন্তু এ ধরনের রাজনৈতিক সুবিধা দেয়ার পরও খেলাপি ঋণ কমার বদলে বরং আরো বেড়েছে। কারণ হিসেবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এ ক্ষেত্রে একটি বড় বিষয়।
বড় বড় ঋণগ্রহীতাদের প্রায় সবার সাথে রাজনৈতিক মহলের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকে এবং সরকারও এদের কাছ থেকে নানা সুবিধা গ্রহণ করে। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও ইচ্ছা থাকলেও সঙ্গত কারণেই এদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে না। এমনকি এ ক্ষেত্রে অনেক সময় ঋণখেলাপিদের সুবিধা দিতে ব্যাংকিং আইন সংশোধন করে ছাড় দেয়ার উদাহরণও রয়েছে। এরকম অনিয়মে ঋণ বিতরণের সীমা টেনে দেয়া, নতুন শাখা খোলা বন্ধ, পরিচালনা পর্যদ ভেঙে দেয়া কিংবা পরিচালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রচুর ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু ঋণ নিয়ে বড় বড় অনিয়মের পরও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এক প্রকার নীরব থাকতে দেখা যায়।
বিবিসির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভিয়েতনাম, চীন, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো অনেক দেশেই আইনের শক্ত প্রয়োগের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ অনেক কমিয়ে এনেছে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা যে একটি বড় বিষয় সেটি অনস্বীকার্য। জানা গেছে, চীন ও ভিয়েতনামে ঋণখেলাপি ও অর্থ আত্মসাৎকারীদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। ঋণখেলাপি হলে তারা বিমান বা রেলের টিকিট কিনতে পারে না, ক্রেডিট কার্ডও ব্যবহার করতে পারে না। সিঙ্গাপুরে ঋণখেলাপির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাত বছরের জেল ও জরিমানার বিধান রয়েছে। একই রকম আইন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায়।

সেসব দেশে ঋণ পরিশোধে দেউলিয়া ঘোষিত হলে তিনি আর কোনো আর্থিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারে না বা বাড়ি কিনতে পারে না, সম্পদের মালিকও হতে পারে না। এরকম অভিযোগে সংযুক্ত আরব আমিরাতে সমস্ত সম্পদ জব্দ করা হয়। সে ঋণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত আর কোনো সম্পদের মালিক হতে পারে না। দক্ষিণ কোরিয়ায় এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা খেলাপি ঋণ অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির ব্যবস্থা করে দেয় এবং এসব ঋণ অনেক সময় শেয়ারে রূপান্তর করার মাধ্যমে কোম্পানির মালিকানায় পরিবর্তন আনা হয়। বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ কমাতে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও এর জন্য যে ধরনের দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন, তার ঘাটতি রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকিং খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং আইনজীবীরা বলছেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে বাংলাদেশে কিছু আইন থাকলেও এর যথাযথ প্রয়োগের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। অন্য দিকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দৃঢ় অঙ্গীকারের অভাবে ব্যাংকিং খাতে খেলাপিদের বিরুদ্ধে কখনোই খুব কঠোর ব্যবস্থা তো নেয়া হয়নি; বরং তারা বরাবর নানা রকমের সুবিধা পেয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মুষ্টিমেয় কিছু অসাধু কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক দুষ্টচক্রের দাপট ও আধিপত্যের কারণে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি খেলাপি ঋণের প্রসার ঘটায়। মিথ্যা তথ্য ও জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেয়ার পর তা খেলাপিতে পরিণত করার প্রবণতা শুরুতেই যদি ব্যাংকগুলো রোধ করতে পারত, তাহলে ঝুঁঁকি এড়ানোর পথ থাকত।
এ জন্য জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। জবাবদিহি-দায়বদ্ধতা অভাবে সোনালী ব্যাংক, জনতা, বেসিক ব্যাংকসহ আরো কিছু ব্যাংকের বড় ধরনের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। আমাদের সমাজে বস্তুত ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করার প্রবণতা এক ধরনের অপসংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। খেলাপি ঋণের বিস্তার ব্যাংকগুলোর ভিত্তিকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করছে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার অসব অপসংস্কৃতি রোধের জন্য অপরিহার্য।

এ জন্য ব্যাংকগুলোর ওপর তদারকি ও নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে কালক্ষেপণ না করে কঠোর আইন প্রণয়নের বিষয়টি ভাবতে হবে। একই সাথে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা না গেলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়তেই থাকবে এবং তা ভবিষ্যতে আরো গভীর সঙ্কট সৃষ্টি করবে।
মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার পাশাপাশি সুশাসনের প্রভাব ব্যাংক খাতের অন্যতম প্রধান সমস্যা। খেলাপি ঋণের মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে যুগোপযোগী আইন যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন বিশেষ বেঞ্চ গঠনের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা। শুধু অর্থঋণ আদালতে এসব মামলার নিষ্পত্তি সময়মতো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। খেলাপি ঋণ নিয়ে বহু আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে কিন্তু কাজের কাজ কতটা কী হয়েছে, সেটি একটি প্রশ্নের বিষয়। সরকারের উচিত রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমে জনগণের গচ্ছিত আমানতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ব্যাংক খাতকে আমাদের রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করা।

অনেকেরই স্মরণে আছে, কিছু দিন আগে প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) ব্যাপক অনিয়ম ও ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটিয়ে ভারতে পালিয়ে যায়। ভারত সরকার তাকে গ্রেফতার করে এবং বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন তার গ্রেফতারে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিল। অথচ দেশে থাকা অবস্থায় দুদক তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি এবং তাকে গ্রেফতারের সদিচ্ছাও দেখায়নি। তা ছাড়া বিস্ময়ের ব্যাপার, প্রশান্ত কুমার হালদারের চেয়েও বড় ব্যাংক কেলেঙ্কারির হোতা বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু। অভিযোগ আছে, বেসিক ব্যাংকের অন্তত চার হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় দুদক দায়ের করা ৫৬ মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। আবদুল হাই বাচ্চুকে গ্রেফতার তো দূরের কথা, তার বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত আট-নয় বছরেও শেষ করতে পারেনি দুদক। এ থেকেই বোঝা যায়, দুদক আবদুল হাই বাচ্চুর মামলা নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়। এক অদৃশ্য কারণে আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে মামলা থমকে আছে!
শুধু বেসিক ব্যাংকের আবদুল হাই বাচ্চু নয়, এ রকম জনতা ব্যাংকের অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট ও থারমেক্স গ্রুপের দুর্নীতি, সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের অর্থ লোপাটের কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। এ ধরনের আরো অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের অর্থ লোপাট করে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বছরের পর বছর ধরে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করছে। আদালতকে ব্যবহার করে ব্যাংক ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও সদিচ্ছা থাকলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে অন্যরা এ ধরনের সাহস পেত না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত, সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া খেলাপি ঋণের লাগাম টানা যাবে না ।
লেখক : ব্যাংকার


আরো সংবাদ



premium cement