১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০১ মাঘ ১৪৩১, ১৪ রজব ১৪৪৬
`

ভারতীয় সেনাপ্রধানের দ্বিতীয় বাংলাদেশ সফর

-

গত কয়েক বছরে ভারত ও বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এটি দুই দেশের রাষ্ট্র নেতাদের পারস্পরিক সফর, প্রশিক্ষণ উদ্যোগ বাস্তবায়ন, সমবায় প্রশিক্ষণ অনুশীলন এবং মানবিক সহায়তা এবং দুর্যোগ-ত্রাণের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। ভারত দীর্ঘদিন যাবত বাংলাদেশের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে মূল্যায়ন করে এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের লক্ষ্য সমর্থনের পাশাপাশি সম্পর্ক আরো গভীর করার চেষ্টা করে। ব্যবসায়-বাণিজ্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, পরিবহন ও যোগাযোগ, গবেষণা ও প্রযুক্তি, সামরিক ও নিরাপত্তা, সমুদ্রবিষয়ক, জলবায়ু পরিবর্তন এবং টেকসই উন্নয়নসহ সব ক্ষেত্রেই দুই দেশের মধ্যে যথেষ্ট সহযোগিতা রয়েছে। গত ৫ জুন ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ পাণ্ডে প্রতিবেশী দেশের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করতে এবং দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সম্পর্ক জোরদার করার উপায় নিয়ে আলোচনা করতে দুই দিনের সফরে বাংলাদেশে যান। সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল পাণ্ডের এটি দ্বিতীয়বার বাংলাদেশ সফর। গত বছরের জুলাইয়ে তিনি শীর্ষ পদে দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম সেদেশে যান।

দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদারের উপায় বের করতে সেনাপ্রধান এই সফরে বাংলাদেশের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করেন। সেনাপ্রধান সশস্ত্রবাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধানের সাথেও আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন। চলতি বছরের এপ্রিলে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ভারত সফর করেন এবং চেন্নাই অফিসার্স ট্রেনিং একাডেমিতে পাসিং আউট প্যারেড পর্যবেক্ষণ করেন। সেনাবাহিনীর মতে, যৌথ সামরিক মহড়া এবং সিনিয়র সামরিক কমান্ডারদের ঘন ঘন সফরসহ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা কার্যক্রম দুই দেশের সশস্ত্রবাহিনীর মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়তা করে। বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ভারতীয় সেনাপ্রধানের এই সফর হলো। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ বিষয়ে একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছে। নির্বাচনের আগে নতুন ভিসানীতি সাম্প্রতিক একটি ইস্যু। ভারত এই উপমহাদেশের বৃহত্তম দেশ ও এটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে বাংলাদেশের প্রতি একের পর এক পদক্ষেপ নিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে অবজ্ঞা করে আসছে। ফলে ভারত এখন এসব কর্মকাণ্ডে অস্বস্তিতে পড়েছে। কারণ জাতিসঙ্ঘে চীনের ভেটো বাংলাদেশকে হেয় করতে চায় এমন রেজ্যুলেশন বন্ধ করতে পারে, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশের ক্রমবর্ধমান চাপ বাংলাদেশ সরকারকে চীনের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তাই ভারত বাংলাদেশকে কৌশলগতভাবে সহায়তা করতে পারে। বাংলাদেশ পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার পথ অনুসরণ করলে বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতের জন্য কী অবশিষ্ট থাকবে?
বিভিন্ন কারণে ভারত ওই এলাকায় হাসিনা প্রশাসনকে সমর্থন দিতে বাধ্য হচ্ছে। উত্তর-পশ্চিম ভারতের নিরাপত্তা বজায় রাখতে এবং বাংলাদেশে ভারতীয় কৌশলগত ও বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার জন্য ভারতের বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের প্রয়োজন। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক’ ঘোষণা করেছে। এই ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অধীনে সম্পর্ক এবং সহযোগিতা উভয় পক্ষের দ্বারা চালু করা যেতে পারে। তাই ভারতীয় সেনাপ্রধানের এই সফরটি বাংলাদেশ এবং ভারতের ‘অসামান্য’ দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা সম্পর্কের সাথে সংযুক্ত বলে মনে হচ্ছে। সেনাপ্রধানের সফর দুই সেনাবাহিনীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে পারে এবং বিভিন্ন কৌশলগত উদ্বেগের বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে আরো সমন্বয় ও সহযোগিতার জন্য অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে।

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমন এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে দুই দেশ ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করে। এই সফর পারস্পরিক প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার করতে পারে। কিছু দ্বিপক্ষীয় অসুবিধা সত্ত্বেও উভয় দেশ তাদের সম্পর্ক আরো জোরদার করতে খুবই আগ্রহী, যা এই সফরের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে। এটি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করতে এবং উন্নত বোঝাপড়ায় সাহায্য করতে পারে। বাংলাদেশের কিছু দুশ্চিন্তা কাটিয়ে উঠতে ভারতকে অবশ্যই বাংলাদেশের বিশ্বস্ত মিত্র হিসেবে সহযোগিতা করতে হবে।
ভারত বাংলাদেশকে একটি নির্ভরযোগ্য কৌশলগত মিত্র হিসেবে দেখে। আর্মি টু আর্মি সহযোগিতার অংশ হিসেবে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ১৮টি ব্র্যান্ড-নতুন ১২০ এমএম মর্টার সরবরাহ করার পাশাপাশি, ভারত বাংলাদেশকে ভারতের কাছ থেকে প্রতিরক্ষা সামগ্রী কেনার জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলার লাইন অব ক্রেডিট দিয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের তিন বাহিনীর ১২২ সদস্যের দল ভারতে প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিল। গত ৫০ বছরে ভারতীয় জাহাজের প্রথম নৌসফরটি ৮ থেকে ১০ মার্চের মধ্যে হয়েছিল, যখন দু’টি ভারতীয় নৌজাহাজ- আইএনএস কুলিশ ও আইএনএস সুমেধা বাংলাদেশের মোংলা বন্দর পরিদর্শন করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত উভয়ই বাংলাদেশের সাথে আরো কৌশলগতভাবে জড়িত হতে চায় এবং তাদের সম্পর্ক আরো গভীর করতে চায়। বাংলাদেশের নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ এবং ভারতের নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ পাণ্ডে এই মাসের শুরুতে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করার প্রয়াসে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কথা বলেছেন। দুই সেনা নেতা হয়তো ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশ কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে সে বিষয়েও কথা বলেছেন।

২০১৭ সালের এপ্রিলে নয়াদিল্লিতে তার চার দিনের সফরে, শেখ হাসিনা ভারতের সাথে দু’টি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিগুলো ভারত এবং তার প্রতিবেশীদের মধ্যে প্রথম চুক্তিগুলো চিহ্নিত করেছিল। চুক্তিতে দুই দেশের সশস্ত্রবাহিনী যৌথ প্রশিক্ষণ ও মহড়া চালাবে। ভারত বাংলাদেশী সামরিক বাহিনীকে প্রযুক্তিগত ও লজিস্টিক সহায়তার পাশাপাশি বিশেষায়িত প্রশিক্ষণও দেবে। দুই দেশের সশস্ত্রবাহিনী সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা এবং মানবিক সহায়তা ও দুর্যোগ ত্রাণ (এইচএডিআর) নিশ্চিত করার জন্য প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দুই দেশের সশস্ত্রবাহিনী একাধিক স্তরে একে অপরের সাথে সহযোগিতা এবং সমন্বয় করে। কারণ প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ দিক। প্রতিরক্ষার বিষয়টি ১৫ ডিসেম্বর, ২০২১-এ উঠেছিল যখন রাষ্ট্রপতি কোবিন্দ বাংলাদেশী সরকারের সিনিয়র প্রতিনিধিদের সাথে দেখা করেছিলেন।
ভারত ও বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সবচেয়ে বেশি কর্মী প্রেরণ করেছে। সন্ত্রাস দমনের ক্ষেত্রে দুই সেনাবাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অটল অবস্থান সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ভারতের ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করে। ভারতের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে মহাকাশ ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখার জন্য বাংলাদেশের প্রচেষ্টা ভারতের জানা। কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন যাতে তার ভূখণ্ড ব্যবহার না করে তার জবাবে বাংলাদেশের স্বার্থে আক্রমণ না করতে পারে সে জন্য ভারতের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত। উত্তর-পূর্ব ভারতে বিদ্রোহের বর্তমান নিন্ম অবস্থানের কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং আসামের মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের সাহায্যের প্রশংসা করেছেন এবং তাদের দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ও বাণিজ্য জোরদার করার ইচ্ছার ওপর জোর দিয়েছেন।
লেখক: কলামিস্ট, কলকাতা ¯স্নাতক কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক


আরো সংবাদ



premium cement