২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ

-


বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের নজিরবিহীন সম্পৃক্ততা রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের নতুন ভাবনার জোগান দিয়েছে। র‌্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার প্রায় এক বছর পর আগামী নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে পারেন এমন সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ও ব্যক্তিদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত ঘোষণা শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং বিশ্ব রাজনীতিতে প্রধান আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এর সাথে যোগ হয়েছে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে দেয়া মার্কিন হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভসের ছয় কংগ্রেসম্যানের চিঠি, যাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরপত্তায় হুমকি হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের এ জোরালো সম্পৃক্ততার পেছনে মোটা দাগে যে বিষয়গুলো কাজ করছে তা হচ্ছে, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন, ইউক্রেন যুদ্ধপরবর্তী বৈশ্বিক নতুন মেরুকরণ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সরকারের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, মিয়ানমারে পরিস্থিতি, বৈশ্বিক গণমাধ্যমগুলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অব্যাহত কার্যক্রম।

মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি মোটা দাগে তিনটি মৌল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। তা হচ্ছে, জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বৈশ্বিক মানবিক উন্নয়ন। আর তিনটি উদ্দেশ্য সাধনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনো Isolation-এর নীতি গ্রহণ করে। আইসোলেশন হচ্ছে সেই নীতি, যা অন্য রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয়াদি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখে। আবার যুক্তরাষ্ট্র কখনো containment নীতি অনুসরণ করে। আর কন্টেনমেন্ট হচ্ছে সেই নীতি, যা যুক্তরাষ্ট্রকে বৈরী রাষ্ট্রের রাজনৈতিক এবং সামরিক অগ্রগতিতে সীমাবদ্ধ রাখতে সচেষ্ট করে। আবার কখনো দেশটি deterrence নীতি অনুসরণ করে। ডেটারেন্স হচ্ছে সেই নীতি, যা নিজের সামরিক শক্তির উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ এমনভাবে করে যাতে শত্রুরাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রকে আক্রমণ করতে নিরুৎসাহিত হয়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প বলা চলে ‘আইসোলেশনের’ নীতি অনুসরণ করে চলছিলেন। পক্ষান্তরে বাইডেন তার পররাষ্ট্রনীতিতে একই সাথে কন্টেনমেন্ট ও ডেটারেন্স পলিসি গ্রহণ করেন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়ার প্রাক্কালেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৯/১১ পরবর্তী ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের’ নীতি থেকে সরে আসে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে ওঠে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের অংশ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত একচ্ছত্র অধিপতির আসনে আসীন হয়। যার ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পছন্দসই সরকার ক্ষমতায় থাকবে সেটাই ছিল স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নতুন ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যে পরিবর্তনের ধারায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রসমূহের সাথে ‘স্টেট টু স্টেট’ যোগাযোগে মনোনিবেশ করে। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশের ব্যাপারে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ভারতের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া থেকে সরে আসে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকার নির্ণয়ে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ নীতি ঘোষণা করে- যে নীতির মূল লক্ষ্যই হচ্ছে- এতদঅঞ্চলে চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাব কমিয়ে আনা। যুক্তরাষ্ট্রঘোষিত ইন্দো প্যাসিফিক নীতিতে এ অঞ্চলের গুরুত্বের বিষয়টি উঠে আসে ঠিক এভাবে- "As we enter a decisive decade that holds considerable promise and historic obstacles for the indo-pacific, the American role in the region must be more effective and enduring than ever."

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান
ভূ-কৌশলগত দিক বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান নতুন করে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। ভারত মহাসাগরের নৈকট্য বঙ্গোপসাগরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক প্রবেশদ্বার করে তুলেছে, যা দক্ষিণ এশিয়াকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ তার বাইরের দুনিয়ার সাথে সংযুক্ত করবার প্রধান রুটে পরিণত করেছে। আলফ্রেড থায়ের মাহান তার The Influence of Sea Power Upon History: 1660–1783 শীর্ষক গবেষণায় মন্তব্য করেছেন, Navies are "essential components of the modern global political system,Õ and that only those powers with Ôsuperior navies" have been able to claim a position of world leadership.
তার বক্তব্যের মূল কথা হলো বৈশ্বিক রাজনীতিতে নেতৃত্বের আসনে থাকতে হলে সমুদ্রে শক্তিশালী নৌবাহিনীর বিকল্প নেই। সুতরাং বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরে পরাশক্তিগুলোর প্রভাব বজায় রাখা প্রধান স্ট্র্যাটেজিতে রূপ নিয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের জনসংখ্যা ও বাজারের আকারও বিশ্ব অর্থনৈতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়িয়েছে। পৃথিবীর অষ্টম জনঅধ্যুষিত রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ, যার জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। এ বিশাল জনসংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ ভোক্তার বাজার এবং কার্যকর শ্রমশক্তির জোগান দেয়। ফলে বাংলাদেশের উদীয়মান অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশে ব্যবসা ও বাণিজ্যে আন্তর্জাতিক পুঁজি বিনিয়োগের নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। এ ছাড়াও বঙ্গোপসাগরে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের সম্ভাবনা বাংলাদেশকে বৈশ্বিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। আঞ্চলিক কানেক্টিভিটির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান এর গুরুত্ব বাড়িয়েছে।

ইউক্রেন যুদ্ধপরবর্তী বৈশ্বিক নয়া মেরুকরণ
ইউক্রেন যুদ্ধ পরবর্তী বৈশ্বিক রাজনীতিতে নয়া মেরুকরণ শুরু হয়েছে। একদিকে চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি-ইরান সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ হিসেবে ভারতের ইউক্রেন ইস্যুতে মধ্যপন্থা অবলম্বনের নামে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়া। ইউক্রেন প্রশ্নে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাবে জাতিসঙ্ঘে ভারত, হয় ভোট দান থেকে বিরত ছিল নতুবা নিন্দা প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ছিল পীড়াদায়ক। বিনিময় হিসেবে ভারত নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়া থেকে সুলভ মূল্যে তেল পাচ্ছে। আর এই লেনদেনের পুরোটাই হচ্ছে মার্কিন ডলারের পরিবর্তে রাশিয়ার রুবলে। ভারতের এই অবস্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, বিগত বিশ বছর ভারতের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরশীলতা কি তাহলে পানিতে তলিয়ে গেল। কোনো বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিচ্ছেন দক্ষিণ এশিয়া ও এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ভারত নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে। ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতেই এতদঅঞ্চলে ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলোতে মনোনিবেশ করেছে দেশটি। আর এসব দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দসই সরকারকেই প্রাধান্য দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যারা আইনের শাসন ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখবে। যার ফল হিসেবে আমরা পাকিস্তানে ক্ষমতার আকস্মিক রদবদল দেখতে পাই। পাকিস্তানে ক্ষমতার পালাবদলের বিষয়টি তদারকিতে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের কাউন্সিলর ডেরেক সোলে। যিনি একই সাথে বাংলাদেশের বিষয়টিও দেখভাল করছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সরকারের ঔদ্ধত্য
একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ২০১৩ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু তখন মিত্র দেশ ভারতের প্রকাশ্য বাধায় তেমন একটা পেরে ওঠেনি। পক্ষান্তরে দেশটির উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ গালি শুনতে হয়েছে। দেশটির রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট সরাসরি হামলার শিকার হয়েছেন। ঘটনার এখানে শেষ নয়- রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গুম হওয়া পরিবারগুলোর সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সাথে বৈঠক করতে গেলে সরকার সমর্থক লোকেরা বাধা দেয়। পিটার হাসসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতরা বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কোনো কথা বলতে গেলে সরকার পক্ষ থেকে কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘনের দায় চাপানো হয় হরহামেশা। সর্বশেষ ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়ার বিষয়টি ওয়াশিংটনে মৌখিকভাবে জানানোর পরও যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো তিনটি রাষ্ট্রের দূতদের বাড়তি নিরাপত্তা প্রটোকল উঠিয়ে নেয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। শুধু তাই নয় গাড়ি থেকে তাদের পতাকা তুলে নিতে বাধ্য করা হয়। যা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চরম অবমাননাকর। তারপরও পিটার হাস সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সাথে কয়েক দফা বৈঠক করেন যাতে শান্তিপূর্ণ উপায়ে একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আমেরিকা না যাওয়ার ঘোষণা, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা জানান দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সরকারের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। এই আগুনে নতুন করে ঘি ঢেলেছে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে লেখা ছয় কংগ্রেসম্যানের চিঠি। চিঠিতে জাতিসঙ্ঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সম্পৃক্ত না করার অনুরোধ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে অভিহিত করা হয়।

মিয়ানমারে চলমান জনযুদ্ধ
বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারে চলছে জনযুদ্ধ। জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী অং সান সু চিকে হটিয়ে আবারো ক্ষমতায় দখল করে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। আর এর বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। চীন মিয়ানমারের জান্তা সরকারের পক্ষ নেয় আর যুক্তরাষ্ট্র নেয় জনগণের পক্ষ। মিয়ানমারের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা এখন জনতার নিয়ন্ত্রণে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ‘বার্মা অ্যাক্ট’ পাস হয়, যার লক্ষ্য হচ্ছে মিয়ানমারের বেসামরিক সরকারকে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করা। আর মিয়ানমারে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহযোগিতা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ভারতের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্র তেমন কোনো সহায়তা না পেয়ে বাংলাদেশের ওপরই নির্ভর করছে। আর সে যাত্রায় বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত গ্রহণযোগ্য সরকার প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের। যে সরকার মিয়ানমারে মার্কিন পলিসি বাস্তবায়নে সহায়তা করবে।

বৈশ্বিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন
দেশে অব্যাহত গুম খুনের বিরুদ্ধে দেশের গণমাধ্যম যখন যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়, তখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এ বিষয়ে মনোযোগ দেয়। যার ফল হিসেবে আলজাজিরা প্রচার করে ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস ম্যান’, ডয়েচে ভেলে প্রচার করে How the elite police force RAB terrorizes the people of Bangladesh, ইকনোমিস্ট প্রচার করে ‘Sheikh Hasina is Asia’s iron lady', নেত্র নিউজ প্রচার করে, ‘আয়নাঘরের বন্দী’। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত এসব প্রতিবেদন বৈশ্বিক জনমত গঠনে আবেদন তৈরি করে। এসব প্রতিবেদন ও তথ্যচিত্রে বাংলাদেশে বিরোধী দল দমনে সরকারের ‘গোপন মিশন’ বিশ্বসভায় ফাঁস হয়ে যায়। বিশেষ করে মার্কিন পলিসি মেকারদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয় এসব প্রতিবেদন। যার ফলে বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী হয়ে ওঠে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কার্যক্রম
দেশীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলো যখন সরকারের রোষানলে পড়ে মানবাধিকার ইস্যুতে কাজ করতে অপারগ হয়ে ওঠে, তখনই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো অব্যাহতভাবে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিল। আর এতে নেতৃত্ব দেয় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, কেনেডি ফাউন্ডেশন, ন্যাশনাল এন্ডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশন, টান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, সাপি, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স, সিএইচআরডি বাংলাদেশ, সাউথ এশিয়ান সলিডারিটি ফাউন্ডেশনসহ বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন। সংগঠনগুলো শুধু বিবৃতি কিংবা বিভিন্ন ইস্যুতে প্রতিবেদন প্রকাশ করেই ক্ষান্ত থাকেনি তারা মার্কিন পলিসি পরিবর্তনে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে নিরলসভাবে কাজ করতে থাকে। যার ফল হিসেবে র‌্যাবের বিরুদ্ধে স্যাংকশন কার্যকারিতা লাভ করে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের আইনের আওতায় বাংলাদেশ সরকারকে কিভাবে জবাবদিহির আওতায় আনা যায় সে লক্ষ্যে পলিসি পেপার তৈরি করে মার্কিন প্রশাসনকে বাংলাদেশ প্রশ্নে সম্পৃক্ত হতে আগ্রহী করে তোলে।

ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে এই মুহূর্তে স্পষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব না হলেও বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ ও মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি পর্যালোচনায় বলা যায়, আগামী দিনগুলো সঙ্কটজনকই হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার মার্কিন চাপকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। সরকারের সাথে ওয়াশিংটনের সংলাপের ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। আর এ জেদাজেদির সরাসরি প্রভাব পড়বে তৈরী পোশাক শিল্পে। মনে রাখতে হবে, তৈরী পোশাক সেক্টরের আয়ের ওপর বাংলাদেশের বৈদেশিক রিজার্ভ অনেকটা নির্ভরশীল। জিডিপির ৯.২৫ শতাংশ অবদান তৈরী পোশাক শিল্পের। ২০২২ সালে বাংলাদেশ ২২ বিলিয়ন ডলারের তৈরী পোশাক শুধু যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার অন্যতম খাত হবে তৈরী পোশাক শিল্প। যা হবে অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ। এছাড়া জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাদ দেয়া হলে এক দিকে সেনাবাহিনীর মধ্যে যেমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে, ঠিক তেমনি বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে ভাটা পড়বে। শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার আয় করে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র শিগগির তার ভিসানীতি কার্যকর করবে। এতে করে সরকারের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা কঠিন হতে পারে। কারণ অর্থনৈতিক সঙ্কট চরম আকার ধারণ করবে, জনমনে দেখা দেবে অসন্তোষ। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অব্যাহত সমর্থন, বিরোধী দলকে রাজপথে নামতে উৎসাহিত করবে। ফল হিসেবে আবারো সঙ্ঘাত ছড়িয়ে পড়বে রাজপথে। এমনি বাস্তবতায় একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্র তৈরিতে সরকারি দলের বোধোদয় হবে এটা জাতির প্রত্যাশা।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, রবার্ট মরিস
ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র


আরো সংবাদ



premium cement